April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

শক্তিমদে মত্ত, দাম্ভিক, অত্যাচারী রাজনীতিবিদের উদ্দেশে

ডা. নুজহাত চৌধুরী: জনাব বিশাল শক্তিমান রাজনীতিবিদ, আপনার এত ক্ষমতা যে, আপনি একজন শিক্ষককে কানে ধরে উঠ-বস করাতে পারেন! আপনি কি মনে করেছেন তাতে শুধু ওই শিক্ষকের অসম্মান হয়েছে? হ্যাঁ, তা হয়েছে বটে। তাঁর স্ত্রী, সন্তানদের দিনরাত কীভাবে কাটছে ভাবতেই আমার গা শিউরে উঠছে। চোখের জলে বুক ভেসে যাচ্ছে।

কিন্তু না, আপনি শুধু একজন শিক্ষককেই কান ধরে উঠ-বস করাননি, সমস্ত দেশ, আমাদের সবাইকে, সমগ্র মানবতাকে অপমান করেছেন। কিন্তু কি জানেন, মানীর মান লাঠি দিয়ে পেটালেও যায় না। প্রবাদটা শুনেছেন কখনও?

অপমান ওই শিক্ষকের হয়নি– মানুষ হিসেবে গায়ে যদি কোনো মান-অপমানের চাদর থাকে তাহলে গায়ের সব কাপড় খুলে গেছে আপনার আর আপনার পুরো পরিবারের। প্রত্যেক ব্যক্তি আপনাকে ছি ছি করছে, আপনার চেহারায় থুতু দিচ্ছে। কিন্তু এগুলো আপনাকে বলে লাভ কী?

কথায় আছে না, যার এক কান কাটা সে লজ্জায় রাস্তার এক পাশ দিয়ে হাঁটে। আর যার দুই কান কাটা সেই নির্লজ্জ বীরদর্পে রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটে। অতীতের সীমাহীন অপকর্মের ভিড়ে আপনাদের লজ্জাবোধ, মানবিক চেতনা কোনোটাই আর অবশিষ্ট নেই। একজন শিক্ষকের মর্যাদা কোথায় তা বোঝার জন্য যে সুশিক্ষা দরকার তা আপনাদের নেই। পেশীশক্তির ভয়ে মানুষ আপনাদের সমঝে চলে, সম্মান করে না। তাই আজ দেশের প্রতিটি জাগ্রত বিবেক সেই অপমানিত শিক্ষককে সহানুভূতি জানাচ্ছে– আর আপনার মুখে থুতু দিচ্ছে।

এই ঘটনায় যে ভয়াবহ একটি ব্যাপার যুক্ত আছে, তা গভীরভাবে বিবেচনা করে দেখা উচিৎ। ঘটনাটির আগে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হয় যে, প্রধান শিক্ষক ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ দিয়েছেন। এটা সত্য কী মিথ্যা তা কেউ যাচাই করে দেখেনি। এই ঘোষণা কারা দিয়েছে তা মসজিদের ইমাম সাহেবও বলতে পারছেন না। লক্ষ্যণীয় যে, ঘোষণাটি দিয়ে লোকজনকে উত্তেজিত করা হয়।

ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে এই যে কূটচাল, অপরাজনীতি– এটা আমাদের সমাজের জন্য কত বড় এক অশনি সংকেত আমরা কি তা অনুধাবন করতে পারছি? ধর্মীয় অনুভূতির দোহাই দিয়ে জনতাকে উন্মত্ত করার এই অপরাজনীতির জন্য প্রতিক্রিয়াশীল জামায়াত বা জঙ্গিরা চিহ্নিত ও ধিক্কৃত। সেই একই অপকৌশল এই ঘটনায়ও ব্যবহার করা হয়েছে একজন নিরীহ শিক্ষককে শায়েস্তা করতে।

কিন্তু এবার যিনি এই অপকৌশল ব্যবহার করেছেন তিনি জামায়াতের কেউ নন, বরং উদারতা ও ধর্মীয় সহনশীলতার প্রবক্তা শাসক দলের দলীয় না হলেও, কাছের লোক। নিজ ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য এমন ভয়াবহ এক উন্মত্ততার আশ্রয় নিয়ে কাউকে যদি পার পেয়ে যেতে দেওয়া হয়, তবে তা ভবিষ্যতের জন্য কী দুর্যোগ এনে দিবে তা কি আমরা কল্পনা করতে পারছি?

এভাবে চলতে দিলে শিগগির দেশে এমন একটি পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যেখানে আপনি আমাকে দোষ দিবেন, আমি আপনাকে দিব, এ ওকে দিবে, ও তাকে দিবে। এভাবে একজন আরেকজনকে কানে ধরাবে, অন্যজন চাপাতি দিয়ে ঘাড়ে-মাথায় কোপ দিবে। জনতা উত্তেজিত হয়ে উন্মত্ত ‘মব’এ পরিণত হয়ে কোনো একজন মানুষকে ছিঁড়েখুঁড়ে কুটি কুটি করে ফেলবে!

আফগানিস্তানের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহর কথা মনে আছে? তাকে জাতিসংঘ ভবনের নিরাপদ আশ্রয় থেকে টেনে-হিঁচড়ে বাইরে এনে রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের সঙ্গে ঝুলিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। এদেশেও তেমনভাবে মানুষকে মারা শুরু হবে। নারীদের ‘জেনা’র অভিযোগ এনে মাটিতে পুঁতে পাথর ছুঁড়ে মারা হবে।

এ জন্য জনতাকে খালি একটু উস্কে দিলেই হল! ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে কী লাগেনি তা না বুঝেই, একে ছুতো হিসেবে ব্যবহার করে জনতা উন্মত্ত হয়ে যাকে-তাকে খুন করবে। বিচার করার সময় নেবে না, একবার যাচাই করে দেখবে না ঘটনা সত্যি কি না। আমরা ধীরে ধীরে পরিণত হব আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রে। শেষ হাসিটা তখন হাসবে বাংলাদেশ-বিরোধী হায়েনারা।

সুতরাং জনাব উদ্ধত রাজনীতিবিদ, যে প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়াই করেন বলে দাবি করেন, তাদের মতো যখন আপনাদের আচরণ হয় আর তাদের ধিক্কৃত রাজনীতি যখন আপনারা অনুসরণ করেন, তখন আপনারা প্রকারান্তরে দেশবিরোধী শক্তির পক্ষেই কাজ করছেন।

প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠীর ভবিষ্যতের ধর্মান্ধ রাজনীতির নিষ্ঠুরতার পথ করে দিচ্ছেন আপনারাই। সেই ধর্মীয় অনুভূতির খড়গ যে আপনাদের ঘাড়েই যে কোনো দিন উল্টে এসে পড়বে না, তার কি গ্যারান্টি আছে? ধর্মীয় অনুভূতির খড়গের কোপে আপনারই পূর্বসূরী আরেকজন, আপনার মতোই আরেক শক্তিমান নেতার রাজনৈতিক পতন কি আমরা কিছুদিন আগেই দেখিনি?

তাই, হে শক্তিমান নেতা, সাবধান। হয়তো এবার আপনার পালা|

Print Friendly, PDF & Email