May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

সুন্দরবনের মধুগেট কেলেংকারী

মাসকাওয়াথ আহ্সান : বনের রাজা খুব চিন্তিত। অশান্তভাবে পায়চারী করছেন। স্বগতঃ সংলাপের মতো বলছেন; আমার সততার শক্তি আছে; আমার ভয় কীসে! আবার বনের রাজার মনে পড়ে তিনি নিজেই বলেছিলেন, আমাকে ছাড়া আমার পরিষদের সবাইকেই মধু দিয়ে কেনা যায়। উনি নিজেকে বোঝান, আমি মানে আমার ছেলে মেয়ে আর আমার বোনের ছেলে মেয়ে। তারা কেউ এই মধুচক্রে নেই। আমি কেন মৌচাক ভেঙ্গে মধু চুরির দায় নেবো।
একটি মৌমাছি কানের কাছে ফিসফিস করে বলে, আপনি যে বনের রাজা!
মৌচাক ভেঙ্গে মধু লোপাটের ফলে ৩২ লাখ মৌমাছির জীবন ক্রমশঃ মৃত্যুর গোলকধাধায় প্রবেশ করেছে; তাতো জেনোসাইড। স্বাধীন সুন্দরবনে জেনোসাইড। বনের রাজার চোখ দুটো অশ্রুসজল হয়। স্বজন হারানোর কষ্ট কে আর তার চেয়ে বেশী ভুগেছে এতোগুলো বছর এতো নির্ঘুম রাতে। বনের রাজার পুরো পরিবারকে হত্যা করেছিলো সুন্দরবনের শেয়ালেরা। বনের রাজার বাবা সুন্দরবনের স্বাধীনতার স্থপতি। তিনি বলতেন, মৌচাক ভেঙ্গে মধু চাটার দল এই শেয়াল পাল নিয়ে কী করি!
বনের রাজাও মনের অজান্তে বলেন, এই হাইব্রিড মধুচাটার দল শেয়াল পাল নিয়ে কী করি!
ভোরবেলা মৌচাক রক্ষণাবেক্ষণ প্রধান হরিণ আসেন কান্নামাখা চেহারা নিয়ে।
—যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু নিভাইছে তব আলো
তুমি কী তাদের ক্ষমা করিয়াছো তুমি কী বেসেছো ভালো।
—কত বিশ্বাস করে আপনাকে এই গুরুদায়িত্বে নিয়োগ দেয়া হলো! আর এই তার ফলাফল।
–সুন্দরবনের প্রতিটি মৌচাক মম সন্তানসম
কী আছে এই ভূমিহরিণ আজো তৃণসম।
বনের রাজা চিন্তা করেন এই সাহিত্যিক হরিণকে মৌচাকের দায়িত্ব দেয়া ভুল হয়েছে। সৎ হরিণ; কিন্তু ভাববাদী হরিণ।
কাব্যিক হরিণ বিদায় নিতেই আসেন বনের সম্পদমন্ত্রী; একটু বয়েসী হরিণ; সবার শ্রদ্ধার।
–যদিও সন্ধ্যা আসিছে মন্দ মন্থরে
সব সংগীত গ্যাছে ইঙ্গিতে থামিয়া।
—একের পর মৌচাক ভেঙ্গে মধু চুরি; আপনি কী করলেন এতো অভিজ্ঞ হরিণ।
