May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

দীক্ষার প্রয়োজনীয়তা

মঞ্জুরি দত্ত : পৃথিবীতে আশ্চর্য্য যা কিছু আছে, তার মধ্যে সব থেকে আশ্চর্য্যের বিষয় হল ঈশ্বরের নরলীলা। জগতের সবকিছুই ধরা যায়, মাপা যায়, বোধে আনা যায়, অন্ততঃ অনুমানও করা যায়। কিন্তু এ বিচিত্র ঐশী লীলা সর্ব্বপ্রকার ধারণা বোধ ও অনুমানের পারে, সমস্ত রকম বিরুদ্ধতার এক অদৃষ্টপূর্ব অথচ চমৎকার অর্থকর সমন্বয়।
ঠাকুর আমার! তোমার কথা যা লিখে শেষ করা যায় না, ভেবেও যার কূল পাই না, তারই কিছু যা আমার জীবনে অকাট্য সত্য হয়ে আছে নিগুড় নিবিড় সার্থকতায়, যা আমার ইহজন্মের ও জন্ম-জন্মান্তরের জীবন পথের পরম পাথেয় আমার সাধ্যমত একত্র সংগ্রহ করে তোমাকেই অঞ্জলি দিলাম।

আমার বাবা শ্রীযুক্ত খগেন্দ্র চন্দ্র দত্ত, জন্ম হয় ১৩৫০ সালে ময়মনসিংহ জেলার পাইকুড়া গ্রামে। জমিদার বাড়ির বাবা হলেন ছোট ছেলে। ছোটবেলাই বাবা নিজের বাবা-মাকে হারান। তাই স্বাভাবিকভাবে জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। মামার বাড়িতে থেকে অনেক কষ্টে পড়া শেষ করেন। পড়াশোনায় ভালই ছিলেন। হঠাৎ একদিন গভীর রাতে পরম দয়াল শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রকে স্বপ্নে দেখলেন। তিনি বলছেন, ‘তাড়াতাড়ি আমার দীক্ষা নে।’
আমার বাবার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর থেকে বাবার আর মাছ-মাংস খেতে ভাল লাগত না। তিনি লুকিয়ে ফেলে দিতেন। যার মাছ-মাংস খাওয়া ঘরে জন্ম, কি আশ্চর্য্য এই অদ্ভুত পরিবর্তন তিনি তা নিজেই ভালভাবে বুঝে উঠতে পারছেন না। তারপর বেশ কয়েকদিন পরে, এক পাল দোকানে ঠাকুরের ছবি দেখতে পেয়ে বাবা দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করলেন, উনি কে? কোথায় থাকেন? তখন লোকটা বললেন, তিনিতো দয়ালু ঠাকুর।

ঠাকুরের দয়ার কথা লিখে শেষ করা যায় না। তিনি পরম করুণাময় দীনদয়াল। দুনিয়ার মানবের জন্য যে বিধিবিধান শ্রীশ্রীঠাকুর দান করেছেন তার প্রথম বিষয় হল মানুষকে সৎনামে দীক্ষিত করে তোলা। তিনি দেখেছেন, সমগ্র জাতিকে ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিমান করে গড়ে তুলতে হলে মানুষগুলির বৈশিষ্ট্যাবলী অপূরয়মান আদর্শের ছায়াতলে সমবেত হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
দীক্ষার ভিতর দিয়েই আসে ইষ্টপুরুষের প্রতি অনুরাগ ও ভালবাসা, আর ভালবাসা প্রিয়কে সবসময় সুস্থ ও আনন্দিত রাখতে চায়। এইভাবেই জীবনটা এককেন্দ্রিক হয়ে ওঠে। প্রবৃত্তিগুলি আপনা থেকেই কল্যাণের পথে সুকেন্দ্রিক হতে থাকে। ভক্তপ্রবর হনুমানের অসীম শক্তি। কিন্তু তিনি তা নিজ স্বার্থে ব্যবহার করেননি, করলেন তাঁর প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের রক্ষায়, রাবনের বংশ ধ্বংস করার কাজে।

