April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

ঋত্বিক সম্মেলনে পূজনীয় বাবাইবাবু

আমরা সংসারী জীব । সংসারে বাস করি । এজন্য সংসারের উপর টান হয় । বাবা , মা , ভাই , বোন , বিয়ের পর স্ত্রী , পুত্র , কন্যা , নাতি , নাতনি —- সকলের সাথে যুক্ত হই । জীবনের ক্রমবিকাশের সাথে সাথে কেউ শিক্ষক , কেউ সখা , কেউ বন্ধু হয়ে থাকে । সংসারে নানান সম্পর্কের বন্ধনে বাঁধা পড়ি । এই বন্ধনে থেকেই এক আবরণ সৃষ্টি হয় । সংসারে যত জড়িয়ে থাকি এই বন্ধনের প্রতি আসক্তিও বাড়তে থাকে । বন্ধনের এই আসক্তি থেকে বেরোতে পারি না । রেশমের কীট যেমন গুটির মধ্যে এমন আবদ্ধ হয়ে পড়ে তা থেকে বেরোতে পারে না । গুটির মধ্যেই মৃত্যু হয় । আমরাও সংসারে থাকতে-থাকতে এতই সমাহিত হয়ে পড়ি যে বাইরে তাকাতে পারি না । ভাবতে পারি না এর বাইরে কিছু আছে । নিঃশাস যখন বন্ধ হতে থাকে তখন কেউ একটা ছোট ছিদ্র করে দিল । আলোর রেখা দেখা গেল । আশার কিরণ পাওয়া গেল । এই হ’ল গুরুর পথ । যিনি মায়ার বন্ধন থেকে মুক্তির পথ দেখিয়ে দিতে পারেন ।

আশার কিরণ আসে যাজনের মাধ্যমে । প্রত্যেক ব্যক্তি যেখানেই থাকি না কেন , যাদের নিয়ে ভাল থাকতে চাই , তাদের জন্য আরও কিছু পেতে চাই যা দিয়ে পরিবারের সকলে ভাল থাকতে পারে । যাজনের মাধ্যমে তার সন্ধান আমার কাছে এসে পৌঁছায় । তা যদি অমৃত হয়ে থাকে , ক্রমে স্বাদ পেতে থাকি ; আগে যা ভাল ছিল আমার কাছে তা গৌণ হয়ে যায় । নুতন চাহিদা মুখ্য হয়ে যায় । অনেক সময় যে পথে চললে অমৃতময় পথ লাভ করতে পারতাম তাকে ত্যাগ করে অন্য কিছু আয়ত্ত করার চেষ্টা করি । সেই পথ ধরেই দুঃখ ঘিরে ধরে । বালীকে মুঠোর মধ্যে ধরলে , যত জোরেই ধরি-না-কেন সমস্ত বালি ঝরে যাবে —– একটাও থাকবে না । সংসারও এইরকম । যত তাকে আঁকড়ে ধরি ততই তা সরে যায় । মুঠোর মধ্যে কিছুই রাখতে পারি না ।

সাধারণত , ৫০/৬০ বা ৭০ বছর বয়স পর্যন্ত আমাদের জীবনকাল । সম্পর্ক শুরু বাবা-মাকে কেন্দ্র করে । পরবর্তী পর্যায়ে স্ত্রী ও পুত্র কন্যাগণ আসে । স্ত্রী আমার শৈশবে ছিল না । স্ত্রী আসার পর সন্তানরা আসে । স্ত্রী কিন্তু জীবনের প্রথমদিকে ছিল না । প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত না থাকলেও সে-ই আমার প্রিয় হয়ে উঠে । প্রথমদিকে না থাকলেও তাকেই প্রিয় করে তুলছি ।

