April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

আজ শহীদ আসাদের জন্মদিন

ডেস্ক প্রতিবেদন :  আজ ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ আসাদের জন্মদিন। ১৯৪২ সালের ৬ জুন রসিংদী শিবপুরের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম ধনুয়ায়  আসাদুজ্জামানের জন্ম।

আসাদ শিবপুর স্কুলে পড়ার সময়ই ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলনের অংশগ্রহণ করেন। তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা ছিলো প্রগতিশীল। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে দেশের প্রগতিশীল ছাত্র সমাজ সে সময়কালে সংগ্রামরত ও বেশ সোচ্চার ছিল। একসময় স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন গ্রুপ) এর সক্রিয় কর্মী হিসেবে ঢাকা ছাড়াও শিবপুরে সংগঠনকে বিস্তৃত করার জন্য তাকে অনেক কাজ করতে হয়েছে।

আসাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ. ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যস্ততার কারণে ঠিকমত পড়াশোনা করতে না পারায় পরীক্ষার ফলাফল সন্তোষজনক না হওয়ায় তিনি পুনরায় পরীক্ষায় অবতীর্ণ হন। অন্যদিকে তিনি ভর্তি হন ঢাকার সেন্ট্রাল ল’ কলেজে।

কিন্তু এসব পড়াশোনা এবং মেনন গ্রুপ এর ঢাকা হল শাখার সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম নেতৃস্থানীয় সংগঠক হিসেবে ছাত্র সংগঠনে তার তৎপরতাকে বজায় রাখার পাশাপাশি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবন ও আন্দোলনের সাথে একাত্ম হবার তাগিদ তিনি অনুভব করেন। এই সচেতনতা তাকে সব এলাকায় কৃষক সমিতির সংগঠন গড়ার কাজে বিশেষ ভূমিকা পালনে ব্রতী করে।

১৯৬৯ সালের গণআন্দোলন তার আত্মত্যাগের মাধ্যমেই বেগবান হয়েছিল। আসাদ আমাদের অহংকার, আমাদের চেতনার পরতে পরতে সংগ্রামের দৃপ্ত অঙ্গীকার রূপে চির ভাস্বর হয়ে আছেন। আসাদ ১৯৬৯ সালের আন্দোলনের মশাল জ্বালানোর প্রথম স্ফুলিঙ্গ, তার শহীদ হওয়ার পরই ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের রূপ নেয়।

১৯৬৫ সাল  থেকে ১৯৬৯ সাল  পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলনে  সক্রিয় থেকেও শিবপুর ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে সংগঠনকে বেশ মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন গ্রামে কৃষক সমিতির সংগঠন ও শিবপুরে কৃষক সমিতির একটি স্থায়ী অফিস প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হন।

১৯৬৮ সালের শেষ দিকে মওলানা ভাসানী আইয়ূব খানের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে তীব্রতর করার আহবান জানান। মওলানা ভাসানী ২৯ ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার সর্বত্র  হরতালের ডাক দেন। তিনি তহশীল অফিসে ঘেরাও ও দুর্নীতিবাজ সরকারী কর্মচারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্যও আহবান জানান। এ আহবানে শিবপুর অঞ্চলের কৃষকসহ সাধারণ জনগণ বেশ উদ্বুদ্ধ হয়। ২৯ ডিসেম্বর শিবপুর অঞ্চলে হাতিরদিয়ায় হাটবার ছিলো (রোববারে হাতিরদিয়া হাট। শিবপুর থেকে প্রায় ৪ মাইল উত্তরে) বলে ওখানে হরতাল ডাকা হয়। আসাদ ও কর্মীদের পিকেটিং এর ফলে হাতিরদিয়ায় অত্যন্ত সফলভাবে হরতাল পালিত হয়।

এক পর্যায়ে পুলিশ বাহিনী বিনা উস্কানীতে  নিরীহ জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বেশ কয়েকজন কর্মীকে গ্রেফতার করে। এর ফলে জনসাধারণ দারুণভাবে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে এবং  গ্রেফতারকৃতদের মুক্তির দাবীতে অবিচল থাকে। তখন পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশের গুলিতে চারজন কৃষক শহীদ হন এবং আসাদসহ কয়েকজন আহত হন। হাতিরদিয়ার নৃশংস কৃষক হত্যার খবর ঢাকা পৌঁছানোর জন্য আহত অবস্থায়ই আসাদ পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে প্রথমে দীর্ঘপথ হেটে, পরে সাইকেল, লঞ্চ ও বাসে করে ঢাকা এসে পৌঁছান। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাতিরদিয়ার ঘটনা অবহিত করেন । হাতির দিয়ার ঘটনার পর আসাদকে প্রধান অভিযুক্ত করে পুলিশ মামলা রুজু করে তাকে গ্রেফতারে হুলিয়া জারী করে । ঐ অঞ্চলের কৃষকসহ সাধারণ জনসাধারণের উপর চলতে থাকে পুলিশী নির্যাতন। আসাদ কর্মীদের সাথে গোপন যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন-এতে কর্মীদের মনোবল আরও বৃদ্ধি পায়। হাতিরদিয়ায় কৃষক হত্যা ও পরবর্তী পুলিশী নির্যাতনের প্রতিবাদে হাতিরদিয়া ও শিবপুরে জনসভার ঘোষণা দেন মওলানা ভাসানী। সভার দিন শিবপুরে ১৪৪ ধারা জারী করে সরকার। সভাস্থলের চারদিকে পুলিশ বেষ্টনী গড়ে তোলা হয় আর প্রতিবাদী জনসাধারণ যাতে সভায় না আসতে পারে সে জন্য বিভিন্ন স্থানে বাধা দেওয়া হয়।

