April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

লোকসান ১৬’শ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে রেলের

ডেস্ক প্রতিবেদন : আয়ের বহু পথ থাকলেও সেসব এড়িয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে নিজেই লোকসানের পথে হাঁটছে। লোকসান দেখিয়ে রক্ষণাবেক্ষণসহ বিভিন্ন খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দিকেই বেশি ঝোঁক রেলের শীর্ষ কর্মকর্তাদের। গত অর্থবছরেই রেলের লোকসান বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। রেলের ইতিহাসে এটিই সর্বোচ্চ লোকসান। লোকসান কমাতে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণের শর্ত অনুযায়ী প্রতিবছর ট্রেনে ভাড়া বাড়ানোর নীতি নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ পণ্য পরিবহন বাড়ানো, জমি দখলমুক্ত করে ইজারা দেওয়া, ডিজেলের বদলে বিদ্যুতে ট্রেন চালানোর মতো সুপারিশগুলো রেলের শীর্ষ কর্মকর্তারাই যেন বাস্তবরূপ দিতে চান না। ২০১১ সালে আলাদা মন্ত্রণালয় হওয়ার পর রেলে বরাদ্দ ক্রমেই বাড়ছে। কিন্তু কমছে না লোকসান।
মূলত গত অর্থবছরে (২০১৫-১৬) অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল কার্যকরের পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় লোকসানের আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে রেল। রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে রেলওয়ের আয় হয়েছে এক হাজার ৩১ কোটি ১৮ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছে দুই হাজার ৬৩২ কোটি ৪২ লাখ টাকা। অর্থাৎ লোকসান হয়েছে এক হাজার ৬০১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। নতুন বেতন স্কেল কার্যকর হওয়ায় এ সময়ে বেতন-ভাতা বাবদ প্রায় ৪০০ কোটি টাকা এবং রক্ষণাবেক্ষণ ও আনুষঙ্গিক কাজে ২০০ কোটি টাকা ব্যয় বেড়েছে। রেল কর্তৃপক্ষ বলছে, রেলের বাজেট থেকেই কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। যার পড়ছে লোকসানের ওপরেও।
রেল সূত্র জানায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যাত্রী পরিবহন বাবদ আয় হয়েছে ৫৯৬ কোটি ৭৭ লাখ টাকা ও পণ্য পরিবহন বাবদ আয় হয়েছে ১৮৮ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এর আগের অর্থবছরে যাত্রী পরিবহনে আয় হয়েছিল ৫৫৪ কোটি ৪২ লাখ টাকা, পণ্য পরিবহনে আয় হয়েছিল ১৬৪ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৯৫৬ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৮৭৮ কোটি টাকা। লোকসান ছিল ৯২২ কোটি টাকা।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে রেলের আয় হয়েছিল ৯৩১ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। লোকসান ছিল ৮০৩ কোটি টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে আয় ছিল ৮০৪ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছিল ৮৮১ কোটি টাকা। ২০১১-১২ অর্থবছরে আয় হয়েছিল ৬২৯ কোটি টাকা। ব্যয় হয়েছিল এক হাজার ৬৭৯ কোটি টাকা। লোকসান হয়েছিল এক হাজার ৫০ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরেই রেলের লোকসান হাজার কোটি টাকা ছাড়ায়।
তার আগে ২০১০-১১ অর্থবছরে ৯৫৮ কোটি টাকা এবং ২০০৯-১০ অর্থবছরে লোকসান হয়েছিল ৭৫৮ কোটি টাকা।
তবে এরও আগে থেকেই প্রতি অর্থবছরে লোকসান গুনছে রেল। দীর্ঘদিন যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ভাড়া না বাড়ানোকে লোকসানের বড় কারণ মনে করেছিলেন রেলের কর্মকর্তারা। তাঁদের মতে, পরিচালন ব্যয় বাড়ার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রেলের আয় বাড়ানো সম্ভব হয়নি বলে লোকসান ক্রমাগত বাড়ছিল। লোকসান কমাতে ২০১২ সালের ১ অক্টোবর থেকে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের ভাড়া ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে কার্যকর করা হয়। অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল চালু হলে আয়-ব্যয়ের ব্যবধান বেড়ে যাবে—এ যুক্তি দেখিয়ে গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারিতে ট্রেন ভাড়া আরেক দফায় ৭ থেকে ৯ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর আগে সর্বশেষ ভাড়া বাড়ানো হয়েছিল ১৯৯২ সালে। তবে ভাড়া বাড়ানোয় আয় কিছুটা বাড়লেও শেষ পর্যন্ত লোকসান কমেনি। গত অর্থবছরে যা আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।
