May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

হিমালয়-সমান একজন মানুষঃ গল্প নয়, সত্য

তৌহীদ রেজানুরঃ লোকটিকে বাঁচিয়ে রাখলে সদ্য স্বাধীন দেশটাকে খুবলে খুবলে – তারিয়ে তারিয়ে ভক্ষণ করা যাবে না – বুঝে গিয়েছিল অমানুষের দল। তাই চললো তাঁকে চিরতরে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র। এই চক্রান্ত শুরু হয়েছিল বাংলাদেশ সৃষ্টিরও অনেক আগে থেকে যখন তিনি বাঙ্গালীর মনে বপন করে চলেছিলেন স্বপ্নের বীজ – যা তাদেরকে ক্রমশই উদ্দীপ্ত করেছিলো শোষণের জাল ছিন্ন করতে। মানুষটি রাজনীতির নামে বেসাতি করেননি কখনোই, বরং এক কঠিন সাধনায় নিয়োজিত থেকে নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন মানব-মুক্তি ও মানব কল্যাণের কাজে। কারাবন্দী থেকেছেন বছরের পর বছর – কিন্তু কি তাজ্জব কান্ড – সবাইকে ছাপিয়ে তিনিই জায়গা করে নিলেন গণ মানুষের হৃদয়ে!

smrবাবার দেয়া নাম ‘শেখ মুজিবর রহমান’কে কেটে-ছেটে গণমানুষ তাঁদের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা দিয়ে তাঁকে কেউবা ডাকেন শেখ সা’ব, কেউবা মুজিব ভাই, কারো কাছে তিনি মজিবর ভাই – কারো কাছে শেখ মজিবর, কারো কাছে ‘শ্যাখের ব্যাডা’। আবার গাও-গেরামের বুড়ীমার কাছে তো তিনি শুধুই ‘শ্যাখ’। নিজের ধ্যান-মগ্ন রাজনীতি দিয়ে শেখ মুজিবর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি পাবার অনেক আগেই টুকরো টুকরো বিভিন্ন নামে এদেশের মানুষের মনের গহীনে ঠাই করে নিয়েছিলেন। আর তাই তো পাকিস্তানী মিলিটারী শাসনের শ্বাসরোধী দিনগুলোয় মানুষের প্রাণ যখন ওষ্ঠাগতপ্রায়, তখন তিনিই হয়েছেন মানুষের একমাত্র ভরসাস্থল – একান্ত নির্ভরতার জায়গা। অথচ রাজনীতির অঙ্গনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী, মৌলানা  ভাসানী, আব্দুর রহমান তর্কবাগীশ, আতাউর রহমান খান, কমরেড মণিসিংহ, কমরেড মোজাফফর আহমেদ, আবুল আলা মওদুদীসহ অনেক প্রবীণ রাজনীতিবিদের ভিড় ঠেলে তাঁকে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল হতে হয়েছে। তাই তাঁকে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে সমুচিত শাস্তি দেবার জন্য অবাংগালী শাসকবর্গ তাঁর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ মামলা আরোপ করার পরেও গণরোষের কাছে হার মেনেছিল।  ‘জেলের তালা ভাংবো – শেখ মুজিবকে আনবো’ শ্লোগানে মূখরিত লক্ষ লক্ষ মানুষ সেদিন রাজপথে নেমে এসেছিল এবং সত্যি সত্যি তাঁদের মুজিব ভাইকে জেলের তালা ভেংগে বের করে নিয়ে এসেছিল। মুজিব ভাইয়ের সেই গগনচুম্বী জনপ্রিয়তার তোড়ে ভেসে গিয়েছিলো জনগণের ওপরে জগদ্দল পাথরের মতো চেপে বসা লৌহ মানব আইয়ুব খানের রাজত্ব। আইয়ুব হটানোর এই আন্দোলনে গণমানুষের তাতানো মন   তাই দ্বিধাহীনভাবে উপলব্ধি করলো যে, ‘তোমার নেতা – আমার নেতা’ আর কেউ নয় – শুধুই ‘শেখ মুজিব’।

