May 16, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

অনুর্ব্ধ ১৭…তোমার জন্য। কিছু শিশুদের গল্প।

অনল রায়হানঃ দেখা গেল, এরা কেউ তাদের বাবা মাকে আর দেখেইনি! পাঁচ সাত বছর বয়সে বাবা মার কাছ ছাড়া হয়েছে। আর তারপর সত্তর বছর। নিজের মৃত্যু এসেছে। কিন্তু বাবা মা আর আসেনি। কেউ কেউ বাবা মায়ের পরিচয়ই জানতে পারেনি। নতুন বাবা মাকে পেয়েছে। বড় হয়ে জানা গেল, ওর জন্মদাতা বাবা মায়ের পরিচয় জানাই যায়নি। কার মত হলাম আমি? এই চোখ-নাক-মুখ…এই আমি আসলে কার মত দেখতে হলাম? এই মধুর বিষ্ময়ের সমাধা না করেই সে মরে গেল আরও হয়ত ষাট-সত্তর বছর পর। আরও অনেকে আছে…যারা সত্যিকারের বাবা মা, মিথ্যাকারের বাবা মা কোনো ধরনের বাবা মাই পায়নি। বড় হয়েছে সরকারী হাউসে। কিশোর ডরমিটরিতে। স্কুলের হোস্টেলে। তারপর সেও মরে গেছে আসল নকল কোনো বাবা মা ছাড়াই।

