May 16, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

জানতে হবে ধর্ম কি, ধর্ম কি চায়

“ধর্মে সবাই বাঁচে বাড়ে

সম্প্রদায়টা ধর্ম নারে”

শ্রী শ্রী ঠাকুর অনুকুলচন্দ্র

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ তথা সারা বিশ্বেই এর বিরূপ প্রভাব সাধারণ মানুষের মনে ভয়-ভীতি এবং বেদনার মূর্ত প্রতীক হয়ে ভর করেছে। বর্তমান সময়ে এটি এতটাই প্রকট হয়েছে যে, যে সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা কম, তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়েও নিজের দেশে অনিরাপদবোধ করছেন। সাম্প্রদায়িকতার নামে হুমকি, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে আক্রমন, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বাধা দেওয়া থেকে শুরু করে জখম, হত্যা, ধর্ষণের মত জঘন্যতম অপরাধও ঘটছে। কিন্তু কেন এই সঙ্ঘাত ? সত্যিই কি এক সম্প্রদায় তথা এক ধর্মের সাথে অন্য ধর্মের এতটাই বিরোধ ? তা বুঝতে হলে প্রথমেই আমাদের জানতে হবে ধর্ম কি, ধর্ম কি চায়। প্রথমেই বর্ণীত পুরুষোত্তম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের বানীটি থেকেই ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। শ্রীশ্রীঠাকুর আরও বললেন,

“অনে বাঁচায় নিজে থাকে

ধর্ম বলে জানিস তাকে”

অর্থাৎ, যা পরিপালনের মাধ্যমে আমরা আমাদের সত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি এবং একই সাথে আশেপাশের মানুষের জীবনও উন্নততরও করে তুলতে পারি তাই হচ্ছে ধর্ম। একজন মানুষ ধর্মীয় অনুশাসন পালনের মাধ্যমে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে। প্রত্যেকটি ধর্মই এই শিক্ষা দেয়। বিভিন্ন যুগে, বিভিন্ন স্থানে সময়ের প্রয়োজনে হয়ত বিভিন্ন ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে তাই দেশ- কাল-পাত্র ভেদে কিছু বিশেষ বিশেষ বিধান রয়েছে কিন্তু মূল কথা এবং লক্ষ্য একই। শ্রীশ্রীঠাকুরের ভাষায় , “সবটার (সকল ধর্মের) মূল লক্ষ্য ঈশ্বরমুখী জীবনবৃদ্ধি।” একবার এক মুসলমান ভদ্রলোক (হক সাহেব) ধর্মের পার্থক্য বিষয়ে প্রশ্ন করলে শ্রীশ্রীঠাকুর উত্তর দিয়েছিলেন, “ইসলাম শব্দের মানে আমি শুনেছি খোদায় আত্মনিবেদন বা শান্তি। সব ধর্মেরই তো মূলকথা এই। ……আর কলেমা, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত-এই পাঁচটি অনুষ্ঠান শুনেছি মুসলমানদের অবশ্য করণীয়। প্রত্যেক শাস্ত্রেই তো এই বিধান আছে, তবে হয়ত ভিন্ন ভাষায়, ভিন্ন নামে হয়ত। কলেমা মানে আমি বুঝি-খোদাতালায় বিশ্বাস রেখে, প্রেরিতপুরুষকে স্বীকার করে তার অনুশাসণ মেনে চলা। এই বিশ্বাস, স্বীকৃতি ও অনুসরণ ধর্মের প্রথম ভিত্তি। হিন্দুদের মধ্যে আছে যুগ-পুরুষোত্তম বা সদ্গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে তার অনুশাসণ মেনে চলার কথা। খ্রিষ্টানদের মধ্যেও আছে baptism-এর (অভিষেকের) প্রথা। বৌদ্ধরাও আনুষ্ঠানিকভাবে ত্রিশণমন্ত্র গ্রহন করে থাকে বলে শুনেছি। এই স্বীকৃতি, এই শ্রেষ্ঠ পুরুষ কে আপন করে নেওয়ার মধ্য দিয়েই তার অনুবর্ত্তনে চলার পক্ষে সুবিধা হয়। আর, নামাজ মানে সন্ধ্যা, বন্দনা, প্রার্থনা। মানুষ ইষ্টের স্মরণ-মনন জপ করে, তত তার মন পবিত্র হয়ে ওঠে, প্রবৃত্তিগুলিকে সুনিন্ত্রিত করার কায়দা পায়, আত্মবিশ্লেশণ ও আত্মসমীক্ষণে পটু হয়। ……তাই এ নির্দেশও সর্বত্র আছে। আর, রোজা মানে ইষ্টচিন্তাপরায়ণ হয়ে সুনিয়ন্ত্রিত উপবাস। এতে শরীর মনের অনেক গলদ বেরিয়ে  যায়। তাই এও সবারই করনীয়-যে যে পথেই চলুক। হজ মানে তীর্থযাত্রা। ভাবাসিক্ত হয়ে তীর্থ দর্শন করলে আমরা সাধুমহাপুরুষদের ভাবে অনুপ্রানিত ও অভিষিক্ত হয়ে উঠি। এ বিধানও সবার মধ্যে আছে। আর, জাকাত মানে ধম্মার্র্থে দান, ইষ্টার্থে উৎসর্গ। এই বাস্তব করণের ভিতর দিয়ে ইষ্টের প্রতি আমাদের অনুরাগ বাড়ে। ………। তাহলে দেখুন মূল বিষয়গুলো সর্বত্র সমান কিনা।” (আলোচনা প্রসঙ্গে, ১ম খন্ড)।

