May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

মুক্তিযুদ্ধের এক শহীদ বুদ্ধিজীবীর কথা

গোপাল চন্দ্র ভদ্র : মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নতুন প্রজন্মের কোন অভিজ্ঞতা নেই, তারা অনুভব করবে কী করে? ’৭১ এর যুদ্ধ তাদের জন্য দূরের বিষয়। তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টা স্পষ্ট থাকছে না তাদের কাছে।
যুদ্ধের রণাঙ্গন বিস্তৃত ছিল দেশজুড়ে। ১৯৭১ এ বাঙালি একটি জাতিতে পরিণত হয়েছিল। ইতিহাসে প্রথমবার দেখা গিয়েছিল হিন্দু-মুসলমান নেই, গরিব-ধনী নেই, সবাই বাঙালি। সব বাঙালি এক জাতি। আমরা সবাই বাঙ্গালী। মহান মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধ ধনীদের যুদ্ধ ছিল না, যুদ্ধ ছিল সাধারণ মানুষের; কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রের। তাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেই দেশ স্বাধীন হয়েছে।
১৯৩৫ সালে ৫জুন টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইল থানার পাকুটিয়া গ্রামে এক কর্মকার ও কৃষক পরিবারে জন্ম প্যারী মোহন আদিত্যের। তাঁর আশা ছিল উচ্চতর শিক্ষালাভ করা। উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। পারিবারিক অসচ্ছলতাজনিত কারণে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে বাধ্য হয়। প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা উল্লেখ করতে চাই। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঘাতকের গুলিতে মৃত্যুবরণ করায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলো ছুটি ঘোষণা করলে প্যারী মোহন আদিত্য আমাকে বলেছিল যে, ”দাদা, তিনি মারা গেছেন, তাতে হয়েছে কি? স্কুল বন্ধ হতে যাবে কেন?”
১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনকালে যুক্তফ্রন্টের কার্যক্রমের প্রতি প্যারী মোহন আদিত্যের মনে দাগ কাটে। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের স্ব-ঘোষিত ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান সামরিক আইন জারি করলে, তাঁর মনে বড় ধরনের রেখাপাত করে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে এবং ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে জড়িয়ে পরে। ১৯৪৩ সালে তিনি প্রথম শ্রীশ্রীঠাকুর বাড়ী যান। ১৯৪৬ সালে শ্রীশ্রীঠাকুর পাবনা ছেড়ে ভারতে চলে গেলে প্যারী মোহন আদিত্য সাথে সাথেই ভারতে শ্রীশ্রীঠাকুরের কাছে চলে যান। ১৯৫০ সালে শ্রীশ্রীঠাকুরের আর্শীবাদে পাকুটিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় সৎসঙ্গ আশ্রম। ১৯৫৮ সালে তিনি ভারতের দেওঘর থেকে মাথায় করে শ্রীশ্রীঠাকুরের শ্রীশ্রীপাদুকা নিয়ে আসেন পাকুটিয়া আশ্রমে, যা আজও পাকুটিয় শ্রীমন্দিরে সংরক্ষিত আছে। ১৯৬৮ সালের শেষ দিকে তৎকালিন পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় সংসদের স্পীকার আব্দুল হামিদ চৌধুরী, সাবেক সংসদ সদস্য শামসুর রহমান শাহজাহান খান, বাসেদ সিদ্দিকীর পরামর্শে ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডীর বাড়ীতে আমি (গোপাল চন্দ্র ভদ্র), রাস বিহারী আদিত্য এবং প্যারী মোহন আদিত্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখা করি। তাঁর গঠিত ফান্ডে সৎসঙ্গের কিছু অর্থ দান করা হয় সৎসঙ্গের পক্ষ থেকে এবং আবেদন জানানো হয় আশ্রম পরিদর্শনের জন্য এবং ঠাকুরের জন্ম স্থান সৎসঙ্গের কাছে ফিরত দেওয়ার জন্য। তিনি নিজের চেষ্টায় পড়ার জগত গড়ে তুলেছিলেন। প্রবল আগ্রহ ছিল লেখা পড়ার ব্যাপারে। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকুল চন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুলের অনেক বই তার পড়া ছিল। প্যারী মোহন আদিত্য সেই বই পড়া থেকে ঠাকুর অনুকুল চন্দ্রের ভক্ত ও দীক্ষা গ্রহন। পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী ১৯৭১ এর ২১মে ঘাটাইল ক্যাম্পে ধরে নিয়ে অত্যাচ করে। কৌশলে পালাতে সক্ষম হলেও ৮ আগষ্ট হানাদার বহিনী গুলে করে এবং পরে বেয়নেট দিয়ে খুচিঁয়ে হত্যা করে।
