May 16, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

উৎসবগুলো কেবলই পোশাকি

চিররঞ্জন সরকার :  বাঙালির কাছে জীবনের অন্য নামই বোধহয় উৎসব। তা সে ঈদ-পূজাই হোক, ঋতু-বরণ হোক, বিভিন্ন দিবস কিংবা ফুটবল-ক্রিকেট হোক, কিংবা পিকনিক-বনভোজন। নানা উছিলায় হুজুগে বাঙালি একজোট হতে পারলেই যেন স্বস্তি পায়! কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাল্টেছে বাঙালির আনন্দ প্রকাশের ধরন। আগে ছিল বারো মাসে তেরো পার্বণ। এখন তো প্রতি মাসেই যেন এক ডজন পার্বণ বা উৎসব। ফেব্রুয়ারি মাসের কথাই ধরা যাক। ফেব্রুয়ারিকে উৎসবের মাস বললে অত্যুক্তি হয় না। অমর একুশে বইমেলা, সরস্বতী পূজা, বসন্তবরণ, ভালোবাসা দিবস, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ আরও অনেক উৎসব। এ মাসে যেন উৎসবের জোয়ার লাগে তরুণদের প্রাণে।

উৎসব তো জীবনের রসনির্ঝরিণী। প্রাণপুষ্পের ভোমরা। উৎসবময় জীবন অবশ্যই অনন্ত প্রাণভাণ্ডার। পারিবারিক ঘরোয়া সামাজিক দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক হরেক উৎসব। উৎসবের প্রয়োজন আছে, উৎসবের জোয়ারে তরুণ-তরুণীরা ভেসে যাক, তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু প্রশ্ন দেখা দেয় যখন আর দশটা খেলো উৎসবের মতো বিভিন্ন জাতীয় দিবসগুলোও অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হারিয়ে শুধুই উৎসবে পরিণত হয়। শহিদ দিবস, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতির পিতার জন্ম-মৃত্যু দিবস, ঐতিহাসিক অমর ব্যক্তিত্ব স্মরণ দিবস ইত্যাদি হচ্ছে রাষ্ট্রের দেশাত্মবোধের স্বর্ণসম্পদ। পরম শ্রদ্ধার, অন্তরঙ্গ ভালোবাসার এবং ইতিহাসের আত্মায় জড়িয়ে থাকা পবিত্র নৈতিক উৎসব এগুলো। কিন্তু যতই মহার্ঘ পবিত্র সম্পদ হোক না কেন, এই উৎসবগুলো কি আমাদের বুকে ইদানিং অনুরাগের, অনুপ্রেরণার ও আকর্ষণের কোনো চমক দেখাতে পারে? সেই ভাবগাম্ভীর্য খুঁজে পাওয়া যায়? যায় না।

কিন্তু কেন? উৎসবের প্রসঙ্গগুলো কি প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলছে? নাকি কাল-জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে? নাকি গ্রহণযোগ্যতার অনুকূল সেরিব্রিয়াল টিস্যুর একরকম দৌর্বল্য দৈন্য? নীতি ও নাগরিক কর্তব্যের সহ্য প্রসঙ্গে হলেও এ জাতীয় উৎসবে শরিকানায় কেন জানি জনমানসের কিছু না কিছু অনীহা ও ক্লান্তি বোধ দেখা যায়।

একটা সময় পর্যন্ত উৎসব-মানসটি ছিল অনাবিল, স্বতঃস্ফূর্ত ও আন্তরিক। জাতীয় দিবসগুলোতে ছিল ভাবগম্ভীর পরিবেশ। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর একটা আন্তরিক তাগিদের বহিঃপ্রকাশ। প্রাণের টান। চেতনার মশাল জ্বালিয়ে সেই অনুষ্ঠানে শামিল হওয়ার মধ্যে থাকত শ্রদ্ধা, ভক্তিভাব, আবেগের প্রকাশ। দেশপ্রেম, দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধ। রাস্তাঘাট, অফিস-আদালত, দোকানপাটে জাতীয় পতাকা, দলীয় পতাকা, ফেস্টুন, আলোকমালায় ভরে উঠত। শহর ও শহরতলিতে হতো মিছিল, সভা, আলোচনা। জাতীয় বীরদের গৌরবগাথা নিয়ে আলোচনা হতো। তাঁদের ত্যাগ-তিতিক্ষার কথা, অবদানের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হতো। সমাজের, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বৃহদংশের ভাবনায় থাকত দেশপ্রেমের চেতনা। উচ্চারিত হতো মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্র। মনে হয় সেদিন আজ আর নেই। ইদানিং শহিদ দিবস, স্বাধীনতা বা বিজয় দিবসের মতো ঐতিহাসিক জাতীয় উৎসবের রং বোধ হয় অনেকটাই ফিকে। এখন কেবল হইচই রইরই। যেন বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে যোগ দিতে চলেছি। এখন উৎসবের সমারোহ আছে, অংশগ্রহণ আছে, কিন্তু প্রাণ নেই। ভক্তি-শ্রদ্ধা বা আবেগ নেই। এই দিবসগুলোও ইদানিং কেবল একত্র হওয়া, স্থূল আনন্দ প্রকাশের উৎসবে পরিণত হচ্ছে।

