May 14, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

বিভাজনের মাঝে ঐক্যের খোঁজে

মাসকাওয়াথ আহসান : সমাজ-মনোজগতের সংকটটিকে বুঝতে প্রাথমিকভাবে কিছু বই-পুস্তক পড়ে অতটা বুঝতে পারিনি। মনে হলো সমাজটাকে এবং মানুষের মনকে একেক কৌণিক বিন্দু থেকে জানা হচ্ছে না; সামগ্রিক দৃশ্যপট দেখতে পাবার ভ্যান্টেজ পয়েন্টটি খুঁজে পাচ্ছিনা।

বাস্তব জীবনের মানুষের মন ও সমাজকে পড়তে শুরু করলাম। সবাইকে বেশ সুস্থ স্বাভাবিক মনে হলো। কারণ সাধারণ শিক্ষা-ইংলিশ মিডিয়াম-মাদ্রাসা যে শিক্ষাব্যবস্থা থেকেই তারা আসুক না কেন; খুব সম্ভব কার্টেসি বজায় রাখতে সবাই খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে। সাধারণ শিক্ষার মানুষের সাধারণ পোষাক ও ভাষারীতি, ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার মানুষের পোষাকে পাশ্চাত্যের প্রভাব আর ভাষারীতিতে ইংরেজি শব্দের বেশী ব্যবহার, মাদ্রাসা শিক্ষা থেকে আসা মানুষের পোষাকে সৌদী প্রভাব আর ভাষারীতিতে আরবী শব্দের ব্যবহার; বহিরাঙ্গের এই পার্থক্য ছাড়া আর কোন পার্থক্য বোঝা যায়নি। তাদের মনের ঢাকনাটা খোলা সম্ভব হচ্ছিলো না। প্রত্যেকের সামনে প্রত্যেকের অপছন্দনীয় ধাঁচের কথা বলে কাউকে চটাতে পারিনি। এমনকি বামপন্থীর সামনে ডানপন্থী, ডানপন্থীর সামনে বামপন্থী, মধ্যপন্থীদের সামনে কখনো ডান কখনো বাম কথা বলে দেখা গেলো কাজ হচ্ছেনা। মনের ঢাকনা কেউ খুলছে না। কারো সঙ্গে ঝগড়া বা তিক্ততা হচ্ছে না। ফলে সমাজের অন্ধকার জায়গাগুলো ঠিক খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

ভার্চুয়াল মাধ্যম এসে সে সুযোগ অবারিত করে দিলো। কারণ বাস্তবের যে মানুষ সে আমাকে দেখতে পাচ্ছে। আমাকে সামনা-সামনি দেখলে কেউ তার মনের ঢাকনা খুলবে না এটা নানারকম সমাজে মিশে দেখেছি। কিন্তু অদেখার সুবিধা হচ্ছে যার সঙ্গে কথা বলছি সেই অদেখা মানুষটি খুব সহজেই তার মনের ঢাকনাটি খুলে ফেলতে পারে। সেই সুযোগ নিয়ে ভ্যান্টেজপয়েন্ট থেকে সামগ্রিক সমাজকে এবং এর অন্ধকার কৌণিক বিন্দুগুলোকে দেখা সহজ হয়েছে।

এইখানে একই কাজ অর্থাৎ সাধারণ শিক্ষার মানুষের সামনে ইংলিশ মিডিয়ামের, ইংলিশ মিডিয়ামের সামনে সাধারণ বা মাদ্রাসা, মাদ্রাসা শিক্ষার মানুষের সামনে সাধারণ বা ইংলিশ মিডিয়াম টাইপের কথা বললেই কিছু প্রতিক্রিয়া তিক্ত হতে শুরু করে। এইভাবে আওয়ামী লীগের লোকের সামনে বিএনপি মার্কা কথা, বামের সামনে ডানমার্কা কথা, বিএনপির সামনে আওয়ামী লীগের মত বা বামমার্কা; অর্থাৎ যে যে মত ও পথের অনুসারী তার বিপরীত কথা বললেই তিক্ত প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। তবে সে তিক্ততা প্রকাশে ভাষা এবং ক্রোধের তাপমাত্রা একই। অর্থাৎ একটি মতের মানুষ আরেকটি মতের মানুষকে বিন্দুমাত্র স্পেস দিতে রাজি নয়। তার মতটিই ধ্রুব সত্য বাকী সব ভুল এ হচ্ছে গড়পড়তা মানুষের মনোজগত। ব্যতিক্রমী মানুষ পাওয়া যায় যারা বিরলপ্রজাতি; সুন্দরবনের বাঘের মতই এদের সংখ্যাও কমছে।