সৎদীক্ষা এইভাবে প্রবৃত্তিগুলোকে সুবিনায়িত করে তোলে। প্রবৃত্তিগুলি যদি সুনিয়ন্ত্রিত না হয় তা’হলে চরিত্র হয়- ঠাকুরের ভাষায় কতগুলি কেউটে সাপের আস্তানা কখন যে বিষাক্ত ছোবল মেরে জনজীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে তার ঠিক নেই। কিছু মানুষ কোন এক বিশেষ মতের সমর্থনে একটা দল বাধতে পারে। কিন্তু তার ভিতর দিয়ে প্রবৃত্তি নিয়ন্ত্রণের কোন চেষ্টা না থাকার দরুণ এ দলের মধ্যে অচিরেই বিভেদের বীজ দেখা দেয়। মানুষ পারস্পরিকতা বোধ হারিয়ে ফেলে। ফলে সংহতি ও একতার ধ্বনি লুণ্ঠিত হয়।

প্রবৃত্তিগুলো যদি সুনিয়ন্ত্রিত হয়, মানুষ যখন প্রবৃত্তির দাসত্ব থেকে মুক্তি লাভ করে তখনই মানুষ শাস্তি ও স্বস্তি ভোগ করতে পারে, জীবনে প্রকৃত স্বাধীনতা সুখবার্তা খুঁজে পায়। এ জন্য চাই ঈশ্বরাভিমূখীতা। তাই, মানুষের জন্য প্রয়োজন হয় মানুষ ঈশ্বর, আচার্য্য, সদ্গুরু। তাঁর অসীম প্রেমের আকর্ষণে তিনি সবাইকে কাছে টানেন, বুকে তুলে নিতে চান প্রতি-প্রত্যেকটি জীবনকে তিনি আগলে ধরে রাখেন তাঁর নিজ হাতে। আর তারই মাধ্যম হল দীক্ষা।

দীক্ষা ইষ্টপুরুষের সঙ্গে যোগ সাধন করে, তাঁর প্রীতির জন্য কর্ম করতে করতে তার উপর টান জন্মায়। চিত্ত একমুখী হয়, আসে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রেরণা। বৃহৎ জনগোষ্ঠী যখন এইভাবে কেন্দ্রায়িত হয়ে এক স্বার্থে অন্বিত হয়ে চলে, তখনই আবির্ভূত হয় সংহতি। আর এককেন্দ্রিক সংহত জীবনই শক্তির উৎস।

