May 16, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

পোস্টারের গল্প!

অনল রায়হান : পিকিউলিয়ার হলো, সাম্প্রদায়িক জংগীবাদের বিরুদ্ধে সরকারের সংশ্লিষ্ঠ মন্ত্রণালয়গুলোর কোনো লক্ষ্যযোগ্য প্রচার তো দেখছি না! শহরের রাস্তায় যা কিছু পোস্টার চোখে পড়ছে, সবই র‌্যাব এর। তথ্য-সংস্কৃতি-শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন প্রচার পত্র অন্তত আমার চোখে পড়েনি। যার যা কাজ তিনি যদি সেই কাজটি না করে অন্যের কাজ করতে যান, তাতে যা হয় আরকি! র‌্যাবের বেলায় তাই হয়েছে। যে সব পোস্টার দেখলাম, তার একটিও সামাজিক যোগাযোগ বা সোশ্যাল কমিউনিকেশনের তত্ত্ব মেনে তৈরী হয়নি। ফলে ফলাফলে ফল ধরেনি। সাধারন মানুষের মনে প্রচারপত্রগুলোর আবেদন পৌঁছেছে বলে আমার মনে হয় না। এর চেয়েও বড় ব্যাপার কোনো কোনো পোস্টার লোককে ভুল মেসেজ দিচ্ছে। আমি নিজে সোশ্যাল কমিউনিকেশেনে কাজ করেছি বেশ কয়েক বছর। সুতরাং অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, জংগীবাদের মত স্পর্শকাতর ও সময়ের সবচেয়ে জরুরী বিষয়টি নিয়ে কমিউনিকেশন মেটেরিয়াল তৈরীর আগে র‌্যাবের উচিত ছিল কমিউনিকেশন এক্সপার্টদের মত নেয়া। সেক্ষেত্রে যেটা হতো, এক্সপার্টরা সাম্প্রদায়িক জংগীবাদের বিরুদ্ধে সাধারন মানুষদের কি কি কথা বলা প্রয়োজন তার তালিকা প্রস্তুত করে সেখান থেকে কিছু কিংবা হয়ত একটি মাত্র কমিউনিকেশন মেসেজ ডেভেলপ করে ফেলতেন। যাকে যা বলা দরকার, তার জন্য নির্দিষ্ট সেই মেসেজ/বাণী/বা তথ্য। এক্ষেত্রে যার উদ্দেশ্যে (এক হাজার/এক লক্ষ/ বা এক কোটি) নির্দিষ্ট কথাটি বলা হবে, তার বা তাদের মনস্তত্ত্ব বুঝতে হবে। একজন ইউনিভার্সিটি শিক্ষক আর একজন ব্যাংকের অ্যাকাউন্টেন্ট এর সংগে যেমন একজন নগর শ্রমিকের সামাজিক-সাংস্কৃতিক পার্থক্য রয়েছে, ব্যাংকার আর শিক্ষকের মধ্যেও আছে। এই পার্থক্যটা কমিউনিকেশন এক্সপার্ট, মনস্তত্তবিদরা বুঝতে পারতেন। প্রয়োজনে একদিনের একটি মেসেজ ডেভলপমেন্ট ওয়ার্কশপ করে ফেলা যেত। শিক্ষক, লেখক, কমিউনিকেশন এক্সপার্ট, স্বরাষ্ট্র-তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, ধর্মীয় মৌলবাদ ও জংগীবাদী রাজনীতি নিয়ে নিয়মিত লেখেন এমন সাংবাদিক, ধর্মীয় নেতা, এনজিও কর্মী, বিদেশী দূতাবাসের প্রতিনিধি (ইউএসএ, জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি যারা টেররিজম নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন), ছাত্র, স্থানীয় কমিউনিটির সদস্য প্রমুখদের নিয়ে একটা ওয়ার্কশপ করা গেলে অনেক কার্যকরী সোশ্যাল মেসেজ উঠে আসতো। এর জন্য প্রচুর সময়ের দরকার হতো, তাও না। বিষয়টির আশু প্রয়োজনীয়তা দেশী বিদেশী সবাই বুঝতে পারতেন। সপ্তাহখানেকের নোটিসেই ওয়ার্কশপটা করে ফেলা যেত। কমিউনিকেশনের কথাগুলো পেয়ে যাওয়ার পর সোশ্যাল কমিউনিকেশনের এক্সপার্টরাই পোস্টারগুলোর (বা যাই হোক) ক্রিয়েটিভ ডিজাইন করে ফেলতো। এটা সবচেয়ে জরুরী অংশ। কি হবে পোস্টারের সাইজ? কেমন হবে এর কালার স্কিম? ছবি ব্যবহার হবে নাকি হবে না? কি ধরনের ছবি? নাকি ড্রইং/স্কেচেস? নাকি দুটোই? অক্ষর আর শব্দের সাইজ আর চেহারা কি হবে?… এই এতসব ঠিক করার জন্যও কিন্তু একটি চব্বিশ ঘন্টার ওভার টাইম কর্মদিবসই যথেষ্ট। এরপরে আছে আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। পোস্টারগুলির মার্কেটিং পলিসি ঠিক করা। আমার লেখায় যদি কারো মনে হয় বাড়াবাড়ি হচ্ছে, তাহলে বলবো, একবার ভেবে দেখুন, প্রতিদিন বাসা বাড়ি রাস্তা বাসে গাড়িতে এমনকি ঘুমানোর সময়ও কত রকমের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সিদ্ধান্ত আপনাকে নিতে হয়। পোস্টারগুলো কোথায় কোথায় সাঁটা হবে, পাশাপাশি কটা করে সাঁটা হবে এসবের পরেও ভাববার বিষয় আছে। পোস্টার এমন একটি কমিউনিকেশন টুল যার স্থায়িত্ব বড় জোর বাহাত্তর ঘন্টা। এরমধ্যে রোদে, বৃষ্টিতে, ধূলায়, অন্য নতুন পোস্টারের তলায় চাপা পড়ে এর দৃশ্যগ্রাহ্যতা শেষ হয়ে যায়। সুতরাং পোস্টারের মার্কেটিং স্ট্র্যাটিজি ঠিক করার সময় একাধিক ধাপে পোস্টার লাগানো হবে কিনা, কতদিন পর দিত্বীয়বার পোস্টারটি আবার লাগানো হবে কিংবা দিত্বীয়বার, তিন বা পাঁচদিনের গ্যাপে নতুন ডিজাইনের আরেকটি পোস্টার লাগানো হবে কিনা ইত্যাদি সিদ্ধান্তের গুরুত্ব অনেক।
