মো: মনির হোসেন: দিনটি ছিল ৩রা মার্চ। বাংলাদেশে যখন রোদ্রঝরা পড়ন্ত বিকেল তখন আমেরিকায় কাক ডাকা ভোর। তখনও ভোরের ঘুমেই আচ্ছন্ন ছিলাম। অন্যদিকে দেশে চলছিল জাফর ইকবাল স্যারকে জীবন নদীর ওপাড়ে পাঠিয়ে দেওয়ার হীন প্রচেষ্টা। অসংখ্য কোমলমতি মানুষের প্রাণভরা ভালবাসায় হয়ত সৃষ্টিকর্তা এ’যাত্রায় স্যারকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। স্বস্তি ফিরে পেলাম, অন্তত স্যার প্রাণে বেঁচে আছেন বলে। কিন্তু ঘোর এখনো কাটেনি। বার বার আৎকে উঠছি। নানান দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করছে। স্যারকে যদি মহান আল্লাহ এ’যাত্রায় রক্ষা না করতেন! তাহলে কি হতো?
একজন জাফর ইকবাল চলে গেলে আমরা এমন কিবাই করতে পারতাম! কিন্তু এভাবে কত দিন চলবে? শুধু একটাই ভয় না জানি “যায় দিন ভাল আসে দিন খারাপ” এ কথাটি সত্যি হয়ে যায়। আজকাল তাই বড্ড ভয় হয়।
জাফর ইকবাল স্যারকে যখন ওসমানী মেডিকেলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল তখন পরিচিত নানা জনকে কল দিচ্ছিলাম। শুধু এতোটুকু জানার চেষ্টা করছিলাম স্যার শংঙ্কা মুক্ত হয়েছেন কিনা। ইতোমধ্যে ফেসবুকে এই ন্যাক্কার জনক ঘটনার কিছু ছবি দেখতে পেলাম। ছবিগুলো একটুখানি পরখ করে দেখলাম। স্যার একটা বই পড়ছিলেন। কুলাঙ্গারটা ঠিক স্যারের পিছনে দাড়িয়ে আছে। স্যারের সাথে কুলাঙ্গারের পজিশনটা ছিল বেশ ক্রিটিক্যাল। মহান সৃষ্টির্কতা দয়া না করলে হয়তো প্রশিক্ষিত কুলাঙ্গারের একটা আঘাতই স্যারকে পরপারে পাঠিয়ে দিতে যথেষ্ট ছিল। ছবিতে আরেকটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেছি-পুলিশের অপেশাদারিত্ব। ছবিতে দেখেছি স্যারের পিছনে এবং দুপাশে কোন পুলিশ নেই। পুলিশ খানিকটা দূরে মোবাইলে ব্যস্ত ছিল। ফলে অনেকের মতন আমার মনেও নানা রকমের প্রশ্ন ওলোট-পালট খাচ্ছে। তবে সেই ডিটেক্টিভ বিষয়ে আজ সমাচার করতে চাচ্ছি না।
প্রায় এক যুগের বেশি সময় পাহাড় ঘেড়া প্রিয় শাবির সবুজ ক্যাম্পাসে ছিলাম। সেই ২০০৫ থেকে ২০১৭। মেঘে মেঘে কখন যে এক যুগ পাড়ি দিয়েছি টেরই করতে পারিনি। তবে পিছনে ফিরে তাকালে অতীতের সাদা-কালো দাগগুলো জানান দেয় যে বেলা হয়েছে বৈকি! গত ডিসেম্বরে উচ্চ শিক্ষার্থে আমেরিকায় পারি জমিয়েছি। দূর প্রবাসে বসেও সাম্প্রতিক ঘটনা এবং অতীত ঘাত-প্রতিঘাতের স্মৃতিগুলো মনটাকে যেমন ভারাক্রান্ত করছে তেমনি আতঙ্কিতও করছে বারবার। সেই আতঙ্কের দু-একটি কারন নিয়ে খানিকটা আলোকপাত করতে চাই আজ।
সেই ২০০৬ সালের কথা। প্রথম বর্ষের দ্বিতীয় সেমিস্টারে উঠেছি মাত্র। প্রশাসনের হেয়ালীপনায় পুলিশের গুলিতে তিন জন ছাত্র গুলিবিদ্ধ এবং এক জন নিহত। ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল তুচ্ছ একটা বিষয় নিয়ে। প্রশাসন ইচ্ছে করলে অঙ্কুরেই সামাল দিতে পারতেন। কিন্তু তা করেননি। ফলে উত্তাল শাবি। সাথে যোগ হল ভিসি প্রফেসর মোসলেহ উদ্দীনের দু:শাসন আর অপশাসনের উপাখ্যান। শুরু হল ভিসি বিরূধী আন্দোলন। আন্দোলন করছেন মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ আর সাধারন ছাত্র-ছাত্রী। অন্যদিকে স্বাধীনতার বিরুদ্ধ শক্তিতে বিশ্বাসী শিক্ষকগণ ভিসিকে রক্ষার প্রাণান্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিভিন্ন ভাবে জাফর ইকবাল স্যার এবং ম্যাডামকে প্রাণ নাশের হুমকি দিচ্ছিল। অপশক্তি শুধু হুমকি দিয়েই থেমে থাকেনি, স্যারের বাসার সামনে বোমা র্পযন্ত মেরেছিল। সেদিনও মহান সৃষ্টির্কতার কৃপায় স্যার ও তার পরিবার প্রাণে বেঁচে যান।
একদিন দেখলাম,জামাত বিএনপির শিক্ষকগণ লাইব্রেরি বিল্ডিংয়ের সামনে ভিসি রক্ষার সমাবেশ করছেন। একটু দূরে দাড়িয়ে বক্তাদের কথা শুনছিলাম। হঠাৎ দেখি একজন শিক্ষক বেশ উত্তেজিত হয়ে গেলেন। তিনি বললেন- এই ক্যাম্পাসে একটা সাদাসিধে কলামের মালিক কুকুরের মতন ঘেঁও ঘেঁও করে চলেছে। আজো যখন এই শিক্ষকে দেখি তখন প্রচন্ড ঘৃণা বের হয়ে আসে। ভেবেছিলাম জাফর ইকবাল স্যার হয়তো এই অপমানে এক বুক ব্যাথা নিয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে চলে যাবেন। কিন্তু গেলেন না, স্যার থেকে গেলেন। কেননা জাফর ইকবালরা হাল ছাড়তে জানেনা, তাঁরা জানেনা ঘৃণা করতে, শুধু জানেন ভালবাসতে। কি অপূর্ব!
জাফর ইকবাল স্যারের স্বপ্ন ছিল শাবি ক্যাম্পাসকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিতে বিজরীত করবেন। ক্যাম্পাসের পরতে পরতে থাকবে একাত্তরের স্পর্শ, বায়ান্নের স্মৃতি। সে নেপথ্যেই শাবির সবুজ গোল চত্বরে স্যার চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের উচু ভাস্কর্যটি স্থাপন করতে। তখনকার ভিসি প্রফেসর সালেহ উদ্দীন স্যারও বেশ সাপোর্ট দিয়েছিলেন। এমন সময় সিলেটের র্ধমান্ধ মানুষগুলো জেগে উঠলেন। তারা সিলেটের পুন্য ভ‚মিতে মূর্তি স্থাপন করতে দিবেনা। কতিপয় ডানপন্থি শিক্ষক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমর্থন দিলে সেই র্ধমান্ধ মানুষগুলোর উত্তেজনা আরো এক ধাপ বেড়ে যায়। এক দিন দেখলাম শিক্ষক সমিতির এক মিটিংয়ে এক প্রফেসর বক্তব্য দিতে গিয়ে বলে উঠলেন-সিলেটের এই পুন্য ভ‚মিতে কোন মূর্তি স্থাপন করতে দিবোনা। জীবন দিয়ে হলেও দিবোনা। চেতনা ৭১ নামে যেটা আছে সেটাও ভেঙ্গে ফেলবো। সেদিন সেই প্রফেসরের কথা শুনে তাৎযব বনে গিয়েছিলাম। বিশ^বিদ্যালয়ের অদূরেই মদীনা র্মাকেট। সেখানে প্রায় প্রতি দিনই এলাকার মানুষজন সমাবেশ করতেন। জাফর ইকবাল স্যারকে নাস্তিক-মুরতাদ বলে রব তুলতেন। শুনতে লাগলাম এলাকাবাসী বিশ^বিদ্যালয়ে এসে হামলা করবে। তার উপর সিলেটের রাজনৈতিক নেতারাও এলাকাবাসীকে সমর্থন দিতে লাগলেন। পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হতে লাগলো। এক সময় ভিসি স্যার বাধ্য হয়ে ভাস্কর্য স্থাপন বন্ধ করে দিলেন। সেই ২০১২ সাল থেকে আজ অবধি ভাস্কর্যটি বাস্তবে রুপ নিতে পারেনি। জাফর স্যারের সেই স্বপ্নটি অধরাই থেকে গেল। বারবারই এরকম অনেক ঘটনায় আহত হয়েছি, নিবারণ কষ্ট পেয়েছি, দু:খ পেয়েছি, কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। এরকম একজন বাতিঘরের স্বপ্ন-ভাঙ্গা গল্পের কথা আর কত বলবো, আর কত শুনব?