আজ এই লিখা লিখতে গিয়ে মনে পড়ছে সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল সাহেবের কথা। তিনি বলেছিলেন ”তোমাদের পরিচয় হচ্ছে তোমরা কমান্ডো। হায়নার দলকে পরাজিত করতেই হবে এবং বাঙালি যে বীরের জাতি তা প্রমাণ করতে হবে। বাংলার মানুষকে মুক্ত করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে মানুষের অধিকার, থাকবে না ধর্মীয় কোনো বাধার আবরণ”। তিনি আরও বলেছিলেন, ”১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে বাঙালি বুকে মাইন বেঁধে প্রমাণ করেছে যে তারা বীরের জাতি এবং তোমাদেরও তা প্রমাণ করতেই হবে”। জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে চলেছেন।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো বিজয় অর্জিত হলো, একদিকে সন্তান হারা মায়ের বুকফাটা আর্তনাদ, ভাইহারা বোনের কান্না, স্বামীহারা স্ত্রীর করুণ আর্তনাদ, সম্ভ্রমহারা বিরাঙ্গনার আহাজারিতে সেদিন আমি বিজয়ীর মতো হাসতে পারিনি। আমি নির্বাক হয়ে গেছি এমন এক মর্মান্তিক অবস্থা, যা বুঝিয়ে বলা যায় না। আমি কিংকর্তব্যবিমূড় হয়ে পড়লাম। আমি বিজয়ের আনন্দ আজও উপভোগ করতে পারিনি। কেন যেন মনে হয় শহীদের আত্মা আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ”বাঙালি জাতি মুক্তি চায়, বিজয়ের এত বছর পরও বাঙালি জাতির মুক্তি আসেনি। আজ তো পাকিস্তান নেই, শোষণ এত বেশি কেন?। শিক্ষিত মানুষের শিক্ষা ও নীতিনৈতিকতা নেই কেন? এক সাগর রক্ত কি বৃথা যাবে? সাধারণ মানুষের মুক্তি কি নিশ্চিত হবে না? নীতি-নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষা এই প্রজন্মের সন্তানরা পাবে না”?
৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ, ৩০ রাখ মানুষের প্রাণ বিসর্জন এবং ২ লাখ মা বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাওয়া আমাদের এই স্বাধীনতা। দেশ তো স্বাধীন হলো। স্বাধীনতা তো পেলাম। অর্থবহ স্বাধীনতার সুফল কি আজ আমরা ভোগ করতে পারছি? স্বাধীনতা তো অনেক আনন্দের, অনেক গর্বের। তবে কেন অনেক মুক্তিযোদ্ধাদের চোখে অশ্রু, কেন শহীদ পরিবারদের অবহেলা? এই অশ্রু বা অবহেলাকে আমরা কি আনন্দ অশ্রু বলতে পারি? নিশ্চয় না।
জটিল তত্ত্ব সহজে বলার অসাধারণ এক সহজাত ক্ষমতা ছিল প্যারী মোহন আদিত্যের। ফলে তার প্রাণবন্ত আলোচনা অনায়াসে গেঁথে যেত শ্রোতার হৃদয়ে। সেই সময় তারমতো জ্ঞানী সাধক বিরল। সাধারণ এক কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেও একাগ্র জ্ঞানর্চ্চা ও ধ্যান করেন। নতুন কিছু জানার জন্য, সবসময়ই তিনি ছিলেন অগ্রগামী। মুক্তমনে গ্রহন করতেন সবাইকে।
প্যারী মোহন আদিত্য। একজন দায়িত্বশীল সন্তান, ¯েœহময় পিতা, প্রেমময় স্বামী, সুবিবেচক সাংগঠনিক, বিশ্বস্ত অনুসারী, দক্ষ কর্মী, সাহসী লেখক ও সৎসঙ্গ সংবাদেও সহ-সম্পাদক, সদাচারী সহকর্মী এবং অনুগত ভক্ত এমন অনেক গুণ। কোনটি ছিল না তাঁর? তা ভাবতে গিয়ে বিষ্মিত হয়েছেন শেষ বিদায়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে। কিংবা স্মৃতি চারণে স্মৃতি চারণ করতে সমবেত গুণগ্রাহীরা। কারণ জীবদ্দশায় প্যারী মোহন আদিত্যের সাথে সুসম্পর্কের স্মৃতি ছাড়া অন্য আর কিছুর কথা কেউ মনে করতে পারছিলেন না।
প্রচন্ড সংগ্রামী ও আত্মবিশাসী মানূষ ছিলেন তিনি। শত প্রতিকূলতায়ও কখনো ভেঙ্গে পড়েননি। সাহসের সাথে সব কিছুই মোকাবেলা করেছেন তিনি। স্রষ্টার প্রতি আনুগত্য, পরম পিতার প্রতি ভালবাসা এবং গুরুজনদের প্রতি বিশ্বস্ততার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও যে একজন মানুষ পরিত্রণের লক্ষে আত্মশুদ্ধির জন্য এত সময় ব্যয় করতে পারেন, প্যারী মোহন আদিত্য সে উদাহরণই রেখে গেছেন। মৃত্যুর আগে সজ্ঞান থাকার শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি দেশের কথা এবং ¯্রষ্টার স্বরণ থেকে বিচ্যুত হননি।

লেখক: শিক্ষক ও রাজনীতিবিদ।

Print Friendly, PDF & Email