–মৌচাক না দেখিয়া যদি কেউ কাব্য লেখে
সেই সুযোগে শেয়াল আসিয়া মৌচাক চাখে।
বনের রাজা চিন্তা করেন, সাহিত্য একটি অভিশাপ।
এই যে একের পর এক মৌচাক ভেঙ্গে মধু চুরি হচ্ছে এর জন্য কিছুটা দায়ী সুন্দরবনের “মধুভান্ড অপার” এই নিয়ে এক পলকের ঝলক অতিউন্নয়নমূলক প্রচার। এতে মধুভান্ডের লোভে সুন্দরবনের শেয়ালেরা নানা দেশের শেয়ালদের সঙ্গে যোগসাজশ করে মধু পাচার শুরু করেছে। মধুভান্ড অপার এই কথা বেশী বেশী বলাতে গোটা ধরিত্রীর বনভূমির চোর শেয়ালদের চোখ পড়েছে সুন্দরবনের দিকে।
বনের রাজার ছেলে তথ্য প্রযুক্তি হরিণ এ ব্যাপারে অনেকবার সতর্ক করেছে। বনের তরুণ হরিণদের নিয়ে আলোচনা করেছে। কিন্তু সবাই তথ্য প্রযুক্তির আলোচনাকে একটা চড়ুইভাতি ভাবে। ফলে কাজের কথা মনে রাখেনা। হ্যাকার শেয়ালেরা দেশে দেশে সংঘবদ্ধ। তাদেরও একটি আন্ডারওয়ার্ল্ড রাজনীতি আছে; যেখানে তারা এক সঙ্গে শলা পরামর্শ করে বিভিন্ন বনের মৌচাক থেকে মধু চুরি করে।
বনের বৃদ্ধ হরিণেরা এই তথ্যপ্রযুক্তিকে একটি অভিশাপ বলে ভাবতে শুরু করেছে। এমনি যে বনে এতো শেয়াল যারা সরসরি মৌচাক ভেঙ্গে চুরি করে; সেখানে আবার হ্যাকার শেয়ালেরা জুটে গেলে তো সুন্দরবন মধুশূণ্য হয়ে পড়বে। মৌমাছি শ্রমিকেরা মারা যাবে।
দুএকজন বিবেকবান হরিণের মনে হয় এই মধুচুরি ঠেকাতে বনের রাজা ব্যর্থ হওয়ায় প্রতিবাদ হিসেবে নিজের “ম্যানগ্রোভ পদক” ফেরত দিয়ে আসবে। পাশের বৃন্দাবনে বন ব্যবস্থাপনায় অসন্তুষ্ট হয়ে ১৩০ জন হরিণ “পদ্মপদক” ফেরত দিয়ে এসেছেন। সুন্দরবনের অন্ততঃ ১৩ জন হরিণের এ সতসাহস দেখানো প্রয়োজন।
পরে বিবেকবান হরিণেরা পুঁতিয়ে যান।
–থাকনা। হাজার হলেও ম্যানগ্রোভ পদক।
সুন্দরবনের শেয়ালেরা দুটি শিবিরে বিভক্ত। বৃন্দাবনপন্থী ও জলপাইবনপন্থী। পেশা মৌচাক ভেঙ্গে মধু চুরি। এদের কাজ কাম তেমন নেই। বৃন্দাবনপন্থীরা মৌচাক ভেঙ্গে মধু খেলে জলপাইবনপন্থীরা সততার পোড়াকাষ্ঠ হয়ে ওঠে। অথচ কিছুকাল আগে জলপাইবনপন্থীরা মৌচাক ভেঙ্গে মধু খেয়েছে। সে কথা যেনো কারো মনে নেই!
