May 19, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

আমার দেখা প্রজন্ম’৭১

মিজানুর রহমান তালুকদার : প্রজন্ম’৭১ ( মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সন্তান) এর পঁচিশ বছর পূর্তিতে ত্রিশ লক্ষ শহীদ যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় আমাদেও প্রিয় স্বাধীনতা ও প্রিয় পতাকা পেয়েছি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। প্রজন্ম’৭১ এর আজকের এই আনন্দঘন মূহুর্তে সংগঠনের একজন সদস্য হিসাবে সত্যিই নিজেকে ধন্য ও গর্বিত মনে করছি।
যাদের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ১৯৯২ সালে ২৯শে আক্টোবর প্রজন্ম’৭১ প্রতিষ্ঠিত হল তাদের প্রতি অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। (১৯৯২-২০১৬) দীর্ঘ ২৫ বছর নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে প্রজন্ম’৭১ আজকের এ অবস্থানে পৌঁছেছে। কারন সংগঠনটির চলার পথ কখনোই মসৃণ ছিল না। ১৯৯২ সালে প্রজন্ম’৭১ এর জন্ম হলেও আমি মুলত ১৯৯৪ সালে যুক্ত হই। সত্যি কথা বলতে, – রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মাষ্টার শেষ বর্ষে অধ্যয়নকালে প্রজন্ম’৭১ এর সদস্য সংগ্রহের পত্রিকার বিজ্ঞপ্তী, বই মেলায় স্টল, সর্বোপরি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে শিল্পী নিতুন কুন্ড কর্তৃক ” সাবাস বাংলাদেশ” ভাষ্কযটি শহীদ জননী জাহানারা ইমাম কর্তৃক উদ্বোধন অনুষ্ঠানে যুক্ত হতে অনেকটাই অনুপ্রনিত করেছে।
যতটুকু মনে পরে ১৯৯৪ সালে বই মেলায় এসে প্রজন্ম’৭১ এর স্টল খুঁজে না পেলেও কোন একজনের মাধ্যমে জানতে পারি যে মধুর কেন্টিনে মধুদার ছেলে বাবূল চন্দ্র দের সাথে যোগাযোগ করলে বিস্তারিত জানা যাবে। সে অনুযায়ী মধুর কেন্টিনে গিয়ে বাবূলদার সাথে সাক্ষাৎ পেলাম।
সুঠাম দেহের অধিকারী নিজের পরিচয় আনেকটা এমন ভাবে উপস্থাপন করলাম যে আমি মিজান, বাড়ী কুড়িগ্রাম, বাবা শহীদ আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার কুড়িগ্রাম সরকারী কলেজে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপনা করেতন।
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে ৬ নং সেক্টরের বামন যুব শিবিরের ক্যাম্প ইনচার্জ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে ৭ আগস্ট পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রন্ত হন এবং ব্রাশ ফায়ারে আহত হন ও পরে বেয়নেট চার্জে শহীদ হন।
তিনিও তার বাবা-মা সহ পরিবারের অন্যান্যদের শহীদ হওয়ার মর্মান্তিক ঘটনার বর্ণনা দিলেন। প্রজন্ম’৭১ এর উদ্দেশ্য, আদর্শ ও কর্মকান্ড সম্পর্কে আমাকে অবহিত করেন। সেদিনের তার কথাগুলো যেন আমার মনের সাথে মিলে যাচ্ছিল। আসলে বাবুলদার সাংগঠনিক দক্ষতা আজও আমাকে সাহস ও অনুপ্রেনিত করে। মাঝে মধ্যেই তার সাথে দেখা করতাম ও সংগঠনের বিস্তারিত জানার চেষ্টা করতাম। পরিশেষে প্রজন্ম’৭১ এর তৎকালিন সাধারন সম্পাদক তৌহীদ রেজানূরের সাথে যোগাযোগ হয়। সেই থেকে প্রজন্ম’৭১ এর ভাই বোনদের সাথে পথ চলা এবং আজও চলছি। প্রজন্ম’৭১ এর সাথে অনেক মধুর স্মৃতি মানষপটে ভেসে উঠে। তার মধ্যে কিছু উল্লেখ করার চেষ্টা করছি। ১৯৯৬ সাল স¦াধীনতা রজত জয়ন্তী। সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাদের সকলের শ্রদ্ধাভাজন মেঘনা গুহ ঠাকুরতাকে আহব্বায়ক ও শমী কায়সারকে যুগ্ম আহব্বায়ক এবং আমাকে সদস্য সচিব করে ১৩ সদস্য বিশিষ্ট রজত জয়ন্তী পরিষদ গঠিত হয়। সকলের সর্বাত্বক সহযোগীতায় ৯ই ডিসেম্বর ১৯৯৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষক মিলনায়তনে অত্যন্ত সুন্দর ও স্বার্থক ভাবে রজত জয়ন্তী পালন করা হয়। উক্ত অনুষ্ঠানটি প্রজন্ম’৭১ মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামের স্মৃতির প্রতি উৎস্বর্গ করেছিল।
