May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

ঘাটাইল উপজেলার প্রথম হানাদার প্রতিরোধে শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্য

মোঃ আঃ বাছেত করিম : শহীদ বুদ্ধিজীবী প্যারী মোহন আদিত্যের জীবন বোধ, মানস-ভুবন ও স্বরুপ সঠিক ভাবে অনুধাপনের জন্য সমকালীন সময়ের ইতিহাস ও পরিস্থিতির উপর আলোকপাত করা একান্ত প্রয়োজন। সময়ের প্রভাবকে অগ্রহ্য করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়, তাই এ যুগের সময়ের ও ঘটনাবলীর প্রভাব নিঃসন্দেহে প্যারী মোহন আদিত্যের জীবন ও মনোজগৎ প্রভাবিত করে। আবার সমভাবে প্রভাবিত করে সমাজ ও সংস্কৃতিকে। প্যারী মোহন আদিত্য শেষ জীবনে উপনীত হতে পারেননি, স্বাধীনতার বেদীমূলে আত্মোৎসর্গ করে অমর হয়েছেন।
বন্ধু ও বন্ধুপ্রতীম সহকর্মী, সহযোদ্ধা এবং এলাকার লোকজন প্যারী মোহন আদিত্যকে প্রত্যক্ষ করেছেন বিদগ্ধ পন্ডিত ও অসাধারণ একজন ভালো মানুষ হিসেবে। তিনি ছিলেন, ধার্মিক। ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের ভক্ত, সৎসঙ্গ সংবাদের সহ সম্পাদক এবং সাংস্কৃতিক কর্মী ও সমাজসেবক। কিন্তু ধর্মীয় গোড়ামী ও কুসংস্কারকে তিনি কোন দিন প্রশ্রয় দেননি। ধর্মকে তিনি গ্রহন করেছেন আত্মিক ও নৈতিক উন্নতির পদ্ধতি হিসাবে যার সাথে রয়েছে হৃদয়ের সম্পর্ক, আত্মার সম্পর্ক। দেশকে স্বাধীন করার জন্য যেসব বীর আত্মহুতি দিয়েছেন, প্যারী মোহন আদিত্য তাঁদেরই একজন। স্বাধীনতার পরে আমরা একে একে অনেকেই ভুলে গেছি, ইতিহাসেও স্থান নেই অনেকের। কিন্তু ইতিহাসে স্থান না মিললে কিংবা স্বীকৃতি না মিললেও প্রকৃতি ও দেশের মাটি সেই সব বীর শহীদদের স্মরনে রাখবে চিরদিন।
’৭১ এ নিজের আজবিন সাধনার স্থান, শৈশব ও যৌবনের কর্মভূমি সৎসঙ্গ আশ্রম ছেড়ে চলে গেলেন প্যারী মোহন আদিত্য। তাঁর আত্মোৎসর্গের বিনিময়ে স্বাধীন দেশের আলো-বাতাস গ্রহনের অধিকার পেয়েছি আমরা। মুক্তিযুদ্ধে শহীদরা সর্বস্ব দিয়ে জয়ী হয়ে গেলেন। তাঁরা দেশপ্রেমিক তাই মরণজয়ী, কালজয়ী। মহাকলের ¯্রােতে আমরা ভেসে যাব। কেউ মনে করুক বা না করুক কিন্তু প্যারী মোহন আদিত্য থেকে যাবেন দেশের মাটিতে, গ্রামের মানুষের অন্তরে এবং সৎসঙ্গের ইতিহাসের পৃষ্ঠায়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতের প্রথম প্রহরে পশ্চিম পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সেনারা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় ’অপারেশন সার্চ লাইট” নামে নিষ্ঠুর হত্যাযঞ্জ চালালে ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষিত হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সেনারা সারাদেশ দখলের উদ্দেশ্যে টাঙ্গাইল হইতে ১৩/১৪ মাইল উত্তর দিকে কালিহাতি, হামিদপুর সেতুর উভয় প্রান্তে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে ওত পেতে থাকা টাঙ্গাইল জেলার সর্বদলীয় স্বাধীন বাংলা গণমুক্তি পরিষদ কর্তৃক নির্বাচিত সশস্ত্র গণবাহিনীর অধীনায়ক জনাব আব্দুল লতিফ সিদ্দিকীর তত্ত্বাবধানে জনাব