সেদিনের কথা আজও আমি ভুলতে পারি না। আমার বড় ভাই সবে কলেজে উঠেছে, নামকরা কলেজ। শিলচরের ডিসি কলেজ। আমার দাদা মনি ওরা কলেজ থেকে Picnic-এ যাবে, সবাই গেছে Picnic-এ। হঠাৎ ১২টা নাগাদ চিৎকার শুনলাম, আমার দাদামনির সাথে পাশের গলির আরেক ছেলে যার নাম রাজন ভট্টাচার্য্য, বিল্টু ওরাও গেছে। রাজন দা’র বোন চিৎকার করে কাঁদছে, কী হল? আমার ভাই ওরা যে গাড়িতে গেছে সেইটা নাকি ভয়ংকরভাবে accident হয়ে অনেক নীচে পড়ে গেছে। যারা বেঁচে গেছে, ওদের হাড় ভেঙ্গে গুঁড়ো। আমি শুনে পাগল পাগল হয়ে দৌড়ে গেলাম খবর নিতে। রাজন দার বাবা দৌড়ে গেলেন খবর নিতে সত্যি কিনা তা জানতে। জেনে আসলেন সত্যিই ওরা সবাই statistics department  থেকেই গেছে, সেটা Accident হয়েছে মালিডোরের সামনে। শুনে আমার দিদা বিছানায় ছিলেন নামতে পারেন না, যেহেতু বয়স হয়েছিল। উনিও বিছানা থেকে নেমে ঠাকুর ঘরে আমার সাথে জোরে জোরে কাঁদছিলেন ভাইয়ের প্রাণ ভিক্ষার জন্য। আমিতো ছোট ছিলাম, তবে আমার ঠাকুরের উপর খুব বিশ্বাস ছিল। পূজ্যপাদ বড়দা আমার দাদামনিকে ‘দীর্ঘায়ু হও’ বলে আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। তাই একটু ব্যাথা পেতে পারে, তবে ওর কিছুই হবে না ভেবে দিদার উপর রাগ হচ্ছিল, ওরা কেন ওমনভাবে কাঁদছে। আমার কাছে মাত্র ১১ টাকা ছিল, তা ঠাকুরের চরণে রেখে ঠাকুরের নাম করতে থাকি কারও সাথে কোনও কথা না বলে। এভাবে নাম করতে করতে হঠাৎ আমার দাদার গলায় শুনতে পেলাম, ‘মা’ বলে ডাকছে। দাদা ঘরে এসেছে সুস্থাবস্থায়। তার দয়ায় সব সম্ভব। কোনও চিন্তা নেই, আমাদের যারা জীবনে ঠাকুর পেয়েছি। দাদাকে যেন ঠাকুরই এ বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছেন, দয়াল দয়া করে। একসিডেন্ট হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে, সবাই যে গাড়িতে আনন্দ গান করছিল দাদার কি হল, ভালো লাগছিল না, সে নেমে গেল  ওর বন্ধুকে নিয়ে। ঠাকুর সবাইকেই বাঁচাতে এসেছেন। আর সেজন্য তাঁর সাথে সৎনামে যুক্ত হতে হয়। নাহলে তাঁর প্রেমময় ডাক শুনতে পাওয়া যায় না।

সেদিন, ঠাকুরের দয়ায়ই আমরা আমাদের ঘরের প্রদীপকে ফিরে পেয়েছিলাম। ঠাকুর আমাদের মত সবাইকে বাঁচাতে চান, তাই ঘরে ঘরে তাঁর সেই বীজমন্ত্র বা সঞ্জীবনী মন্ত্র বিলাতে এসেছেন । সেই সৎনামে মাতালও ভাল কথা বলা শিখে যায়, যে খারাপ সে কখন যে ভাল হয়ে যায়, সেটা কেউই জানে না। আর যারা ভালো, তারা দেবতায় পরিণত হয়ে যায়।

 এই বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে স্বর্গরাজ্য স্থাপন করতেই এসেছেন তিনি। তাঁকে ভালবেসে আমরা সবাই সুস্থ, সুন্দর জীবনের অধিকারী হই আর বাকী সবাইকেই প্রভুর সাথে যুক্ত করি। তাইতো দয়াল বলেছেন-
‘অন্যে বাঁচায় নিজে থাকে
ধর্ম বলে জানিস তাকে।’

শুধু নিজে ভাল থাকলে হবে না, সবাইকে সেই ভাল থাকার পথ দেখিয়ে দিতে হবে। তবেই শুধুমাত্র পৃথিবী সুন্দর হবে, শস্য-শ্যামলা হয়ে উঠবে ধরণী। গাছে গাছে ফুল, পাখির সুন্দর কণ্ঠে গান করবে। বন্দনা করবে তাঁরই। প্রাণে প্রাণে নবজাগরণের সঞ্চার হবে। তাঁর রাতুল চরণে সবাই আশ্রিত হয়ে এই ধরা আবার সুন্দর হয়ে উঠবে। সব জড়াদ্বন্দ্ব বিনাশ করে প্রেমের ডোরে সবাইকে একই মালায় গেঁথেছেন পরম দয়াল।
তাই গেয়েছেন-
‘সুন্দর দেখিয়া সুন্দর ইহা
সুন্দর করিব সার।’

লেখক:
মঞ্জুরি দত্ত (আগরতলা, ভারত)

Print Friendly, PDF & Email