বাংলায় একটা প্রবাদ আছে-ঘরের ইদুরই বেড়া কাটে। শাবি পরিবারের একটা বড় অংশ আজো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জীবনের মধ্যে, কাজের মধ্যে, মনের মধ্যে ধারন করে না। যদিও তারা আক্ষরিক অর্থে সময়ে-অসময়ে ব্যানারে ধারন করে। তাদেরকে নিয়েই যত শংঙ্কা। এক যুগ ধরে যা দেখেছি তাতে মোটেও শাবিতে মুক্ত বুদ্ধির, মুক্ত র্চচার পরিবেশ আছে বলে মনে হয়নি। তবুও স্যার এই ক্যাম্পাসে টিকে আছেন, ক্যাম্পাসটিকেও প্রানবন্ত রেখেছেন মুক্ত বুদ্ধি আর মুক্ত র্চচার মাধ্যমে। আর সেটি কেবল সম্ভব হয়েছে তিনি এক জন জাফর ইকবাল বলেই। তাঁর এই অসীম মমত্ববোধে প্রায়শই আবেগে আপ্লুত হই, টলমলে চোখে খানিকটা ঝাঁপসা দেখি, কিন্তু কিছুই করতে পারিনা।
জাফর ইকবাল স্যার পরম মমতায় দেশের জন্যে, জাতীর জন্যে, ছোট ছোট বাচ্চাদের জন্যে, এদেশের সাড়ে চার কোটি স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্যে নিরলস কাজ করে চলেছেন। বিনিময়ে তিনি কিছুই পাননি। পেয়েছেন শুধু নিছক সমালোচনা। মুক্তিযুদ্ধের সরকারও যে স্যারের সাথে ভাল ব্যবহার করেছেন তাও দেখিনি। বরং দেখেছি কখনো কখনো চোখ রাঙ্গাতে। তার কারনও ছিল যথেষ্ট। কেননা তিনি তথাকথিত সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবীদের থেকে খানিকটা হলেও আলাদা। তিনি সাদাকে সাদাই বলেন আর কালোকে কাল। তিনি কখনো কোন হীন স্বার্থে সত্য থেকে এক বিন্দু সরে আসেননি। আর তাইতো দেখেছি তিনি মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর পুত্রের সমালোচনা করতে। সমালোচনা করতে দেখেছি ক্ষমতাসীন দলের প্রধানের। আর সেজন্যেই তিনি জাফর ইকবাল। সত্যের এক নির্বীক অগ্র পথিক। এ ধরনের এক জন জাফর ইকবাকে আমরাতো যুগে যুগে পাবোনা। এ ধরনের এক জন খাঁটি শিক্ষক, খাঁটি দেশপ্রেমিক, প্রকৃত মানুষ ক্ষণজন্মা হয়ে থাকেন। সৃষ্টিকতা জাফর ইকবালদের তার ধরনীর বুকে যুগে যুগে পাঠাননা। তাঁরা কালোত্তীর্ণ। শুধু ব্যথা একটাই আমরা এই জাফর ইকবালদের মূল্য দিতে পারিনা। পারিনা তাদের কদর করতে, পারিনা একটুখানি ভালবাসতে।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, ফুড ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড টি টেকনোলজি বিভাগ, শাবিপ্রবি
(বর্তমানে পি.এইচ.ডি অধ্যয়নরত, অর্বান বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকা)
এ বিভাগের আরো..
অতিরিক্ত ভালোবাসা ঠিক নয়
সংসদ সদস্যকে আইন প্রনয়ন নয়, মানতেও হবে
জাতীয় চারনেতা হত্যা নেপথ্যে থাকা কুশলীব কারা