স্বাধীনতার পর থেকে দেশে সড়কনির্ভর যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে বিশ্বব্যাংকসহ বিদেশি সংস্থাগুলোর ইন্ধনে। শুধু সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের অধীনেই সড়ক আছে প্রায় ২২ হাজার কিলোমিটার। কিন্তু বিপরীতে রেলপথ আছে মাত্র দুই হাজার ৮৭৭ কিলোমিটার। স্বাধীনতার পর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার শাখা রেলপথ বন্ধ হয়ে যায়। এখন অবশ্য নতুন রেলপথ নির্মাণের জন্য প্রকল্পের কাজ চলছে।
দেখা যায়, সবচেয়ে লাভজনক হলেও পণ্য পরিবহনে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দিচ্ছে রেল কর্তৃপক্ষ। ইঞ্জিন কমে যাওয়ায় রেলে আগের চেয়ে পণ্য পরিবহন ৩০ শতাংশ কমেছে। আমদানি-রপ্তানির কাজে নিয়োজিত কনটেইনারের মাত্র ৫ শতাংশ রেলপথে পরিবহন করা হচ্ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ট্রেনে ৩০ লাখ ১০ হাজার টন পণ্য পরিবহন করা হয়েছিল, ২০১৪-১৫ সালে তা কমে হয়েছিল ২১ লাখ ৩৫ হাজার টন। এ পরিস্থিতিতে কম্পানি আইনের আওতায় আলাদা কনটেইনার করপোরেশন গঠনের সুপারিশ করেছে এডিবি। কিন্তু তাতেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যাত্রী ভাড়া না বাড়িয়ে রেলপথ, ট্রেন, বগি এবং ট্রিপ বাড়িয়ে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনের মাধ্যমে আয় বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু দেখা গেছে, দেশের ৯০ শতাংশ পণ্যই সড়কপথে পরিবহন হচ্ছে। অথচ অনুমোদনের চেয়ে বেশি ওজনের মালামাল পরিবহনে নির্ধারিত আয়ুকালের আগেই অনুপযোগী হয়ে পড়ছে সড়ক। কিন্তু বিকল্প পথ হিসেবে রেলে পণ্য পরিবহন সে তুলনায় বাড়ানো হচ্ছে না।
বেশি লাভজনক হলেও পণ্য পরিবহন কমেছে : রেলওয়ের তথ্য অনুসারে, কিলোমিটারে যাত্রীপ্রতি রেলের আয় গড়ে ৫৬ পয়সা, ব্যয় এক টাকা ৫২ পয়সা। পণ্য পরিবহনে প্রতি টনে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ২২ পয়সা, বিপরীতে আয় দুই টাকার বেশি। ইঞ্জিনের অভাব ছাড়াও বগি সংকট ও পরিবহনে দীর্ঘ সময় লাগায় পণ্য পরিবহন কমেছে। ব্যবসায়ীরা এ অবস্থায় ট্রেন ছেড়ে ট্রাকের ওপর বেশি নির্ভরশীল হচ্ছেন; যদিও চাল, সবজি, শিল্পের কাঁচামাল পরিবহনে বেশির ভাগ জেলায় রেলপথ আছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক, পরিবহনব্যবস্থা বিশেষজ্ঞ ড. সামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, যাত্রী ভাড়া না বাড়িয়ে পণ্য পরিবহন ৪০ শতাংশ বাড়াতে পারে রেল। ট্রেনগুলো যথাযথ গতিতে চলতে পারছে না অনির্ধারিত স্টেশন, রেলপথের পাশে বস্তি ও মার্কেট গড়ে ওঠায়। এ ক্ষেত্রে গতির দিকে নজর দিলে ট্রিপ ও আয় বাড়বে। তবে শুরু থেকেই সেই দক্ষতা অর্জন করে বেশি আয়ের চেষ্টা করেনি রেল। সম্প্রতি দেশে নতুন ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। সেগুলোতে শাখা রেলপথ নির্মাণ করে রেলে পণ্য পরিবহন বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। বরাদ্দ বাড়ানো হলেও গতি বাড়িয়ে আয় বাড়ানোর চিন্তা ও সমন্বিত উদ্যোগ না হলে রেল নিজের পায়ে দাঁড়াবে না। লোকসান কমিয়ে রেলকে স্বনির্ভর করতে যেসব সুপারিশ করা হয়, তা বাস্তবায়িত হয় না। ঢাকায় যানজট নিরসনে বৃত্তাকার রেলপথ করা হলে ট্রিপও বাড়বে, আয়ও বাড়বে। তাতে লোকসান কমবে। সে জন্য রেলের পরিকল্পনা আছে, তবে বাস্তবায়ন নেই।