রাষ্ট্রীয় উৎসবে জনমানসের বোধহয় তিনটি পর্যায়। উদ্দীপনা, উদাসীনতা এবং উত্তেজনা। একতলার বাসিন্দাদের উদ্দীপনা। দোতলায় উদাসীনতা এবং তেতলার বাসিন্দাদের উত্তেজনা। একটা ত্রিতল ভবন যেন।

উদ্দীপনা। উদ্দীপিত জনমন দেখে পুলক জাগে বইকি! শহরে-গ্রামে শোভনীয় মঞ্চ। বেদি জাতীয় পতাকায় সাঁটা, আলপনা। জাতির জনকের ছবি। পতাকা তুলবেন সংসদ সদস্য (মন্ত্রী হলে তো কথাই নেই)। অথবা নামীদামি নেতা। জোরালো ভাষণ। উপদেশ, প্রতিশ্রুতি রাজনীতির কড়চা এবং মানবপ্রেমের সুধামাখা বচন বরিষণ। উপস্থিত স্বপ্ন দেখা চোখের তরুণ। আশা-আকাঙ্ক্ষার তরুণ, উদ্দীপিত তরুণ। ‘শুভকর্ম পথে ধরো নির্ভয় গান।’ ঘন ঘন স্লোগান, জয় বাংলা, শহিদ দিবস অমর হোক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হারিয়ে যেতে দেব না। উদ্দীপিত তরুণকুল।

উদাসীনতা। মন্থর পায়ে ওরা সভাস্থলে আসে, মন্থর পায়ে কোথায় চলে যায়। বিশেষ জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান যুবসাধারণকে টেনে রাখতে পারল না। ওদের কেউ কেউ হাজির থেকেও মানসিকতায় গরহাজির। মানসিকতায় উদাসীন নির্বিকার। অনুপস্থিতদের কাছে উদ্যোক্তাদের জিজ্ঞাসা ছিল। কী, এলে না কেন ভাই? উত্তর : এই এমনিই। মায়ের অসুখ, ভাইয়ের একটা সমস্যা, নিজেরও ঠাণ্ডায় শরীরটা বিগড়ানো, একটা আকস্মিক জরুরি কাজ ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ কেউ ঘরে বসে কম্পিউটারের গেম, ফেসবুক। কেউ টিভিতে সিরিয়াল, কেউ চেস্ খেলায় ডুবে রয়েছে।

এ পর্যায়ের তরুণদের অনীহা বা উদাসীনতাকে বড় একটা গ্রাহ্যও করে না কোনো দল, সংঘ, সংস্থা, সমিতি। কিন্তু কেন যে ওরা উদাসীন, নির্লিপ্ত, বুঝবে কে? কোথায় ওদের দুঃখ-অভিমান-অনুযোগ? তা প্রকাশের কোনো মিডিয়া নেই।

উত্তেজনা। ওদের ঘাঁটানোও যায় না। মুখে বুকে মগজে স্নায়ুতে পেশিতে উত্তেজনা দাবানল হয়ে আছে। তীব্র প্রতিক্রিয়া তথাকথিত মামুলি ওইসব অনুষ্ঠানে। ধারেকাছেও ঘেঁষে না। অথচ ওরা দেশপ্রেমিক, মানবহিতৈষী, কর্মানুরাগী। তবে? কোনো জিজ্ঞাসারও উত্তর চট করে দেয় না। কোনো অনুষ্ঠানকর্তা শুধিয়েছিল। কী ভাই দেখলাম না তো! কী জমাট উৎসব হলো!… কিছুক্ষণ গুম মেরে থেকে জবাব দিল। হ্যাঁ চালিয়ে যান। জনগণের অধিকার কতটুকু কায়েম হয়েছে, বলবেন? মানুষের মূল্যবোধের, সুবিচারের উচ্চনীচ ফারাক দূরীকরণের কী করেছেন? পার্বত্য চট্টগ্রাম, গাইবান্ধার নদীভাঙা গ্রাম আর ঢাকার তফাতটা মেটাতে পেরেছেন? বড় পবিত্র শব্দধ্বনি গণপ্রজাতন্ত্র। রূপায়ণটাই কিন্তু আসল কাজ। ব্যস্! তর্ক-বিতর্ক জটলা হইচই রইরই। মুখোমুখি তর্ক, বাদানুবাদ।

