April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

চুম্বন বিপ্লব

মাসকাওয়াথ আহসান : কয়েকজন তরুণ-তরুণী “হোক চুম্বন” নামে একটি ইভেন্ট ডেকে ফেলে। এর আগে কলকাতার তরুণ-তরুণীরা এমন একটি প্রতীকী প্রতিবাদী ইভেন্ট করেছিলো কলকাতায়। কিন্তু ঢাকায় “হোক চুম্বন” ইভেন্টের ডাক শুনে সবাই নড়েচড়ে বসে। কারো কারো মাথায় বাজ ভেঙ্গে পড়ে। চারিদিকে গেলো গেলো রব ওঠে।
রাগে আগুণ শর্মা হয়ে যায় বখতিয়ার চুম্বন টিম। তারা পালটা ইভেন্ট ডাকে “ হোক চাপাতি চুম্বন”। অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে এই ইভেন্ট যদিও তারা নিয়মিতই করে থাকে। “চাপাতি চুম্বন” ইভেন্ট নিয়ে পুলিশ চিন্তিত হয়ে পড়ে। কারণ এসব সমাজে যত দোষ পুলিশ ঘোষ হওয়ায় কোথাও এই ইভেন্ট শুরু হলেই সবাই পুলিশকে গালাগাল করে। নাগরিকেরা বছর বছর “চুম্বন নয় সন্তান” উতপাদনের জন্য পুলিশের পরামর্শ নেয় না; কিন্তু তাদের উতপাদিত অসংখ্য পণ্য দেখে শুনে রাখার দায় শুধুই যেন পুলিশের।
হোক চুম্বন ইভেন্টটি সমাজের নানাস্তরে অভিঘাত সৃষ্টি করে। সংস্কৃতির ঠিকাদাররা তেতে ওঠে।
–এতো বড় সাহস! আমাদের সংস্কৃতিতে যে কোন অনুষ্ঠানের উইংসের আড়ালে চুম্বন গ্রহণীয়; কিন্তু লোক-সমাজে নয়।
–কৈ রবীন্দ্রনাথ-নজরুল তো প্রকাশ্যে কাউকে চুম্বন করেন নি; আমরা করবো কেন!
–হ্যারা আমগো সংস্কৃতিতে অসভ্যতা আমদানী করতেছে। ছি!
রাজনীতির ঠিকাদাররাও বড্ড বিরক্ত। তারা মনে করে নেতাদের পদচুম্বন ছাড়া আর কোন চুম্বন নেই; থাকতে পারেনা। সুতরাং “হোক নেতার পদ চুম্বন” নামে একটি পালটা কর্মসুচী নেয়া হয়। ঠিক করা হয় কয়েকজন নেতাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে পদচুম্বন করা হবে।
ওদিকে হাটহাজারী কেঁপে উঠেছে কয়েকজন নাশতেকের “হোক চুম্বন”-এর ডাকে।
–এত্তো বড় সাহস। এরা কী জানে না হুজুরের হস্ত চুম্বন ছাড়া আর কোন চুম্বনের অনুমোদন এইখানে নাই।
–বিশেষ দূত আইসা হুজুরের হস্ত চুম্বন করার পর এইডা নিয়া তো আর কোন কনফিউশন থাকার কতা নয়।
সুতরাং “হোক হুজুরের হস্ত চুম্বন”।
নড়েচড়ে ওঠে আমলারা। তারা মনে মনে হাসে।
–যত সব বোকার দল। পৃথিবীতে ঘুষ-চুম্বন ছাড়া আর কোন চুম্বন এতো সুস্বাদু নয়।
আমলাদের একটি অংশ গোপনে “হোক ঘুষ চুম্বন” নামে একটি ইভেন্ট ডাকে। সেখানে একটি খামে চুম্বনের মাধ্যমে ইভেন্ট উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়। ক্লায়েন্টদের ভেন্যুর কথা জানিয়ে দেয়া হয়।