তারপরের ইতিহাস তো মহাকাব্যের উপাখ্যানের মতো যেখানে একজন মানুষ – একজন নেতা মহা-মানব হয়ে উঠতে থাকেন – যার উপস্থিতিতে ‘দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে’। সত্তরের নির্বাচনে মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামীলীগের ভূমিধ্বস জয়ের সত্য গল্প কে না জানে? ঐতিহাসিক ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ারদী উদ্যান) নিযুত জনতার সামনে দাঁড়িয়ে সমগ্র জাতির প্রতি তাঁর বজ্র নির্ঘোষ পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল বক্তৃতাবলীর একটি হবার সম্মান পেলো – সেটাই তো শুধু নয় – সে ভাষণ কিভাবে একটি জাতিকে ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা’ করবার মন্ত্রে উজ্জীবিত করলো তা আজকের তরুণ প্রজন্মের হৃদয় দিয়ে অনুধাবন করা জরুরী। কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্ট কাকভোরে যে মানুষটির বুক তাঁর নিজস্ব বাসভবনে ষ্টেনগানের ব্রাশ ফায়ারে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল ঘাতকেরা – তিনি তো আর কেউ নন – বঙ্গবন্ধু – জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর যে বুকে তিনি ঠাই দিয়েছেন এই ছাপ্পান্ন হাজার বর্গ মাইলকে – যেখানে তিনি ধারণ করেছেন নিষ্পেশিত-অবহেলিত সমগ্র জাতিকে, তাঁকে হত্যা না করলে ঘাতকেরা যে এই সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা সোনার বাংলার প্রাণ ভোমরা করায়ত্ত করতে পারবে না – তা তারা বুঝতে পেরেছিল। যেন কোনভাবেই ‘শেখ মুজিব’-এর কোন অস্তিত্ব এই দেশে না থাকে – সে জন্যে তারা তাঁর বংশ সমূলে ধ্বংস করতে একে একে হত্যা করে (দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা ছাড়া)পরিবারের সবাইকে। যে দুজন বেঁচে গেলেন সেদিন – তাঁরা নির্ঘাত হত্যার শিকার হতেন – যদি দেশে থাকতেন।

বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে সংবিধানে তাঁর হত্যাকারীদের রক্ষার কবচ ইনডেমনিটি আইন জুড়ে দিয়েছিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। আগামী প্রজন্ম যেন তাঁকে না জানতে পারে সে জন্য নানা ধরণের উদ্যোগ নেয়া হতে থাকলো একে একে। এর শেষ জঘন্যতম কাজটি করলেন বেগম খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যা দিবসে কেক কাটার সংস্কৃতি চালু করে।

পচাত্তরের আগষ্ট মাসে হত্যা করবার পর সুদুর টুঙ্গিপাড়ায় লোক-চক্ষুর অন্তরালে যেন-তেনভাবে বঙ্গবন্ধুকে মাটিতে পুতে ফেলার ভাবনা ছিল ঘাতকদের। দাফন ছাড়াই মাটি দিতে চেয়েছিল ঐ নরপিশাচেরা। সে সময়ের সবচেয়ে কম দামী গরীবের সাবান – কাপড় কাঁচার সাবান ‘৫৭০’ দিয়ে তাঁকে শেষ গোসল করালো, কিন্তু ওরা জানতো না যে সেদিন বঙ্গবন্ধু রোপিত হলেন এদেশের পলি মাটিতে – এবং ফুলে-ফলে পল্লবিত হয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকলেন দেশব্যাপী। ঐ ঘাতকেরা ঠাহর করতে পারেনি যে পৃথিবীর সমস্ত মাটি চাঁপা দিলেও সমস্ত মাটি ফুঁড়ে ছয় ফুট লম্বা বিশাল বপু মানুষটার মধ্যে থাকা সত্য বেরিয়ে আসবে একদিন। তিনি আমাদের মগজে, মননে আবার জাগ্রত হয়ে উঠছেন – আরো জাগ্রত হতেই থাকবেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, এদেশে নিন্দুক ও হীনমন্য লোকেরও খুব অভাব নেই যারা বঙ্গবন্ধুকে খাটো করে দেখাবার জন্য অহর্নিশি ব্যস্ত রয়েছেন। কিন্তু সত্য এই যে, হিমালয় পর্বতের বিশালতা নিয়ে জন্মেছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান – তাঁকে যিনি একবার দেখেছেন তাঁর আর হিমালয় দেখার প্রয়োজন নেই – কথাটি আমার নয়, বলেছিলেন বিশ্বনন্দিত বিপ্লবী নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো। এখন সিদ্ধান্ত আমাদের – কিভাবে দেখতে চাই এতক্ষণ বলা এই মানুষটিকে।

লেখক : সদস্য, প্রজন্ম ’৭১।

Print Friendly, PDF & Email