সাশ্রয়ী বৈদ্যুতিক রেলপথ নির্মাণে অনীহা : রেলে লোকসান কমাতে পারে বৈদ্যুতিক রেলপথ বা ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন। কিন্তু তাতে রেল কর্তৃপক্ষের আগ্রহ সবচেয়ে কম। অথচ বৈদ্যুতিক রেলপথ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ ব্যয় সাশ্রয়ী। বিভিন্ন দেশে বৈদ্যুতিক রেলপথ তৈরি করা হচ্ছে। ভারতে অর্ধেকেরও বেশি রেলপথ ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনে রূপান্তর করা হয়েছে। ২০১২ সালে পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে ২২ কিলোমিটার রেলপথ বৈদ্যুতিক ট্র্যাকশনে রূপান্তরের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরের বছরই সে পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। বৈদ্যুতিক রেলপথে জ্বালানির দরকার হয় না। ট্রেন চালাতে লাগে বিদ্যুৎ। ট্রেনে ডিজেল ইঞ্জিনেরও দরকার হয় না। রেলপথের ওপর স্থাপিত লাইন থেকে সঞ্চালিত বিদ্যুৎ দিয়েই চলে ইঞ্জিন। এসব ইঞ্জিনের দামও অনেক কম, দুই কোটি টাকা। অথচ বর্তমানে ব্যবহৃত ডিজেলচালিত ইঞ্জিনের দাম গড়ে ২৫ কোটি টাকা। ডিজেল ইঞ্জিনের বড় ধরনের মেরামত বা ওভারহোলিংয়ে ৬০ লাখ টাকা খরচ হয়, বৈদ্যুতিক ইঞ্জিনের একই ধরনের মেরামতে খরচ পড়ে সর্বোচ্চ ২০ লাখ টাকা। রেলের মহাপরিকল্পনায় ইলেকট্রিক ট্র্যাকশনের প্রকল্পটি ২০২৫ সালে বাস্তবায়নের জন্য রাখা হয়েছে। অথচ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সমপ্রতি বৈদ্যুতিক রেলপথ প্রকল্প বাস্তবায়নে নির্দেশনা দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত রেলপথ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থায় রূপান্তরের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্যোগও নিয়েছে রেল। গত মার্চে প্রকল্প প্রস্তাব চূড়ান্ত হয়েছে। তবে প্রক্রিয়ার জালে তা পড়ে আছে পরিকল্পনা কমিশনে। ইলেকট্রিক ট্র্যাকশন হলে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যেতে সময় লাগবে মাত্র ১০ মিনিট। একই রুটে ২০ ট্রিপে বিদ্যুৎ লাগবে ১০ মেগাওয়াট। ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটে এক ট্রিপে লাগবে ১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
এখন এক কিলোমিটার ট্রেন চালাতে জ্বালানি খরচ হয় এক হাজার ১০০ টাকা। ইলেকট্রিক ব্যবস্থায় এই খরচ হবে মাত্র ২৪ টাকা।
ডিজেলচালিত মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন ও পাওয়ার কার মেরামতে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হচ্ছে রেলে। আর প্রতিবছর ডিজেল চুরি হচ্ছে কোটি কোটি টাকার।
পাওনা টাকাও আদায় করতে পারে না রেল : লোকসান কমিয়ে আয় বাড়াতে রেলের জমির ইজারামূল্য ও রেলের জমিতে বানানো দোকানের ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলওয়ে। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেড় দশক ধরে দেশের ১৩০টি রেলস্টেশনে দোকান ভাড়া, লাইসেন্স ফি ও ভাড়া না দেওয়ার জরিমানা ও ভ্যাটসহ বকেয়া ১৮১ কোটি টাকা আদায় করছে না রেল কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগের এ-সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে,  স্থানীয় প্রভাবশালীরা রেলের সংশ্লিষ্টদের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে দোকান ভাড়া নিয়ে আর ভাড়া দিতে চান না। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলে ৭৫টি স্টেশনে ছয় হাজার দোকান রয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলের ৫৫টি রেলস্টেশনে আছে সাত হাজার দোকান। ২০০২ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত এসব দোকান থেকে পাওনা বকেয়া পড়ে আছে। ২০০৬ সালের রেলের ভূমি বরাদ্দ নীতিমালা অনুযায়ী, দোকান ভাড়ার ক্ষেত্রে লাইসেন্স ফি পরিশোধ করতে হয়। বকেয়া ভাড়া ও লাইসেন্স ফির ওপর ২০ শতাংশ জরিমানাও পাওনা রয়েছে রেলওয়ের।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, রেল তার ৬৩ হাজার একর জমি ইজারা দিয়ে লাভবান হতে পারত। কিন্তু ওই জমির বেশির ভাগ প্রভাবশালীদের দখলে আছে।