–প্রিয় ক্লায়েন্ট বৃন্দ; খামের মধ্যে এমন কিছু দেবেন যাতে চারবছরে নিউইয়র্কে তিনটি বাড়ী কেনা যায়।
অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিরা যারা দলবাজী করতে গিয়ে শুধু রায় দিয়েছেন; কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায় লেখার সময় পাননি; তারা “আন্ধার মানিক চুম্বন” ইভেন্ট খোলেন।
–ভাইসব ইভেন্টটিকে সফল করুন; প্রধান বিচারপতিকে মাইনকার চিপায় ফেলুন।
কিছু লেখক-কবি স্পষ্ট জানিয়ে দেন; শুদ্ধতম সংস্কৃতির চর্চা চাই। প্রকাশ্যে চুম্বন কেন! প্রয়োজন হলে ৩৬ চৌরঙ্গী লেনে বা লিটনের ফ্ল্যাটে যাও। আমরা চুম্বন করবো আমাদের নিজের লেখা গ্রন্থ। আপনারা এই বুকফিতে আমন্ত্রিত।
সাহিত্য সম্পাদক সমিতি লেখক-কবিদের ধমক দিয়ে বলে, আমাদের “হোক সাহিত্য সম্পাদকের হস্ত চুম্বনে” যোগ না দিলে আপনার গ্রন্থ সৃজনশীল বা মননশীল এমন সার্টিফিকেট আমরা ক্যানো দেবো। ফ্যান ফেয়ারের মধ্যে যারা আপনাদের তারকা বানায়; তাদের ভুলে যাবেন কেন!
শুদ্ধ স্বৈরাচারী জনপ্রিয় কবি তার আত্মজীবনী গ্রন্থের অটোগ্রাফ দিতে দিতে বলেন, থাকনা এই বৃথা কোন্দল। চুম্বন চুম্বনই। হুজুরের হস্ত চুম্বনেও আছি, গ্রন্থ চুম্বনেও আছি আর…
মুচকি হাসি দিতে দিতে তিনি একজন উর্বশী রম্ভার হাতে অটোগ্রাফ দেন।
এস এসসি পরীক্ষার্থীদের একটি অংশ বলে, ওসব বড়দের ব্যাপার। আমরা চলো “হোক ফাঁস কোশ্চেন পেপার চুম্বন” ইভেন্ট করি।
অভিভাবক সমিতি অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে “হোক জিপিএ ফাইভ চুম্বন” ইভেন্ট পালন করেন।
হাওয়া ভবন আশেকান সমিতি পিছিয়ে থাকবে কেন; তারা উদ্যোগ নেয় “টেন পার্সেন্ট” চুম্বন ইভেন্ট করবে। কারণ দীর্ঘদিন সে চুম্বনের দেখা নেই। অন্ততঃ স্মৃতিটুকু থাক।
সুবাতাস ভবন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। তারা হাসিখেলার ছলে “ হোক সুইস ব্যাংক চুম্বন” ইভেন্ট খুলে ফেলে। সুবাতাস ভবনের ছোট-খাট ফেউগুলো ভাবে, আমগো অতবড় ইভেন্টে চুমু দিয়া লাভ নাই। আমরা “দোয়েল পাখী চুম্বন” ইভেন্টেই খুশী।
তারুণ্যের একটি অংশ যারা ফেনসিডিল বা ইয়াবার নেশায় বুঁদ তাদের মধ্যে কোন্দল বেধে যায়। তাদের ইভেন্টটা ফেনসি চুম্বন নাকি ইয়াবা চুম্বন হবে এই নিয়ে বচসার অবসান ঘটাতে একজন অভিজ্ঞ মাদকাসক্ত বলে, আহা এইডারে “হোক ফিলিংস চুম্বন” নাম দিলেই তো হয়।
