May 16, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত বাঁচাতে এগিয়ে আসুন

সৈয়দ মামুনূর রশীদঃ নান্দনিক প্রাকৃতিক সম্পদে ভরা বন্দর নগরী চট্টগ্রাম। দুইপাশে পাহাড়, একপাশে নদী, অন্যপাশে সাগর। কর্ণফুলীর মোহনা, পৃথিবীর সুন্দরতম এক নদীর মোহনা। এপাড় বিমানবন্দর আর নেভাল ওপাড়ে দেয়াং পাহাড়, মরিয়ম আশ্রম আর মেরিন একাডেমী। মোহনা থেকে শুরু করে উজানে ১০ কিমি বন্দরের জেটি, বিশ্বের নানাদেশের নানা পতাকাবাহী নোঙর করা সারি সারি জাহাজ, নয়নাভিরাম দৃশ্যের সৃষ্টি করে। পর্যটক যিনিই আসেন, অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে থাকেন। পৃথিবীতে এরকম সৌন্দর্যে ভরপুর দ্বিতীয় কোন নদীর মোহনা সত্যিই বিরল। এই বিরল নদীর মোহনার (১৮নং নামেই পরিচিত) অদুরে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। চট্টগ্রামে প্রকৃতি অকৃপন হাতে ঢেলে দিলেও সরকারগুলো বরাবরই বিমাতাসুলভ আচরণ করেছে। ফলশ্রুতিতে প্রাচ্যের রাণী খ্যাত চট্টগ্রাম আজ কল্পনা রাণী দাসের মত নামেই রাণী হয়ে আছে, বাস্তবে কিছু নেই।

পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত। প্রকৃতির নিজহাতে গড়া অখন্ড পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতটি ভাগ হয়ে গেছে মানুষের হাতে। একভাগ দখলে আছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হাতে, অন্যভাগ দখলে আছে অবৈধ দখলদার কয়েকশ ব্যবসায়ীদের হাতে। নগরের ইট-খাঁচায় বন্দি সাধারন জনসাধারণের জন্য আলাহপাক দয়াপরবশত পুরো সুমুদ্র সৈকতটি দান করলেও নাগরিকদের দাঁড়িয়ে হাওয়া সেবনের মতো কোন অংশ আর অবশিষ্ট নেই।