যা হোক পরবর্তিতে বর্তমানে সভাপতি শাহীন রেজানূর ও ফারজানা চৌধুরী নিপাকে সাধারণ সম্পাদক করে ৩১ সদস্য বিশিষ্ট র্পুণাঙ্গ কমিটি গঠন করা হয়। উক্ত কমিটি আমাকে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পন করে। আজকে স্মৃতি পটে অনেক কিছুই উঁকি মারছে। শাখার সাথে বিভিন্ন দিবসে স্মৃতিসৌধে সবার সাথে একত্রিত হওয়া, বনভোজন সহ বিভিন্ন কর্মকান্ড। শাহীন ভাই শুধু আমাদের সভাপতিই না, তিনি আমাদের অভিভাবকও বটে। তার বিচক্ষনতা ও নেতুত্বেও দৃঢ়তা আমাদের সব সময় আকৃষ্ট করে। সাধারন সম্পাদক ফারজানা চৌধুরী নিপা সহ সংগঠনের প্রতিটি সদস্য মেধাবী ও সাংগঠনিক ভাবে দক্ষ।
এক্ষেত্রে আরও একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য তা হচ্ছে, ৩০শে নভেম্বর ১৯৯৯ সালে আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর কন্যা তৎকালিন ও বর্তমান প্রধান মন্ত্রী প্রজন্ম’৭১ এর ৪৫ সদস্যকে সাক্ষাতের সুযোগ দিয়েছিলেন। আমরা ১৫ দফা দাবী উপস্থাপন করেছিলাম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বিশেয় ট্রাইবুনালে যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও সারাদেশে বধ্যভুমিগুলোকে রাষ্ট্রীয় ভাবে সংরক্ষন।
বঙ্গবন্ধু কন্যা ও মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শহীদ পরিবারের প্রতি সকল সময় সহানুভুতিশীল। এখন তিনি বছরে অন্তত্ব একবার রাষ্ট্রিয় ভাবে শহীদ পরিবারের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি অন্তর থেকেই অনুভব করেন।
প্রজন্ম’৭১ এর একটি পোষ্টার সকলের মনে নাড়া দেয় তা হল-
তোমাদের যা বলার ছিল বলেছি কি তা বাংলাদশে? আজকের বাংলাদেশ হয়তো কিছুটা বলেছে। মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর নের্তৃত্বে মানবতা বিরোধী ও যদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে ও কার্যকরও হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা হচ্ছে, সেই সাথে মাননীয় প্রধান মন্ত্রীর কাছে আবেদন শহীদ পরিবারদের একটি তালিকা তৈরী করে শহীদ পরিবার হিসাবে রাষ্ট্রীয় ভাবে স্বীকৃতি দেয়া। আবার দেশ অর্থনৈতিক ও অন্যান্য দিক দিয়েও এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রজন্ম’৭১ এ এসে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে তাহলো – আগে নিজেকে একজন বাবাহীন সন্তান মনে হত, নিঃসঙ্গ ভাবতাম, অন্য কারো সাথে মিশতে পারতাম না, আত্মীয় স্বজনের অবহেলা, বিভিন্ন ধিক্কারমূলক মন্তব্য আরো কত কি। আজ যখন ভাবী আমার পাশে আনেক বাবা-মা হীন সন্তাদের কথা-আর্দশের কথা তখন নিজেকে অনেকটা সামলে নিতে সহজ হয়।
আগামীতে প্রজন্ম’৭১ জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক ভাবে বিস্তৃতি লাভ করুক ২৫ বছর পূর্তিতে এ প্রত্যাশাই রইল।
লেখকঃ প্রজন্ম ’৭১ এর সাংগঠনিক সম্পাদক ও শহীদ আব্দুল ওয়াহাব তালুকদার এর সন্তান

Print Friendly, PDF & Email