একটি মাত্র পোস্টার। কিন্তু পোস্টারটি বলছে, সাম্প্রদায়িক জংগীবাদ, ধমার্ন্ধ মৌলবাদ, অবিদ্যা, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। বলছে, মানুষকে সচেতন হতে। সময়ের এই অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে কমিউনিকেশন করতে গিয়ে হেলাফেলা করা রাষ্ট্রিয় ভাবে একটি অনুচিত কাজ। এব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের যত্নবান হওয়া উচিত ছিল। উদাহরনস্বরুপ র‌্যাবের একটি পোস্টারের কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। প্রশংসাযোগ্য একটি কাজ করেও শেষ পর্যন্ত র‌্যাবের পোস্টারটি ভুল মেসেজ দিতে পারে বিশেষ করে তরুনদের। এবং সেই তরুনদের যাদের জংগীবাদে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বেশী। পোস্টারটির হেড লাইনে বলা হয়েছে,‘আমার সন্তান, আমার দেশ জংগীমুক্ত বাংলাদেশ’। মোট ছয়টি ছবি ব্যবহার করা হয়েছে এতে। এর মধ্যে ছয় নম্বর ছবিটি হলো গুলশান আক্রমনের কুশীলবদের ফটোগ্রাফ। বিখ্যাত ছবি। পাঁচ কসাই তরুন আইএসের কালো পোশাক পড়া এবং মাথায় আরবদের মত কাপড় পেঁচানো, অস্ত্র হাতে-কাঁধে, ক্যামেরায় রীতিমত হাস্যজ্জোল পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। গুলশানের হত্যাকান্ডের পরপর এই ছবিগুলিই আইএসের ওয়েব সাইটে আপলোড করা হয়। পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। র‌্যাব জংগীবাদের বিরুদ্ধে প্রচারে এই ছবিটি ব্যবহার করেছে কেন? এই তরুনদের কি আর কোন ছবি আমরা পত্রিকায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখিনি? ‘এদের মত হওয়া যাবে না’ এই যদি হয় তরুনদের প্রতি মেসেজ তাহলে এই নূরানী ছবি কেন? এই ছবি দেখে মনে হচ্ছে, যেন এরা পবিত্র কোনো যুদ্ধ করে এসেছে বা যাচ্ছে। ইনোসেন্ট, তরুন, স্বাস্থ্যবান পাঁচ জেহাদি তরুন। ব্যাপারটা অনেকটা যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ড কার্যকর হওয়ার রাতে জামাত নেতাদের নিয়ে টিভি চ্যানেলগুলোর নিউজ কভারেজের মত। সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ফাঁসি হওয়া অবধি যেন ‘এক নেতার ফাঁসি’ দেখছি টিভিতে। কটায় রাতের খাবার দেয়া হলো, কি দেয়া হলো, কখন গোসল করানো হলো, তওবা পড়ানো হলো, শেষ কথা কি বললেন, আত্বীয়রা দুই আঙুল তুললেন-ভুল বিচারের কথা বললেন, নিজামী-সালাউদ্দিন কাদেরদের ট্রাইবুনালে আসা যাওয়ার সময়কার হাস্যজ্জ্যোল ছবির কাটিং একের পর এক ইত্যাদি ইত্যাদি ক্লান্তিকর ভাবে চলতেই থাকে। আমরা প্রজন্ম ৭১ থেকে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের সন্তানরা অনেকবার টিভি চ্যানেলগুলোর কর্তা ব্যক্তিদের বলেছি, এই মানবতাবিরোধী আসামীদের ঘৃন্য অপরাধগুলো কেন আরও বেশি বেশি দেখান না? ৭১ এর আমার মা বাবা ভাই বোনের লাশের ছবির কি অভাব পড়েছে? নব্বুই দশকের প্রজন্মের কাছে ওই গণহত্যার বিভৎসতা তুলে ধরা না গেলে এরা তো উলটে ফাঁসির আসামীদের প্রতি করুনা দেখাতে শুরু করবে! এবং সেটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। আমরা কি গোলাম আজমের নূরানী চেহারা বারবার দেখবো? নাকি তার কৃত জঘন্য হত্যাকান্ডের ছবি হাজারবার দেখবো যেন এই জাতির আগামী প্রতিটি প্রজন্ম মনে রাখে কি নৃশংস ঘটনা ঘটেছিল এদেশের মাটিতে কয়েক কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের লড়াইয়ের বিরুদ্ধে।
মাননীয় র‌্যাব এই ধরনের ভুলটাই করেছেন।

লেখক : সদস্য, প্রজন্ম ৭১।

Print Friendly, PDF & Email