যাত্রীর টাকা যায় রেল কর্মচারীর পকেটে : জনবল, ইঞ্জিন ও যাত্রীবাহী বগির সংকটে দিনাজপুরের পার্বতীপুর রেলস্টেশন থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচলকারী ১৬টি যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। পার্বতীপুর রেলস্টেশন থেকে যাত্রী পরিবহন ও আয় তাই অর্ধেকে নেমেছে। এভাবে বিভিন্ন রেলস্টেশনে ট্রেন বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি ট্রেনে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় না করে এর বদলে ঘুষ নিচ্ছেন অনেক কর্মচারী। ঢাকা থেকে বিভিন্ন পথে ডেমু ট্রেনে টিকিটবিহীন অর্ধেক যাত্রীর কাছ থেকে নির্ধারিত জরিমানা আদায় করা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, জরিমানা আদায়ের বদলে যাত্রীর কাছ থেকে ঘুষ নেওয়া হয়। প্রকৃত আয়ের বড় অংশ রেল কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্টদের পকেটে যায়। রেলে লোকসানের পাল্লা ভারী হওয়ার অন্যতম কারণ এই চুরি। লোকসান দেখালে রেলের কর্মকর্তাদের বেশি বরাদ্দ পেতে সুবিধা হয়।
এডিবির শর্ত অনুসারে, প্রতিবছর ট্রেনে ভাড়া বাড়ানোর উদ্দেশে ট্যারিফ কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। তা বাস্তবায়ন না করলে এডিবি নতুন কোনো প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না। রেলের সংস্কার প্রকল্পে নিয়োজিত আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রাইসওয়াটারহাউসকুপার (পিডাব্লিউসি) প্রাইভেট লিমিটেড একটি স্থায়ী ট্যারিফ পদ্ধতি প্রণয়ন করেছে। তাদের সুপারিশ অনুসারে, রেলের রক্ষণাবেক্ষণ ও কর্মচারী খাতে ব্যয় বৃদ্ধির আনুপাতিক হারে যাত্রী ও পণ্য খাতের আয় অনুসারে পরিবহন ভাড়া প্রতিবছর বেড়ে যাবে। স্থায়ী ট্যারিফ নির্ণয় পদ্ধতি প্রবর্তনের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বিদেশি পরামর্শকরা বলছে, মুদ্রাস্ফীতি এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতাসহ নানা খাতে ব্যয় বাড়ায় প্রতিবছর রেলের পরিচালন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু রেলের যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি না পাওয়ায় পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আয় বাড়ানো সম্ভব হয় না। ফলে আয় ও ব্যয়ের পার্থক্য অর্থাৎ পরিচালন অনুপাত ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাথা ভারী সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা সমন্বয় করতে হলে প্রতিবছর ভাড়া বাড়ানোর দরকার হবে না। এর বদলে রেলের জমির বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়াতে হবে, বিদ্যুত্চালিত রেলপথ নির্মাণ করতে হবে।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফিরোজ সালাহ উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভারতে রেল লাভ করছে। ভারতে এক লাখ কিলোমিটারের বেশি রেলপথ আছে। আমাদের রেলপথ সে তুলনায় কম। তার ওপর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বেড়েছে বলে লোকসান বেশি হচ্ছে। জাপানে রেলে ৫৭ শতাংশ আয় হচ্ছে বাণিজ্যিক স্থাপনা পরিচালনা করে।’ যাত্রী ভাড়া বাড়িয়ে বেশি আয় করা যায় না স্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা রেলের জমিতে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান তৈরি করে আয় করতে চাই। সে জন্য সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপিতে) হাসপাতালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পরিকল্পনা করা হয়েছে। আমরা লাভের পথে চলতে চাই। তবে এই লোকসান আগে থেকেই হয়ে আসছে।’
রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আমজাদ হোসেন গতকাল বুধবার রাতে বলেন, ‘রেলের বাজেট থেকেই কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে ব্যয় আরো বাড়বে। রেল নিরাপত্তা বাহিনীর বেতন-ভাতাও দিতে হয় রেলের নিজস্ব বাজেট থেকে। রেলওয়ে থেকে প্রতিবছর অবসরে যাওয়া কর্মচারী বাড়ছে, পেনশন বাড়ছে। বেতন-ভাতা বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ লোকসান দেখা যাচ্ছে। নতুন নতুন ট্রেন চালুর ফলে জ্বালানিও বেশি লাগছে। তবে রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ব্যয় তেমন বাড়েনি। আমাদের আয়ও কিন্তু বাড়ছে। আমরা রেলের জমি দখলমুক্ত করে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে আয় বাড়িয়ে লোকসানের পাল্লা কমাব।’
সূত্র : কালের কণ্ঠ

Print Friendly, PDF & Email