May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

যার জন্য স্বাধীনতা পেলা, তাকেই তোমরা হত্যা করলা?

নাদিম মাহমুদ : একদিন ল্যাবে আমার কয়েকজন জাপানি, থাইল্যান্ড, ফিলপাইন আর ভিয়েতনামের সহপাঠিরা বাংলাদেশ বিষয়ে জানতে চেয়েছিল। আমার সাথে পরিচয় হওয়ার আগে ওরা বাংলাদেশকে ইণ্ডিয়া বা ভারতের কোন অঙ্গরাজ্য হিসেবেই চিনতো। তাই বাংলাদেশীকে পেয়ে জানার উৎসাহটা একটু বেশি।

১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করলাম আর তার প্রথমে পড়লো বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন। ভাষার জন্য শহীদের খাতায় কয়েকজনের নাম বলতেই ওরা বলে, ভাষা তো মায়ের মুখ থেকে আসা আর এর জন্য সংগ্রাম কিসের? আজব, তোমরাতো নতুন করে বাংলা বলতে শিখনি, তাহলে তা বলতে বাঁধা কিসের?

এরপর চলে আসলো পাকিস্তান। শোষণ আর বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরলাম। পশ্চিমের সেই শাসক গোষ্টির নির্লিপ্ততায় বাঙালিদের ‘সংগ্রামী বাঙালি’ পরিচয়ের প্রেক্ষাপট পাওয়ার পর বন্ধুদের আগ্রহের জায়গা তৈরি হলো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশের কথা তারা জানেন না। লাখো ধর্ষিত মায়ের বিনিময়ে পাওয়া বাংলার কথা বলতে ওরা কেমন জানি ‘থ’ মেরে গেল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানে হিরোশিমায় ১ লাখ ৪০ হাজার আর নাগাসাকিতে ৭০ হাজার মতো মানুষ মারা যাওয়ার পর জাপানিরা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তাদের সেই যুদ্ধে জাপানিদের আত্বত্যাগই মনে হয় বড় ছিল, কিন্তু আমার মুখ থেকে ত্রিশ লাখ শব্দটি শুনে একটু হলেও ভচকিবে এটা স্বাভাবিক। তাই আগ্রহ নিয়ে এক জাপানি বন্ধু, জিজ্ঞাসা করলো, ত্রিশ লাখ মানুষকে পাকিস্তানিরা হত্যা করেছে?

আমি বললাম, ‘না’। পাকিস্তানিদের সাথে ছিল ‘কিছু মাস্টারমাইন্ড বাঙালি’। তাদের নৃশংসতায় পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারা পাকিস্তানিদের জন্য ছিল ‘টর্চ লাইট’ যার আলোয় বুদ্ধিজীবী, তাঁতী, জেলে, কৃষক, শ্রমিকদের রক্ত নেশায় মত্ত ছিল তারা। নয় মাসের নারকীয় হত্যাযজ্ঞের পর স্বাধীনতা নামক শব্দটি আমরা উপহার হিসেবে পাই। বিশ্ব ‘মানচিত্রে ‘বাংলাদেশের’ জন্ম হয়।

এবার এক থাইল্যাণ্ডের বন্ধু প্রশ্ন করলো, পুরো মুক্তিযুদ্ধে তোমাদের কোন নেতা ছিল না? কার নির্দেশেনায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেয়েছিল?

আমি বললাম, আমাদের স্বাধীনতার ‘আর্কিটেক’ হলো শেখ মুজিবর রহমান’ যার নিদের্শনায় আর সংগ্রামে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এই ব্যক্তির জন্য লাখো মানুষ যুদ্ধে নামে। রক্ত দেয়, স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করে বাঙালিরা। ইতিহাসে আমাদের এই নক্ষত্র ‘জাতির পিতা’ হিসেবেই স্বীকৃত।

এইবার ভিয়েতানামিজ আর জাপানিরা জিজ্ঞাসা করলো, উনি কি এখনো বেঁচে আছেন। আমাদের উনার একটি ছবি দেখাও প্লিজ।

মোবাইল ফোনের গুগুল ইমেজ থেকে ‘বঙ্গবন্ধুর’ ছবি কয়েকটি দেখালাম। একাত্তরের মাত্র চারটি বছর পর শেখ মুজিবর রহমান কে বাঙালিরা হারায়। সেই সাথে ওই পরিবারের অন্তত দেড় ডজন সদস্যকে খুন করা হয়। পঁচাত্তরের ওই কালো রাতে ‘স্বাধীনতার স্বাদে’ নুন ঢেলে পরাজয়ের বিজয় উৎসব করে ঘাতকরা।

এবার প্রশ্ন আসলো, ওই ঘাতকরা কে ছিল নাদিম? তোমরা তো তখন পাকিস্তান থেকে আলাদা একটি রাষ্ট্র ছিলে। তাহলে শেখ মুজিবর রহমান ও তার পরিবারকে খুন করলো কারা?

আমি বললাম, আমরা বাঙালিরা। আমাদের সেই ‘পাকিস্তানের টর্চলাইট দ্রুতি ছড়ানো ‘বাঙালিরা ঘাতকরা। যারা একাত্তরে পরাজিত হয়েছিল, তারা স্বাধীনতার স্থপতিকে হত্যা করে ‘বাংলাদেশকে পাকিস্তানে ইউটার্ন করতে চেয়েছিল।

এরপর ওরা বললো, শেম নাদিম। তোমরা তোমাদের ‘কারিগর’কে মূল্য দিতে জানো না। তোমরা বড়ই ‘খারাপ’। তোমরা স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে শিখনি। যার জন্য স্বাধীনতা পেলা, তাকেই তোমরা হত্যা করলা? এ কেমন তোমাদের দেশপ্রেম? তোমাদের পদে পদে বিশ্বাস ঘাতকতা তোমাদের মেলে ধরতে দেয়নি। We salute your grate leader.

আজ অনেকদিন পর এই কথাগুলো মনে পড়লো। এই দেশ বার বার শত্রুতের হাতে গিয়েছে কেবল মাত্র স্বীয় বাঙালিদের কারণে। ১৭৫৭ সালে মীরজাফররা যখন সিরাজদ্দৌলাকে খুন করে ইংরেজদের মসনদে বসিয়ে ছিল, সেটা কিন্তু বাঙালিদের ফসল। পঁচাত্তরের কোন পাকিস্তানি বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে আসেনি। আমাদের এই বাঙালি রক্ত কিন্তু তাকে হত্যা করে ক্ষমতার মসনদে তাদেরই অনুসারীদের নিয়ে এসেছিল।

আমাদের রক্তে মিশে থাকা বিশ্বাস ঘাতকতায় জাতির পিতাকে হারিয়েও এইদেশ ‘আনন্দভোগ’ করতে ভুলে যায়নি। এরা শোকে আনন্দ পায় আর হেরে গেলেও আনন্দ পায়। আমার রক্তের ‘ঘাতকতা’ কবে পরিশুদ্ধ হবে হে ‘পাঞ্জেরী’? এতো পথ পাড়ি দিয়েও কেন জানি বিশ্বাস ঘাতকতার উটকট গন্ধ মোহ মোহ করে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার স্থপতিকে যখন হত্যা করতে পারে, তখন বাংলাদেশের স্বপ্নকে নিয়ে লুকোচুরি করতে তাদের বাঁধা কিসের?

বাংলার আকাশে এই দিনটি যেন আর কালো হয়ে না আসুক এই আশা করি। শোকে কাতর জাতি ‘শোকের’ অর্থদ্ধারে সোচ্চার থাকুক।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক।

Print Friendly, PDF & Email