মওলানা ভাসানী পুলিশ বেষ্টনী ভেদ করে সভাস্থলে পৌঁছেই মোনাজাত ও জালীম শাহীর বিরুদ্ধে তার স্বভাবসুলভ জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুরু করেন। চারদিক থেকে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মত জনস্রোত আসতে থাকে। অল্প কিছুক্ষণের ভেতর, পুরো মাঠ ভরে যায়। মওলানা ভাসানী জনগণকে স্বৈরাচার ও জুলুম শাহীর বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আরও তীব্রতর করার আহবান জানান। সব ধরনের নির্যাতন বন্ধ করার জন্য তিনি পুলিশকে হুশিয়ার করে দেন।

হুলিয়া থাকা সত্ত্বেও আসাদ হঠাৎ করে সভাস্থলে উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা করেন এবং সব ধরনের জুলুম ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম জোরদার করার জন্য সহযোদ্ধাদের প্রতি আহবান জানান। হাতিরদিয়ার ঘটনায় সারাদেশেই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়।

গ্রেফতার এড়ানোর জন্য আসাদ প্রথমে কিছুদিন ঢাকায় আত্মগোপন করে থাকেন। পরে কৌশলগত কারণে ঢাকার বাইরে এক স্কুলে শিক্ষকতায় নিয়োজিত হন।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে আইয়ূবের স্বৈরশাসন উৎখাতের  আন্দোলন দিন দিনই বেগবান হচ্ছিল। আসাদ কিছুদিনের জন্য তার আস্তানা থেকে ঢাকায় এলেন।

পূর্ব পাকিস্তানে দীর্ঘদিন ধরে আইয়ূব শাসন বিরোধী আন্দোলন চললেও, ঊনসত্তরের আন্দোলনের জন্য ছাত্ররা নিজেদের তৈরি করেছিল । ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারী ডাকসু কার্যালয়ে আয়োজিত সাংবাদিক সন্মেলনে তিনটি ছাত্র সংগঠন একত্রিতভাবে ‘সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি’ গঠনের কথা ঘোষণা করে এবং ১১ দফা ঘোষণা করে চলমান স্বাধীনতা আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগের প্রত্যয় ব্যক্ত করে।

১১ দফার ভিত্তিতে ছাত্রদের প্রত্যক্ষ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬৯ সালের ১৭ জানুয়ারি। এ সময় আন্দোলন চলাকালীন সময়ে বিক্ষুদ্ধ জনতা সংবাদপত্র অফিস, জাতীয় সংসদ ও পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের কিছু সদস্যের বাড়ি, ব্যাংক, তহসিল অফিস ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং সদস্যদের বাড়ি, সরকারি অফিসে আগুন দেয়। এইদিন ছাত্র সংগ্রাম কমিটি পুলিশ ও ইপিআর বাহিনী কর্তৃক ছাত্র-জনতার উপর বর্বর নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা লংঘনের প্রতিবাদে ২০ জানুয়ারি পূর্ণ হরতাল পালনের আহবান জানায়।

 এই হরতালের অংশ হিসেবে ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। সে দিন ঢাকার ১৪৪ ধারা জারী করা ছিল। তথাপি বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা মিছিল যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাঙ্গণে সমবেত হন। বেলা বারোটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় অনুষ্ঠিত এক সংক্ষিপ্ত ছাত্রসভা এবং তারপর প্রায় দশহাজার ছাত্রের এক বিরাট মিছিল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে পা বাড়ায়। মিছিলটি পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটের (তৎকালীন) কাছাকাছি এলে পুলিশ তার উপর লাঠি-চার্জ করেন। ফলে মিছিল ভাগ হয়ে যায়।  একাংশ পুরনো রেল লাইনের রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে বাহাদুর শাহ পার্কে শেষ হয় । অপর অংশটি ঢাকা হলের (তৎকালীন) প্রবেশ পথের সামনে সমবেত হওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু সেখানেও পুলিশ কাঁদানে গ্যাস দিয়ে ছাত্রদের উপর হামলা চালালে ছাত্ররাও পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পুলিশের উপর আক্রমণ চালায়। এই সংঘর্ষ চলে প্রায় ঘন্টাকাল ধরে। এ সময় পুলিশের গুলিতে আসাদুজ্জামান ঘটনাস্থলেই নিহত হন।

মৃত্যু সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নাগরিকগণ স্তম্ভিত হয়ে যান-শহরে নেমে আসে শোকের ছায়া।

Print Friendly, PDF & Email