দেশের উল্লেখযোগ্য এই যে মহৎ উৎসব অনুষ্ঠান, তাতে দেশাত্মবোধের অনুপাত কতটা তা ভাববার বিষয়। নিখাঁদ উদ্দীপনা যাঁদের, তাঁদের অন্তর মনকে অবশ্যই মূল্য দিতে হয়। হুজুগে উদ্দীপনা বলাবাহুল্য অতি অল্পায়ু। যাঁরা উদাসীন, তাঁদের ঔদাসীন্য বা নির্বিকারত্বের কথা না ভাবলে বলিষ্ঠ, সুষ্ঠু ও যথার্থ সমাজ সৃষ্টি বোধ হয় সম্ভব নয়। তাই তাদের অপাঙক্তেয় করা সমীচীন নয় বোধ হয়। তাঁদের আদর্শ দিয়ে ঘনিষ্ঠ করে নিতে হয় আন্তরিকতায়।

তাঁদের মূল্য অনস্বীকার্য। উত্তেজনা-ধর্মীদের কথাও ভাবনার বিষয়। তারা যদি দেশপ্রেমশূন্য রাগী তরুণ হয়, তবে ওদের পাঙক্তেয় না করা গেলেও, দেশপ্রেমের ও মানবকল্যাণের বীজ ওদের চেতনায় থেকে থাকলে, ওদের অবশ্যই গণ্য করতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে ওদের যুক্তিকে, বক্তব্যকে। কর্ম দিয়ে ওদের মর্মে প্রবেশ করতে হবে। ভাঙতে হবে অভিমান। ওরাও জাতির সম্পদ, দেশের সম্পদ। এ ধরনের কর্তব্যে এগিয়ে আসতে হবে প্রজ্ঞাবান হৃদয়বান সহনশীল এবং যথার্থ দেশপ্রেমিকদের। তবেই তারুণ্যের মূল্যায়ন ও সমৃদ্ধি সম্ভব দেশের স্বার্থে।

আমাদের কোথায় যেন তার ছিঁড়ে গেছে। উৎসব-অনুষ্ঠানগুলো কেবল পোশাকি আড়ম্বরে পরিণত হয়েছে। সেক্যুলারিজমের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণা সীমাবদ্ধ বৃত্তে আবদ্ধ। জাতীয়তাবাদ দ্বিভাজিত, মূলত দলীয় বিভাজনের সূত্র ধরে। গোটা সমাজ আজ বিভাজিত। একুশের চেতনা, একাত্তরের চেতনা এ জায়গাটিতেই মার খেয়েছে। গর্ব ও অহংকারের বিষয়টি ফাঁপা উচ্ছ্বাস বা কথার কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

‘‘একাত্তরের সংগ্রাম যে জাতিরাষ্ট্রের প্রত্যয় তুলে ধরেছিল, তা এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ শ্রেণিবিশেষের স্বার্থপূরণের রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। জাতিসত্তার শিকড়ে, সমাজের সর্বস্তরে সর্বজনীন স্বার্থের সেচ সামান্যই দেওয়া হয়েছে। তাই একুশের চেতনা, একাত্তরের চেতনা, উনসত্তরের গণজাগরণের ঢেউ সত্ত্বেও স্বাধীন বাংলাদেশে ফসলের পরিপুষ্টি নিয়ে বিস্তার লাভ করেনি। বরং বিরূপ পরিবেশে সেসব চেতনা ক্রমশ পিছু হটেছে, বিকাশ ঘটা তো দূরের কথা। শুধু চেতনার বিস্তার ঘটাতে জাতিসত্তার বর্তমান আর্তি, কবির ভাষায় বলা যেতে পারে, ‘জল দাও আমার শিকড়ে।’ কিন্তু কে দেবে, কারা দেবে, দেওয়ার মতো সংঘবদ্ধ শক্তি কোথায়?’’

চিররঞ্জন সরকার : লেখক, কলামিস্ট।

[email protected]

সূত্র: পরিবর্তন 

 

Print Friendly, PDF & Email