আসলে প্রিয় কে হতে পারেন ? যিনি শুরুতেও আছেন , শেষেও আছেন এবং যার রূপ উভয়ক্ষেত্রেই একইরকম । যেমন , উদয়কালে সূর্যের রূপ থাকে রক্তিম লালবর্ণ । অস্ত যাওয়ার সময়ও একই বর্ণ । আমাদের জীবনে ভগবানও তদ্রুপ । প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একইভাবে বিরাজ করেন । একজন দক্ষ পাচককে রান্নার সামগ্রী দিলে উত্তম রান্না করতে পারেন । কিন্তু যে পাচক নয় তার হাতে পড়লে রান্না বিস্বাদ হয়ে পড়ে । সেজন্য যিনি জানেন তাঁরই অনুসরণ করা সমীচীন ।

আমাদের সুবিধা এই যে গুরু স্বয়ং আমাদের সাথে । আমি অর্জুনই হই বা অন্য কেউ হই গুরু তো রথ চালনা করছেন । ঐ রথে যেদিকেই যাই না কেন আমরা তো অমৃত-পথ-যাত্রী । হয়ত আমি অর্জুনের মত ধনুর্ধর নই । কিন্তু রথ চালনা করছেন স্বয়ং ভগবান । তাতে সওয়ার হতে পারলেই আমার লাভ । নিজের সামর্থ্যের কথা ভাবলে হিসাবে মিলবে না , অসুবিধার মধ্যে পড়ে যাব । আমার কথামত আমার পরিবারের লোকেরাও সর্বদা চলে না । স্ত্রী না শুনতেও পারে , পুত্রকন্যা না শুনতেও পারে । এজন্য আমার সামর্থ্য যে কত কম তা নিয়ে না যেন ভাবি । তিনি যা করতে আদেশ করছেন তা যেন করতে পারি ।

আমাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে যারা চলতেই থাকে , চলতেই থাকে । আমরা দাঁড়িয়ে থাকি , তারা দিগন্তে পৌঁছে যায় । দিগন্তে তারা পৌঁছে গেছে দেখে আমরা বলে থাকি সে আর লালন একখানে রয় । যে ব্যক্তি দিগন্তে পৌঁছে গেছে সে দেখে দিগন্ত আরও বহুদূর বলে , লক্ষ যোজন দূর । ঈশ্বর অবধি পৌঁছাতে এখনও লক্ষ যোজন ফাঁক ।

এজন্য আমরা অবিরাম এগোতেই থাকি । শ্রীরামচন্দ্র যখন সেতুবন্ধন করছিলেন , হনুমানেরা বড়-বড় প্রস্তর খণ্ড জলে ফেলছিল । কাঠবিড়ালী ছোট্ট প্রাণী । ভেজা গায়ে বালি মেখে সেতুবন্ধনে যোগ দিয়েছিল । ঐটুকুই তার সামর্থ্য । যার যা সামর্থ্য সে ততটাই করছে । গতকাল আচার্যদেব বলছিলেন এই কাজ প্রত্যেকেই করতে পারে । কাউকে তিনি অপা‌‌ঙক্তেয় রাখেন না । একটা দুষ্ট ছেলে , যাকে তার বাবা অকাজের মনে করত , তাই ভাবত বাড়ীর বাইরে যত থাকে তত বাড়ীতে শান্তি থাকবে । এক ঋত্বিক দাদা ঐ ছেলেকে নিয়ে যাজন কাজে বের হল । উৎসাহ দিয়ে তিনি বললেন —– এই ছেলেকে দিয়ে বহু কাজ হতে পারে । ছেলেটি প্রেরণা পেয়ে গেল । যাজন করে কয়েকদিনে সে দেড়শ লোককে দীক্ষা দেওয়াল । আমরা যারাই আছি মতভেদ না রেখে ঠাকুর যা বলেছেন তা-ই যদি পালন করতে পারি , আমাদের কাজের গতি আরও বেড়ে যাবে । নিত্যযাজী হতে হবে । শোনার লোক না পেয়ে একটা পানওয়ালাকেও যদি দয়াল ঠাকুরের কথা শোনাতে পারি তাহলে আমার যাজনের অভ্যাস অটুট থাকবে ।
সূত্র : সৎসঙ্গ , দেওঘর , আনন্দবাজার ভবনের ৪র্থ তল , ১লা জানুয়ারি ২০১৬।

Print Friendly, PDF & Email