চট্টগ্রাম শহরে সাধারন নাগরিকের অহংকার করার মতো এই একটি জায়গায় অবশিষ্ট ছিল। অন্য এক দর্শনীয় স্থান “ফয়েস লেক” বহু আগে বাণিজ্যের শিকার হয়ে জনসাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে। নব্বই এর দশকে মন খারাপ হলে নগরীর লোকজন বিনেপয়সায় কিংবা সামান্য কটা টাকা দিয়ে লেকেরপাড়ে বসে মনটা জুড়িয়ে নিতেন। সেই দিন আর নেই! লেকের পাড়ে দু’দন্ড বসার সুযোগ এখন আর সাধারণের নেই। সবুজে সবুজে, সবুজের কীর্তন ফয়েস লেক এখন ইট-পাথরের কঠিন দেয়ালে বন্দি। চড়াদামে টিকিট করেই ভেতরে যাওয়ার অনুমতি মেলে মাত্র। অবশিষ্ট পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত মুলত বেড়িবাঁধের পরের অংশকে বলা হয়। বেড়িবাঁধের উপর থেকে শুরু করে সাগরের বালুকাবেলায় দেয়া পাথর পর্যন্ত ভরে গেছে দোকান আর দোকান, রমরমা বাণিজ্যের পসরা কিংবা অবৈধ বেচাকেনার বেসাতি। তিল পরিমাণ জায়গা নেই যেখানে আপনি দাঁড়িয়ে নির্মল বাতাসের সন্ধান করতে পারেন। ঘুরতে আসা লোকজন ছোট বাচ্চা নিয়ে ঝুঁকি নিয়ে দাঁড়ায় পাথরের উপর। পাথরের উপরও নিরিবিলি দাঁড়ানোর সুযোগ নেই, ওখানে বসে আছে পান-সিগারেট বিক্রেতা আর বাদাম বিক্রেতা। আজ থেকে পাঁচ বৎসর আগেও সৈকতের এই বেহাল অবস্থা ছিল না। বেড়িবাঁধের পর থেকে বালুকাবেলা পর্যন্ত যেখানে বড় বড় ছাতার নীচে বড় বড় কাঠের চেয়ার বা বেঞ্চ থাকার কথা সেখানে ঝাপিয়ে বসে আছে হাজার হাজার শ্বাসরুদ্ধকর দোকানপাঠ। দোকানের গায়ে ঠেসে আছে দোকান। পুরো সৈকত দখলে নিয়েছে অবৈধ স্থাপনা, দোকানপাঠ, ইঞ্চি পরিমাণ মাটিও খালি নেই আর। সৈকততো চোখে দেখা যায় না সমুদ্রের পানি যদি দেখতে চান, তাও যেতে হবে দোকানের ভেতর তৈরী করা ছোট ছোট পেঁচানো গলি দিয়ে। এই নগরীর নাগরিকদের বিনে পয়সায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার জায়গাটুকু এভাবে বেদখল হয়ে আছে, দেখার বোধহয় কেউ নেই। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এই সমুদ্র সৈকত দেখভাল করার বড় অভিভাবক। এই অবৈধ দোকানগুলোর অনেকের কাছে সিটি কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স এবং বিদ্যুৎ বিভাগের অনুমোদিত মিটার রয়েছে। শুধু তাই নয়, ওখানে রীতিমত আলোকসজ্জা চলছে। সুতারাং বুঝা যায় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত দখল হয়ে গেছে এক বৃহৎ চক্রের হাতে। প্রতিদিন ওখানে চলে কমপক্ষে কোটি টাকার লেন-দেন। স্বাভাবিক কারণেই কোটি টকার লেনদেনের সাথে সংযুক্ত হয়েছে নানা অপরাধের সম্রাট। নানা বাধা ও বিপত্তি সত্ত্বেও চট্টগ্রামবাসীর সর্বশেষ অহংকার, গণমানুষের বিনে পয়সার বিনোদনস্থল উদ্ধার করা অত্যšত জরুরী। উদ্ধার করা সম্ভব না হলেও এই বিশাল চট্টগ্রামে যদি একজনও সৎ, সচেতন নাগরিক জীবিত থাকেন, অন্তত তাঁর প্রতিবাদ করা নাগরিক ফরজ্ বলে মনে করছি। আসুন চট্টগ্রামবাসী, আসুন সচেতন ও সৎ পরিবেশবাদী আন্দোলনের কর্মী, আসুন সূশীল সমাজ, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সংস্কৃতকর্মী, দুরšত যুব ও ছাত্রসমাজ! অবৈধ কোটিপতি বণিক সম্প্রদায় কিংবা অসৎ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে বুক ফুলিয়ে দাঁড়াতে না পারেন, অšতত এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শব্দ তুলুন।

সমুদ্র সৈকতে বেড়ীবাঁধের আগের অংশে অনেক দোকানপাঠ রয়েছে। আমি নিশ্চিত, যারা পূর্বে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে গেছেন তারা নিশ্চয় এখন আরো একটি দৃশ্যের অভাববোধ করবেন। কাটগড় থেকে সীবিচ যেতে রাস্তার দু’পাশে যে খোলা জমি ছিল, যেখানে মিষ্টি তরমুজ, খিরা, বাগ্মি লাগাতো কৃষক, ঝাউগাছের শনশন আওয়াজে নি¯তব্দতার বুক চিরে চিত্ত নেচে উঠতো যে রা¯তায়, সে রা¯তাও আজ আর নেই। দু’পাশে গড়ে উঠেছে নতুন বসতি, কন্টেইনার টার্মিনাল আর কারখানা।

বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান বন ও পরিবেশ মন্ত্রী চট্টগ্রামেরই সšতান। পরিবেশ আন্দোলনের আমাদের প্রিয় নেত্রী, “বেলা” সংস্থার প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান সম্প্রতি বিজয় করে আসলেন ”রামন ম্যাগসাইসাই অ্যাওয়ার্ড – ২০১২। বন ও পরিবেশ মন্ত্রী, পরিবেশবাদী নেত্রী রিজওয়ানাসহ চট্টগ্রামের সকল সচেতন মানুষের বিবেকের দরবারে আকুল আবেদন জানাই, এগিয়ে আসুন! দয়াকরে এগিয়ে আসুন! নয়নাভিরাম পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত উদ্ধার করে ফিনিয়ে দিন গণমানুষের বিনোদনস্থল।

(লেখাটি ফেসবুক পাতা থেকে নেয়া)।

Print Friendly, PDF & Email