May 14, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

মানুষ টিকবে? না হাওয়া হয়ে যাবে?

অনল রায়হান : আমি না, বিজ্ঞান বলছে, আগামী ১০০০ বছরের মধ্যে মনুষ্য প্রজাতি হাওয়া হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে মাটিতে মিলিয়ে যাবে লক্ষ লক্ষ প্রাণী। উদ্ভিদ বলতে কিছু গুল্ম, আগাছা থাকতে পারে। তবে বৃক্ষ তখন অতীত। গাছ বলে কিছু নেই। পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থলের স্থলে তখনকার ভাগ বলবে পৌনে চার শতাংশ জল আর পোয়াটেক মাটি। সে মাটি আবার পাথুরে মাটি। সাদা সাদা, খয়েরি-লালচে রঙ। আর পোনে চার শতাংশ জলের সবটাই লবণাক্ত এবং বিষাক্ত। টেম্পারেচার ৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি। আল্পস কিংবা হিমালয়ে এক ছটাক বরফও অবশিষ্ট নেই। মেরু অঞ্চলের হিমবাহ আরও পাঁচ সাতশো বছর আগেই গলে গলে ভ্যানিশ হয়ে গেছে। এখনকার বঙ্গপোসাগরের হ্যারিকেনের চেয়ে তিনগুন শক্তিশালী ঝড়, জল আর স্থল দাপড়ে বেড়াচ্ছে সপ্তাহে তিন চারবার করে। কেন্দ্রে বাতাসের গতি দেড়শ মাইলে ওঠা নামা করছে। আর চলছে এসিড বৃষ্টি টানা, বজ্রপাত টানা জলোচ্ছাসও টানা। ভূমি কেঁপে উঠছে বারবার। রিখটার স্কেলে ১০ এর ঘরের ওপরের কাঁপাকাঁপি। একই সঙ্গে আকাশ থেকে আছড়ে পড়ছে ছোট বড় জ্বলন্ত পাথর, যাহাকে উল্কা বলা হয়। এই আছড়ে পড়াও ঘটছে প্রায় প্রতিদিন। টানা।
আমি না। বিজ্ঞান বলছে এই ভবিষ্যৎ। আর এই ভবিষ্যতের সকল নমুনা গত পঞ্চাশ বছর ধরে দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে পৃথিবীর সর্বত্র। প্রাকৃতিক ভারসাম্যতা হারিয়েছে পৃথিবী। উষ্ণতা বেড়ে গেছে। জলবায়ুর ছন্দ কেটে গেছে। মেরু অঞ্চলের হিমবাহ অনেকগুলিই এই পঞ্চাশ বছরে গলে গেছে। আমাজান রেইন ফরেস্টের ষাট ভাগ উধাও হয়ে গেছে এই পঞ্চাশ বছরের মধ্যেই। এই পঞ্চাশ বছরেই পৃথিবীর আকাশে দেখা দিয়েছে এক ভয়ংকর ফাটল। আর্কটিকের আকাশের এই ফাটল দিয়ে পৃথিবীতে নেমে আসছে সূর্যের আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি। যে ক্ষতিকর রশ্মি থেকে পৃথিবীর প্রাণীকূলকে বাঁচাতো ওজোন লেয়ার, সেটা ভেঙ্গে যাচ্ছে ক্রমশ। এই পঞ্চাশ বছরে পৃথিবী থেকে সুপেয় জলের হ্রদ-হাওর-নদী হারিয়ে গেছে পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশি। এদিকে বেড়ে গেছে সমুদ্রের গড় উচ্চতা। আর ফুরিয়ে এসেছে পৃথিবীর পেটের ভেতরের খনিজ ভান্ডারের অফুরান সংগ্রহ, এই পঞ্চাশ বছরেই। কি হবে তাহলে? এখন থেকে দুহাজার বছরের মধ্যে পৃথিবী পরিনত হবে মঙ্গল গ্রহের মত এক মরা গ্রহে। পাথুরে খাদে ভরা। এক ফোঁটা পানির অস্তিত্ব নেই কোথাও। সুপেয় কুপেয় কিচ্ছু নেই। নীল আর সবুজ, পৃথিবীর চির চেনা এই দুই রঙের পরিবর্তে লালচে খয়েরি হবে এই গ্রহের ভূষণ। অবশ্য সেই দৃশ্য দেখার জন্য তখন আর মানুষ বলে কেউ থাকবে না। শুধু কোনও একদিন অন্য কোনো ছায়াপথ থেকে বুদ্ধিমান আরেক প্রাণী এসে পৃথিবী দেখেশুনে বলে যাবে, এই গ্রহে একদা প্রাণের বিকাশ ঘটিয়াছিল।
যে কোনো সত্যিকারের শিক্ষিত মানুষ মাত্রই এখন জানেন, আমরা নিশ্চিহ্ন হওয়ার দরজার ঠিক এপাশেই দাঁড়িয়ে আছি। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, শত সহস্র চেষ্টা করলেও পৃথিবীকে আর তার আদীম সুন্দরতায় ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। একমাত্র যা করা সম্ভব এবং করতেই হবে, মানুষের সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার জন্য যত বেশি সম্ভব সময় আদায় করে নেয়া। মনে রাখতে হবে, মানুষই পৃথিবীর ধ্বংস ডেকে এনেছে এবং একমাত্র মানুষই পারে এই ধ্বংস ঠেকাতে অন্তত যতটা এখনও সম্ভব। মানুষ বাঁচতে পারলে পৃথিবীর আর সকল প্রাণী আর উদ্ভিদকূলেরও দিশা হবে। ভেবে দেখুন, আমাদের দায়িত্বটা আসলে কি সুবিশাল! এই