শিশুদের গল্প বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এর চিত্র ফলাফলকোথায় ঘটেছে এটা?… তুমি দ্বিতীয় ওয়ার্ল্ড ওয়ারের কথা নিশ্চয়ই শুনেছো? সেভিংস প্রাইভেট রায়ান দেখেছো? স্পিলবার্গের ফিল্ম। সবচেয়ে ভালো হয় যদি রোমান পোলানস্কির পিয়ানিস্ট ছবিটা দেখে ফেলো। তাহলে খানিকটা বোঝা যাবে এই দূর্ভাগা মানুষেরা কারা। এই বাচ্চাগুলো ছিল সব ইহুদী। হিটলার যখন ইহুদীদের খামোখা ধরে মারতে শুরু করলো তখন হলো কি, ইহুদী বাবা মায়েরা তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের জীবন বাঁচানোর জন্য জার্মানি আর পোল্যান্ডের বাইরে নিরাপদ যায়গায় পাঠিয়ে দিতে শুরু করলো। হাজারে হাজারে শিশু। তাদের হাজারে হাজারে বাবা মা হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে মারা পড়লো। কঠিন এক পৃথিবীতে হাজারে হাজারে শিশু হয়ে গেলে একদম একলা। সেটা ১৯৪৫ সাল। তার ঠিক পঁচিশ বছর পর এই আমাদের দেশেই ঘটলো আরেক যুদ্ধ। সে যুদ্ধের কথা তুমি জানো। ১৯৭১ সাল। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নামে পরিচিত এই যুদ্ধ। এখানেও তেমন ঘটলো। হাজারে হাজারে শিশু অনাথ হলো। এতিম হলো। একলা হয়ে গেল। কারও বাবা মা দুজনকেই মেরে ফেলেছে পাক বাহিনী। কারও বাবাকে মেরেছে। মা হয়ত বেঁচে গেছে। কিন্তু তাতে কি! বাবা না থাকলে তো মাও একলা হয়ে যান। সেই মা আর শিশুটির একলা চলার ছেচল্লিশ বছর চলে গেছে। এখন ২০১৬ সাল। কোনো কোনো শিশুর মাও আর বেঁচে নেই। শিশুটি বড় হয়ে এখন কত বড় হয়ে গেছে! কিন্তু যন্ত্রণা আর ক্ষোভ ওর মনে রয়ে গেছে আজও। তোমাকে ছোট করে একটা ঘটনা বলি। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে এরকমই বাবা হারা একটি শিশুর বয়স এখন সাতচল্লিশ। ওর বাবা ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের এক নির্ভীক মানুষ। সাংবাদিক। পাকিস্থানী সেনা আর তাদের ধ্বজাধারী কসাইদের সংগঠন জামায়াতে ইসলামীর রাজাকাররা উনাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলে। সেই ছেলেটি ক’দিন আগে ঢাকার বাইরে এক জায়গায় কাজে গিয়ে ঘটনাক্রমে তার বাবার লেখা একটা ডায়রি খুঁজে পায়। কি অদ্ভূত দেখো! সেই ডায়রিতে ছেলেটি তার জন্মদিনটিকে পেয়ে গেল! আরও অনেক কথার ফাঁকে তার বাবা এক যায়গায় লিখে গেছেন, ‘আজ আমার ছেলের জন্ম হলো।’ ছেলের নামটাও লিখে গেছে। যে বাবা নিহত হয়েছে চার যুগ আগে, তার নিজের হাতে লেখা শিশুটির জন্মের কথা, নিজের নামটার কথা পড়তে ওর কেমন লেগেছে ভাবো? এ তো আর অসুস্থ হয়ে এমনি এমনি এক বাবার মরে যাওয়া নয়! যে বাবা দেশের জন্য, মানুষের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছে, সেই বাবা! এক বীর বাবার হাতে নিজের নাম আর জন্মদিনটির কথা কখনও পড়া হবে এটাই তো শিশুটি কখনও ভাবেনি! আরেক শিশুর কথা বলি। এর বাবাকেও মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনী আর রাজাকাররা মেরে ফেলেছে। শিশুটির বয়স এখন আটচল্লিশ। বাবার কোনো স্মৃতি নাই। তেমন কোনো চিঠি নাই। এমনকি নিজের পিচ্চিকালে বাবার সংগে কোনো ছবিও নাই। সেই বাবারই লেখা একটি লম্বা চিঠি শিশুটি হঠাৎ পেয়ে গেল কয়েকবছর আগে। চিঠিটা বাবা লিখেছে মাকে। আর তাতে সন্তানদের সত্যিকারের মানুষ হয়ে গড়ে ওঠার জন্য কিছু উপদেশও আছে। ভেবে দেখো, ছেলেটির কেমন লেগেছে যখন সে আবিস্কার করলো, তার বর্তমান জীবনের কিছু সমস্যার কথা তার একাত্তরের নিহত বাবা অত বছর আগেই বলে গেছে! এটা করো না। ওটা করতে পারো।
এরকম উদাহরণ অনেক অনেক। দিত্ব¡ীয় ওয়ার্ল্ড ওয়ারের সেই ইহুদী শিশুদের তুলনায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বাবা হারা এই শিশুরা হয়ত ভাগ্যবান। বাবা মায়ের পরিচয়টা তো জানা আছে! সেই সঙ্গে জানা আছে, বাবারা যে উদ্দেশ্য আদর্শের জন্য প্রাণ দিয়েছিল, তা মাঠে মারা গেছে! কিছু দেশ ও মানবতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্খা বিরোধী মানুষ আমাদের এই দেশটাকে কব্জা করে ফেলে ১৯৭৫ সালে। তারপর থেকে লম্বা সময় এই বাজে লোকগুলোই দেশ চালিয়েছে। আর ওই যে হাজারে হাজারে শিশু! তাদের স্বপ্নের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব সময়ে হয়কি, যারা দুুখী, যারা শোষিত তারা নিজেদের মমতার টানেই এক হয়ে যায়। এই শিশুরাও তাই করেছিলো আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে। নিজেরাই নিজেদের খুঁজে বের করেছে। তারপর সবাই এক হয়ে গড়ে তুলেছে একটা সংগঠন। নাম দিয়েছে প্রজন্ম ’৭১। এই একত্রিত হওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য হলো বাবা মায়েরা যে দেশের জন্য প্রাণ দিয়ে গেছে সেই স্বপ্নের দেশটাকে পুনরুদ্ধার করার জন্য সমমনা মানুষদের সংগে একত্রে কাজ করা আর লক্ষ লক্ষ বাবা মায়ের হত্যাকান্ডের যেন বিচার হয় এ দেশে তা নিশ্চিত করা। কিন্তু আমার কি মনে হয় জানো? এই শিশুরা যে সবাই এক হয়েছে তার আরও একটা কারন আছে। এরা হয়ত একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে হারানো বাবা আর মা, তাদের আদর আর ভালোবাসা, তাদের সাহস আর নির্ভিকতাকেই জড়িয়ে ধরতে চেয়েছে। কারন এই শিশুদের যন্ত্রণা আর ক্ষোভ প্রায় একই রকম। একারনেই এদের এই যে সংগঠন প্রজন্ম ’৭১, এর আর কোনো বিকল্প হয় না। হতে পারবেও না। কারন এখানে সবাই মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ছেলেমেয়ে। তাই এরা আওয়ামী লীগ না, বিএনপি না, ছাত্র ইউনিয়ন না, উদিচি না, বৃটিশ কাউন্সিল না, বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র না, খেলাঘর না। এরা আসলে হাজার হাজার শহীদ বাবা মায়ের হাজার হাজার বিভিন্ন রকমের ছেলেমেয়ে হয়েও যেন এক বাবা মায়ের ছেলে মেয়ের মত। সেই বাবা মা কে জানো তো? ১৯৭১ সাল। সেজন্যই হয়ত প্রজন্ম ’৭১। একবার ভেবে দেখো, তোমার বাবা যদি আরও অনেক বাবাদের সাথে এখন কোথাও কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত হন অন্য বাবা ছেলেমেয়েরাও কি তখন তোমার আত্মার বন্ধু হয়ে উঠবে না? বাবাদের আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য তোমরাও কি একসাথে কাজ করতে না?
শোনো, যদি কখনও প্রজন্ম ’৭১ এর কোনো অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারো, খেয়াল করে এই শিশুদের মুখগুলো একটু দেখো…দেখবে একই রকম লাগছে। তোমার ভালো লাগবে। কারন অনেকে যখন একসংগে একই ভাবনায় উজ্জীবিত থাকে, তখন হাজার মুখ এক মুখ হয়ে যায়। সেই মুখ দেখতে লাগে মহাকালের মত। মহাকাল কি তো জানোই? ধরো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সেই ইহুদী শিশুরা, আমাদের এই মুক্তিযুদ্ধের শিশুরা আর পৃথিবীর যত দেশে দেশে যত যত বাবা-মায়েরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়ে অকালে মরে গেছে, সেই সব শিশুরা যদি হঠাৎ কাল আর সময় ছাপিয়ে উঠে একসঙ্গে এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয় কিছু একটা বলবে বা করবে বলে…ওই হলো এক মহাকাল এর আর্বিভাব।
কি মনে হয় তোমার? মহাকাল আসবে তোমার চোখে?

লেখক : শহীদ বুদ্ধিজীবী জহীর রায়হানের সন্তান

Print Friendly, PDF & Email