সেখান থেকে এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় কোন শিক্ষা-মাধ্যম বা রাজনৈতিক মতাদর্শ আজকের এই সাংঘর্ষিক সমাজ তৈরীর পিছে কোন ভূমিকা রাখেনি। সেভেন ডেডলি সিনস-ষড় রিপুর তাড়না-কাম,ক্রোধ, লোভ, ঈর্ষা, মোহ, মাতসর্য্য; মানব মনের এই যে দুর্বলতার জায়গাগুলো সেখান থেকেই তৈরী হয়েছে হিংস্র সমাজ-মনোজগত। পরমতসহিষ্ণুতা, মুক্তভাবনা, অন্যের ভাবনাকে স্পেস বা জায়গা দেয়া, ভিন্নমতে সহমত পোষণের “উই মে এগ্রি টু ডিসএগ্রি” এই সভ্যতার সোনালী সূত্রটি সমাজ ও জীবন-চর্যা থেকে হারিয়ে যাওয়ায় মানব বৈশিষ্ট্য প্রায় লুপ্ত হতে চলেছে। সমাজ ফিরে গেছে আদিম নরমাংসভোজি অন্ধকার চিন্তার বলয়ে। ফলে রবীন্দ্রসংগীত বাজিয়ে পেলব কথাই বলুক, হামত-নাত বাজিয়ে হাত টিপে টিপে বেহেশতের দাওয়াত দিক বা বেতোফেন বাজিয়ে রেনেসাঁর গল্প করুক; মানুষটির চিন্তার বিপরীতে কথা বললেই সে হিংস্র কুকুরের মতো খেঁকিয়ে ওঠে; পরমতসহিষ্ণুতা না থাকলে যেহেতু পূর্ণ মানুষ হয়না; তাই বিপুল সংখ্যক উপমানবের মাঝে আমাদের বসবাস। তাই আজ আর বলে কী লাভ আছে মানুষই সৃষ্টির সেরা জীব। তবুও আশা ছাড়িনা। সামষ্টিক মানসচক্ষু উন্মীলনের প্রত্যাশা বুকে চেপে রাখি।

“সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই”।

এখন বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিক সংকটের জায়গাটি হচ্ছে; একটি বড় সমাজ-মনোজাগতিক সমস্যার বিবরণ দিয়ে কোন সমাধানের পরামর্শ না দিয়ে “ঐ তো ওখানে আলো” বলে কথা শেষ করে কিছু হাততালি-আহাউহু-ইদানীং লাইক নিয়ে “পদক” জোগাড়ের তৈলব্রতে চলে যাওয়া। ফলে কোন সংকট সমাধানের মুখ দেখেনা। সমাজ এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে “ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যানস” খেলতে থাকে অবিরত।

সমাজের এবং সভ্যতার নিশ্চিত নিমজ্জন ঠেকাতে আমাদের এখনই সক্রিয় হতে হবে। যারা সচেতন মানুষ তাদের প্রত্যেককেই এ সমাজের দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের প্রত্যেককেই এসমাজে পরমতসহিষ্ণুতা এবং স্থিতিস্থাপকতা (ইলাসটিসিটি) বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে কাজ করতে হবে। যারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান তারাই কেবল শিক্ষক নন। সমাজের প্রতিটি স্থিত ও স্বাভাবিক চিন্তার মানুষই শিক্ষক-একই সঙ্গে ছাত্র। আমরা জীবনের প্রতি পদক্ষেপে কখনো শিখি; কখনোই শেখাই।

বাংলা-ইংলিশ-আরবী মিডিয়াম প্রতিটি শিক্ষা ব্যবস্থাতেই সংস্কারের সমান প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিটি শিক্ষা-ব্যবস্থাই ক্রুটিপূর্ণ। যেসব শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ মানুষ তৈরী করতে পারেনি; তারা সবাই ব্যর্থ হয়েছে এতো স্পষ্ট।
জীবনের মূল শিক্ষাই তো মানবিক বোধ অর্জনের জন্য। অযথা কিছু থিওরি-কিছু ইংলিশ ট্রেন্ডি এক্সপ্রেশান বা কিছু সুরা মুখস্ত করলেই কী সেটা শিক্ষা হয়! অযথা কয়েকটা সার্টিফিকেট জোগাড় করে মানুষ সেজে ঘুরলেই কী সেটা শিক্ষিত সমাজ হয় নাকি!

সমাজ-সভ্যতার মূল শিক্ষা মানবতার সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত সাম্যভাবনা; প্রতিটি মানুষকে সমান ভাবতে শেখাতে না পারলে বিদ্যালয়-পরিবার-সমাজ অবশেষে রাষ্ট্র; প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই ব্যর্থ হতে বাধ্য। চিন্তা, সামাজিক অবস্থান, জীবনচর্যাকে পারস্পরিক সম্মান বোধের মাঝ দিয়ে উদযাপন না করতে শিখলে সে শিক্ষা সম্পূর্ণ হয়না; ফলে মানুষের আসলে মানুষই হয়ে ওঠা অসম্ভব হয়ে পড়ে।

Print Friendly, PDF & Email