সুন্দরবনে হরিণেরা শেয়ালদের ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত জীবন যাপন করে। আপোষ করে টিকে থাকতে হয় বনে। কেউ প্রতিবাদী হলেই শেয়ালেরা সে হরিণকে গুম করে দেয়। শেয়ালদের শ্বশুরেরা বনব্যবস্থাপনায় থাকায় সাত হরিণ খুন মাফ হয়ে যায়।
মৌচাক থেকে হ্যাকার শেয়ালদের মধুচুরি নতুন ধরণের ঘটনা। সুন্দরবনে অনেক তথ্যপ্রযুক্তি কবি-গায়ক হরিণ আছে। কিন্তু এ বিষয়ে অভিজ্ঞ মানুষের অভাব।
এক চিন্তাশীল হরিণ জানায়, এরকম মধুচুরির ক্ষেত্রে সুন্দরবনের হ্যাকার শেয়ালেরাও জড়িত। ফিলিবনের হ্যাকাররা রিসিভিং এন্ডে ছিলো; সেন্ড করা হয়েছে সুন্দরবনের হ্যাকারদের মাধ্যমে যারা কোন না কোনভাবে মৌচাক পাহারার সঙ্গে জড়িত।
এসময় বৃন্দাবনপন্থীরা এসে জিজ্ঞেস করে, কে এই হরিণ; এতো চিন্তা কোত্থেকে আইলো! সে একটা জলপাইবনপন্থী ষড়যন্ত্র।
মৌচাক থেকে হ্যাকিং-এর মাধ্যমে মধু পাচার এবিষয়ে সুন্দরবনে বিশেষজ্ঞ হরিণ না পেয়ে বৃন্দাবন থেকে এক তথ্য প্রযুক্তি হরিণকে নিয়ে আসা হয়।
অমনি জলপাইবনপন্থীরা চেঁচিয়ে ওঠে, বৃন্দাবনের তথ্যপ্রযুক্তি আমগো মধুভান্ডের চাবি নিয়া যাইবো। এইডা নতজানুনীতি। বৃন্দাবনের কাছে সুন্দরবন লিজ দিছে।
হঠাত একপাল শেয়াল যারা কে এই হরিণ; সে জলপাইবনপন্থী বলেছিলো; তারা ধরে নিয়ে যায় চিন্তাশীল তথ্য প্রযুক্তি হরিণকে যে একথাও বলেছে, অন্যবনের তথ্যপ্রযুক্তি হরিণরা মৌচাকের বাইরের কাঠামোতে কাজ করতে আসে। শুধু বৃন্দাবন নয় অন্যান্য বন থেকেও আসে। তারা কখনো মৌচাকের ভেতরে ঢুকে কাজ করে না।
নিখোঁজ হরিণকে নিয়ে শেয়ালেরা গুজব রচনা করতে থাকে। গুজবের বিনিময়ে মধু(গুম) প্রকল্পের অধীনে এই শেয়ালেরা আজকাল মোটাতাজা হয়েছে। বনের রাজা একরকমের জিম্মী ভাববাদী হরিণ ব্যবস্থাপক আর মধুচাটাবাদী শেয়ালদের মাঝে।
রাজা তার সন্তান তথ্য প্রযুক্তি হরিণকে জিজ্ঞেস করেন, এতো বছর ধরে সুন্দরবনে ডিজিটাল ট্রেনিং দিয়ে কোন বিশেষজ্ঞ তৈরী হলো না কেন?
–সুন্দরবনে হরিণের গান কবিতা আর শেয়ালের মধুনেশা ছাড়া আর কিছুই কী সম্ভব!
–মাঝখান থেকে খেটে মরে শ্রমিক মৌমাছিরা।
–আমি সম্ভব সব চেষ্টা করেছি। ফেসবুকে ফেইক আইডি দিয়ে গালাগালি; ব্লগিং করে ঝগড়াঝাটি দিয়ে শেয়ালরা যদি ডিজিগাল হয়ে ওঠে; তারজন্য কী আমি কী দায়ী!
—হরিণদের মাঝে কাউকে পেলেনা!
–তারাতো সাহিত্যিক!
–সাহিত্য একটি অভিশাপ; তথ্য প্রযুক্তিও।
বনব্যবস্থাপনার দায়ে নিয়োজিত শেয়ালদের কাছে গিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি হরিণ হারিয়ে যাবার অভিযোগ করতে চেষ্টা করে তার পরিবারের সদস্যরা। শেয়ালরা পাত্তা দেয়না। হরিণের মা মূর্ছা যান। হরিণের সন্তান পিতার অপেক্ষা করতে থাকে। হরিণের স্ত্রী বলে, আপনারা শেয়ালেরা যদি তাকে গ্রেফতার করে থাকেন সেটাও জানান। বেঁচে আছে কীনা তা অন্ততঃ জানান।
এই অসহায় হরিণ পরিবারের পাশে অন্য হরিণেরা কেউ দাঁড়ায় না। সুন্দরবনে থাকতে গেলে এখন শেয়ালদের মন যুগিয়েই চলতে হবে।
থমথমে নীরবতায় সুন্দরবন হয়ে পড়ে এক জীবন্ত বধ্যভূমি।
সূত্র : লেখাটি ফেসবুক পাতা থেকে নেয়া।

Print Friendly, PDF & Email