দায়িত্বের দিকটা এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকার সাধারন মানুষ বুঝলেও সরকাররা অল্পস্বল্প বোঝার অনুরাগ নিয়ে বসে আছেন। প্যারিস সম্মেলন এর পর মারাক্কেশ ঘোষনা পৃথিবীর ভবিষ্যতকে আলোকিত করতে পারেনি। ছোট বড় সব সরকারই ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্টদের আঁচলধরা হয়ে পৃথিবী বাঁচাতে চাইছেন। এ কি করে হয়? বাতাস, পানি আর মাটি তিনটি ক্ষেত্রই দূষিত হচ্ছে পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থার কারনে। তারপর আছে পণ্য ব্যবহার পরিক্রমার কারন। দুক্ষেত্রেই কার্বন নিঃস্বরণের পরিমান নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য সরকারী উদ্যোগ সবচেয়ে বেশি জরুরী। মুক্তবাজার অর্থনীতি কোন এককালে প্রাসঙ্গিক থেকে থাকলেও আজকের দুনিয়ায় এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা মানবজাতির ভবিষ্যতের চুড়ান্ত অমঙ্গল ডেকে আনছে। বাজারমুখী অথনীতি পণ্য প্রতিযোগীতার যে বেয়াড়া সংস্কৃতি তৈরী করেছে, তার থেকে বেরিয়ে আসতে হলেও লম্বা সময় চাই। আর এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে পৃথিবীর পরিবেশ রক্ষাও অসম্ভব। কারন এই দুই নিবিড় ভাবে সম্পর্কযুক্ত। আমি কয়টা গাড়ি ব্যবহার করবো, কয়শো ড্রেস পড়বো, বছরে কবার বিলাস সামগ্রী বদলাবো, কবার দেশভ্রমণে বের হবো, কত টন খাবার নষ্ট করে রাস্তায় ফেলে দেব… এ সব কিছুর সংগেই আছে কার্বণ নি:স্বরণের যোগ। সেই সংগে আছে মুক্তবাজার অর্থনীতির সামজিক প্রতিক্রিয়া। এও ভয়াবহ। এই অর্থনৈতিক মডেল সারা পৃথিবীতে মানুষে মানুষে বৈষম্য বাড়িয়েছে। বাড়িয়েছে শহরকেন্দ্রীক মানুষের চাপ আর সেই সঙ্গে অসহিষ্ণুতা। যেখান থেকে জন্ম হচ্ছে নানা ধরনের চরমপন্থা ও মতবাদ।
পানিপথের যুদ্ধের কথা পড়েছি আমরা ইতিহাসে। পানি নিয়ে মহাযুদ্ধ এই শুরু হলো বলে। ইতিমধ্যেই পানি নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন সরকারে সরকারে, জাতিতে জাতিতে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আফ্রিকার নীল নদকে ঘিরে দুই হালি সরকারের ধস্তাধস্তি চলছে পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে। আমাদের উপমহাদেশেও তাই। এদিকে পৃথিবীর প্রাকৃতিক জ্বালানী ভান্ডার নেমে এসেছে তলানীতে। মাটির স্বাভাবিক উর্বরতা হারিয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলছেন, এসব কিছুর প্রত্যক্ষ পরিনাম হবে, শহরের পর শহর বাতিল যায়গায় পরিনত হওয়া এবং এনভায়রনমেন্ট রিফিউজি বা পরিবেশ শরনার্থীর জন্ম হওয়া। খাদ্য, জল আর জ্বালানীর আশায় এক এলাকার মানুষ আরেক এলাকায় ছুটছে পাগলের মত! বেঁধে যাচ্ছে হানাহানি আর দাঙ্গা।
এই অতি জঘন্য ভবিতব্য এড়াতে হলে এই গ্রহের সকল মানুষকে এককাট্টা হতে হবে। কোনো সরকারী- রাজনৈতিক-কূটনৈতিক চাল সহ্য করা যাবে না। ব্যবসায়ীদের সরে আসতে হবে অসুস্থ বাজার প্রতিযোগীতা থেকে। সাধারন মানুষদের জীবন ব্যবস্থায়ও আসতে হবে যুগান্তকারী পরিবর্তন। পরিমিতিবোধ হতে হবে মানুষের নতুন জীবনব্যবস্থার দর্শন। আসলে এক নতুন অর্থনৈতিক মডেল আর সাংস্কৃতিক জাগরনের প্রয়োজন এখন পৃথিবীবাসীর। বিপদ এড়াবার সময় এখনও শেষ হয়ে যায়নি এটা যেমন সত্যি, সময় আর হাতে নেই এটাও অকাট্য বাস্তব।
স্টিফেন হকিন্স এর মত বিজ্ঞানীদের অনেকে অবশ্য বলেই দিয়েছেন, পৃথিবীর আশা গুড়েবালি। এই গ্রহ মানুষের জন্ম দিয়েছে একদিন এই গ্রহ পরিত্যগ করে মহাশূণ্যে পাড়ি দেবার জন্যই। হকিন্স বলছে, ‘পায়ের দিকে নয়, আমাদের এখন তাকাতে হবে আকাশের দিকে।’ অর্থাৎ মানুষকে মহাকাশেই খুঁজে নিতে হবে তার পরবর্তী আবাস। প্রশ্ন হচ্ছে, সেই প্রযুক্তি আবিস্কার আর ধাতস্ত হতে যে সময় মানুষের দরকার তা আদৌও পাওয়া যাবে কিনা !

Print Friendly, PDF & Email