সর্বদলীয় জমিজমা দখল সমিতি সিদ্ধান্ত নেয় তাদের তারা তাদের ইভেন্টে অন্যধর্মের মানুষের বাড়ী-জমিতে চুমু দিয়ে আসবে।
“হোক মালাউ-র জমি চুম্বন”।
এসময় অনাবাসীরা তাদের বিদেশী পাসপোর্টে চুম্বন ইভেন্ট খোলে। মাথায় বাংলাদেশের পতাকা বেঁধে এমেরিকা-বৃটেন-জার্মানীসহ নানাদেশের অনাবাসীরা তাদের পাসপোর্টফি ছবি আপলোড করে ফেসবুকে।। এই ইভেন্টে নাশতেক চুম্বন টিম এবং বখতিয়ার চাপাতি চুম্বন টিম একযোগে অংশ নেয়। সর্বদলীয় ঐকমত্য অনাবাসী-সমাজ বিদেশী পাসপোর্টে চুম্বন ইভেন্টটিকে সফল করার জন্য একযোগে কাজ শুরু করে।
এসব দেখে খুব বিরক্ত হয় টকশো কথকেরা; নিয়মিত লিপসার্ভিস দেয়াই যাদের পেশা তারা ছাড়া আর কেউ চুম্বন ইভেন্ট খোলার যোগ্যতা রাখেনা বলে তারা বিবৃতি দেয়।
গানের মাস্টার ও আমসিপারা মাস্টারদের পেডোফাইল অংশটিই বা পিছিয়ে থাকবে কেন। কিছু কন্ঠ শীলন শিক্ষক, থিয়েটার শিক্ষক, ফিল্ম ডিরেক্টর, প্রোডিউসার শিক্ষক, মডেলিং শিক্ষক গোপনে গোপনে অংশ নেয় “গোপন চুম্বন” ইভেন্টে। আবার সৌখিন শিক্ষকরা নিজেদের চেম্বারে বসেই এই ইভেন্টে অংশ নেবার মনস্থির করে। অভিজাত গৃহস্বামীদের একটি অংশ “ন্যানী চুম্বন” নামে ইভেন্ট খোলে।
দেশপ্রেম নিয়ন্ত্রণ সমিতি দৃঢ় কন্ঠে এসব চুম্বন ইভেন্ট বাদ দিয়ে; দেশের জন্য কান্না কর্মসূচী গ্রহণ করে। এটা দেখে ঠোঁটকাটা লোকেরা যারা চুম্বন টুম্বনের ধার ধারে না তারা বলে, এগুলোও আসলে “রাষ্ট্রীয় পদক” চুম্বনের থিয়েটার।
দেশদ্রোহী অংশটি এরি মাঝে কাদের মোল্লার কবর ও পাকিস্তানের পতাকা চুম্বনের প্রস্তুতি নেয়। আরেকটি অংশ ভারতের পতাকায় চুম্বন দিয়ে কাজ সেরে নেয়।
চুম্বনের ইভেন্ট খোলা দেখে এলিট ফোর্সের লোকেরা মুচকি হাসে, সারা বছর “হোক গুম-চুম্বন” করতেছি; এরজন্য আবার ইভেন্ট লাগে নাকি!
ওদিকে কারাগারের পরিবর্তে হাসপাতালে রাজার হালে বসে নকল রোগী রাজার জামাইয়েরা “সাতখুন মাফ চুম্বন” ইভেন্টে অংশ নেয়।
চুম্বন বিষয়টির প্রতি তীব্র বিবমিষা এসে যায় সাধারণ মানুষের। সবাই মনে মনে চুম্বনের সুন্দর কিছু ছবি খোঁজে। তন্ন তন্ন করে খুঁজে পাওয়া যায় কেবল একটি ছবি। গ্রামের একটি নীল শার্ট পরা শিশু স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে নতুন ক্লাসের নতুন বইয়ে এঁকে দিচ্ছে স্বপ্ন-চুম্বন।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক (লেখাটি ফেসবুক থেকে নেয়া।)

Print Friendly, PDF & Email