আব্দুল কাদের সিদ্দিকীর উপস্থিতিতে সুবেদার আব্দুর রহিমের কমান্ডিং ই,পি,আর মুক্তিবাহিনী কর্তৃক প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনী আক্রান্ত হয়। এই প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীর একজন মেজর সহ বেশ কিছু সেনা সদস্য নিহত ও ৩/৪টি সমরাস্ত্র ভর্তি গাড়ি নদীতে পড়ে ধ্বংশ হয়। অভূতপূর্ব ও অনাকাঙ্খিত গতিতে পাকিস্তানী হানাদারা বেপোয়ারা, ক্ষিপ্ত ও হিংস্্র রুপ নিয়ে পরের দিন উত্তর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। তারা সড়কের উভয় পাশের ঘরবাড়ি ও দোকানপাট আগুন দিয়ে পুড়িয়ে রকেট সেল নিক্ষেপ সহ গুলি করে হত্যা করতে করতে এগুতে থাকে।
এমনই বেশ কয়েকটি রকেট সেল দিয়ে ঘাটাইল থানা হতে মাইল চারেক উত্তরে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র প্রতিষ্ঠিত সৎসঙ্গ আশ্রমে আঘাত হানে। যার ফলে আশ্রমের মঠটি ধ্বংশ হয়। নাট্যকার, লেখক ও সাংবাদিক আছে সন্দেহে আশ্রমে ঢুকে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের প্রতিকৃতিতে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনী গুলি করার পর, প্যারী মোহন আদিত্য পাশে ধ্যান অবস্থায় থাকায় তাঁকে মুর্তি ভেবে আর গুলি না করে আসবাবপত্রে আগুন ও বাদ্যযন্ত্র ভাংগ চুড় করে সেদিন চলে যায়। প্যারী মোহন আদিত্য সেদিনের মতো প্রণে বেঁচে যান। ২১শে মে আবার পাকিস্তানী ঘাতকরা পাকুটিয়াতে তাঁেক ধরে ফেলে এবং তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে। কৌশলে পালিয়ে বাচঁতে সক্ষম হন প্যারী মোহন আদিত্য।
জুলাই মাস থেকে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আরো তীব্র আকার ধারণ করে। ১১নং সেক্টরের কাদেরীয়া বহিনীর হেড কোয়াটার কোম্পানীর কমান্ডার খোরশেদ আলম তালুকদার (বীরপ্রতীক) কোম্পানীসহ পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে অবস্থান করছিলাম। আমি ছিলাম এই কম্পানীর জোয়াদের মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ। প্যারী মোহন আদিত্যও আমাকে খুবই ¯েœহ করতেন। আজ তাঁর ¯েœহ ও ভালবাসার কথা মনে হলেই আমার চোখে জল আসে। ১৯৭১ এর ৮ আগষ্ট আরারও আশ্রমের চর্তুরদিক পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ঘিরে ফেলে। প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু হয়। স্বাধীনতার মর্ম বানীকে হৃদযে ধারন করে নির্ভীক এই অভূত ভয় বাঙালী সূর্য় সন্তান প্রতিরোধ জানাতে গিয়ে তাঁর বুক ও পেটের দিকটা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। হানাদারদের বেনেটের খোাঁচয় এবং বুটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে (শহীদ হন) দেশ মাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করেন। তবে এই মৃত্যু নিছক মৃত্যু নয়, তাঁর এই মৃত্যু বাংলাদেশ স্বাধীনতার ইতিহাসে চির ভাষ্যর হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। থাকবে চির উজ্জল ও চির অম্লান হয়ে।

Print Friendly, PDF & Email