তাই বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে মৌলিক বিষয়গুলোর মধ্যে পার্থক্য নেই। প্রত্যেকটি ধর্মই ইশ্বর প্রাপ্তির কথা বলে, বলে জীবন বৃদ্ধির কথা, শান্তির কথা। কিন্তু এই মৌলিক বিষয়গুলো ভালভাবে জানার চেষ্টা না করেই আমরা দ্বন্ধে লিপ্ত হচ্ছি।  তাই প্রথমেই আমাদের গোঁড়ায় হাত দিতে হবে। ধর্ম সম্পর্কে সঠিকভাবে জানতে হবে, সবাইকে জানাতে হবে এবং পরিপালন করতে হবে। শ্রীশ্রীঠাকুরও বিশেষ করে বলেছেন ধর্মের প্রকৃত রূপটি সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরার জন্য যেন কারো মনে কোন বিভ্রান্তি না থাকে। প্রত্যেক মানুষেরই নিজ ধর্মের পাশাপাশি অন্য ধর্ম সম্পর্কে জানতে হবে এবং তা অবশ্যই শুদ্ধ উপায়ে। তিনি নির্দেশ দিয়েছেন একজন হিন্দু যেমন গীতা পরবে, তেমনই কোরআন, বাইবেলও পড়বে। একই ভাবে মুসলমান, খ্রিস্টানরাও অন্য ধর্মগ্রন্থগুলো পড়বে। এতে করে ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো আরও সহজ হয়ে উঠবে। শ্রী শ্রী ঠাকুর বিশেষ করে বলেছেন  ধর্মের মধ্যে বিভেদ না করার কথা। প্রত্যেক ধর্মকে সমান চোখে দেখার কথা। তাহলে আমাদের মধ্যে আর বিদ্বেষ ভাব আসবে না। তিনি ‘সত্যানুসরণ’ গ্রন্থে বলেছেন,

“ যার-উপর যা’-কিছু-সব দাঁড়িয়ে আছে তাই ধর্ম, আর তিনিই পরমপুরুষ।

ধর্ম কখনও বহু হয় না, ধর্ম একই আর তার কোন প্রকার নেই।

লেখকঃ বঙ্কিম পাল ধ্রুব

Print Friendly, PDF & Email