April 28, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

মার্থা, নিওনি আর অনল

অনল রায়হান : আমার এক ভারতীয় বন্ধু সম্প্রতি ইউরোপ ট্যুর করে এসে একটা লেখা লিখেছেন। বন্ধুর নাম অরিন্দম নন্দী। জার্মানির জগৎখ্যাত অক্টোবরফেস্ট দেখার র্দূদান্ত বিবরন আছে ওর লেখায়। এ হচ্ছে বাভারিয়া অন্চলের প্রধান উৎসব। মুসলমানদের ইদ বা হিন্দু সম্প্রদায়ের দূর্গা পূজার মতই লোকে এই উৎসবে নতুন কেনা পোশাক পড়ে। খায় দায়। আর চলে বিয়ার পান। লেখাটার জার্মানি অংশের খানিকটা এখানে উল্লেখ করছি। …“আমার টেন্ট-এর বুকিং নেই। কুছ পরোয়া নেই। পাশেই আছে বিয়ার গার্ডেন। মানে বিয়ার পানের বাগান। সকলের জন্য খোলা। জায়গা খোঁজো, বসে পড়, অর্ডার দাও, খাও-দাও, গলা ভেজাও। বসে পড়লাম বেন্চে। সারি সারি লম্বা বেন্চ, সামনে লম্বা টেবিল। অনেকটা আমাদের একসময়ের বাঙালি বিয়ের নেমন্তন্নয় পঙতি ভোজনের মত। কিছুক্ষনের মধ্যেই খালি আছে কিনা জি¹েস করে আশেপাশে লোকজন বসে গেল। কেউ এসেছে সিংগাপুর থেকে, কেউ ইরান, কেউ বা পুয়েতোর্ রিকো, কোলাম্বিয়া, জার্মানি তো আছেই। সংগে সংগে আলাপ হয়ে গেল সকলের সংগে সকলের। আমি একা নই। কোলাম্বিয়া থেকে আসা ছেলে-মেয়ে দুটি বিবাহিত। ছেলেটি জিনিভায় থাকে, পেশায় বায়োটেকনোলজিস্ট। মেয়েটি গ্রাফিক ডিজাইনার। পুয়ের্তো রিকো থেকে এসেছে দুটি মেয়ে। দুই বন্ধু। ইরাক থেকে ছেলেদের দল, সিংগাপুরের ছেলেটি ব্যবসায়ী। মিউনিখে নতুন অফিস খুলবে বলে এসেছে। আর আছে এক সুন্দরী জার্মান মেয়ে আর তার সুপুরুষ জার্মান স্বামী। চারদিকে বসে আছে হাজার হাজার মানুষ। বিবিধের মাঝে মহামিলন। এর মধ্যেই এক মহিলা এসে অর্ডার নিয়ে গেল। ফ্রেশ ড্রাফট বিয়ার তো আছেই, চাইলে হোয়াইট বিয়ারও মিলবে…তার নাম রাডলার…মানে বিয়ার, সংগে লেমোনেড। আর আছে মুরগীর রোস্ট।……বিয়ার শেষ হতেই আবার ফিরে এলো, পরের রাউন্ডের জন্য। এর মধ্যে অনেকে উঠে পড়ছে। খাওয়া শেষ। সেখানে বসে পড়ছে নতুন মুখ। নতুন করে আলাপ করে নিচ্ছে সবার সংগে। ইস্, এরকম যদি এ-দেশে হতো? নতুন নতুন বন্ধু হতো ফেইস বুকের বাইরেও। উৎসবের অছিলায়। এমন উৎসব কেন যে হয় না এখানে। বেশ কটা বিয়ার খেয়ে এবার ফেরার পালা। সবাইকে টা টা করে বাঙালির হোটেল প্রত্যাবর্তন।”…অরিন্দম যেন বলতে গেল, বাঙালির বাঙাল মুলুকে প্রত্যাবর্তন। যে মুলুকে জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের মহামিলন এখন এক প্রায় কল্পনাতীত ব্যাপার। যার জন্য আমার হিন্দু বংশোদ্ভূত বাঙালি বন্ধুটির হাহাকার, “ইস কেন হয় না” এবং আমার মত মুসলিম বংশোদ্ভূত বাঙালিরও হাহাকার, “ইস কেন হয় না।” আমরা দুই বাঙালি দুই আলাদা দেশের নাগরিক। দুই ভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধি। অথচ মনের গহীনে দুজনের বিশ্বভাত্রিত্ববোধের পিপাসা একই ফল্গুধারায় বয়ে যাচ্ছে। বিয়ার হুইস্কি এখানে প্রসংগ নয়। কফি না চা না ঝালমুড়ি না পোলাও সেটাও দূরের বাৎ। আমি শুধু চাই বিভিন্ন বর্ণ-রূপ-গন্ধের মানুষেরা আমার শহরটা রাঙিয়ে রাখুক। ভাষার জগাখিচুড়ি উঠুক মতিঝিলে আর গুলশানে। হঠাৎ করে বইয়ের দোকানগুলি ছেয়ে গেল অচেনা ভাষার বইয়ে। চ্যানেল আই কিংবা একাত্তরের খবর পাঠিকার মুখ দেখে থম্বা মেরে যাই। ইনি কিনি? কথা বলছেন বাংলায়, দেখে মনে হচ্ছে মেক্সিকান। নাকি হাইতির মেয়ে? আর পরেরদিন অফিসে যাওয়ার পথে বাসে পরিচয় হয়ে যায় নিওনির সংগে। চাইনিজ মেয়ে। বৌদ্ধ ধর্মের রীতিমত অনুসারী। আমি বাংলায় কথা বলছি। নিওনি চাইনিজে। কেউ কারো ভাষা বুঝছি না। বোঝার দরকার কি? দুজনেই যে ভালোবাসতে জানি! বন্ধুত্ব যদি টিকে যায়, ভবিষ্যতে ও না হয় বাংলা শিখবে আর আমি চাইনিজ? নইলে হাতের সম্বল ইংরেজি তো আছেই। আর ফুলের দোকানগুলোর এ কি অবস্থা? এতশত বাহারি ফুল সব এলো কোথ্থেকে ভাই? উত্তর দিলো যে মেয়েটি, তার নাম মার্থা গ্রাহাম। এই মেয়েটিকে আমি চিনি। ও একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান। বাবা ইংরেজ কিংবা আইরিশ কিংবা পর্তূগীজ আর মা ভারতীয় উপমহাদেশীয়। একসময়…এই তো পাকিস্তান আমলেও এরা অনেকেই ছিল এই শহরে। তারপর কখন যেন ওরা ফাঁকা হয়ে গেল। আবার ফিরে এসেছে ওরা? বাহ্। দারুন ব্যাপার। আমি আনন্দিত চিত্তে মার্থার দিকে তাকাই। মার্থা বলে, ‘এই ফুলগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ বিভিন্ন অন্চল থেকে এসেছে। তুমি অবাক হচ্ছো অনল? তাহলে শোনো, এমন এক দিন আসবে যখন এই মহাবিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত, বিভিন্ন ছায়াপথ আর গ্রহ থেকে ফুল আসবে এই পৃথিবীতে।’ বাহ্ মার্থা বাহ্! তাই তো হবে। হতেই হবে। সেদিন, গোটা মহাবিশ্ব এক মহামিলন আলোড়নে আপ্লুত হয়ে উঠবে। কত লক্ষ ধাঁচের জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ-গ্রহের প্রাণীর মিলনহাটে উদ্বেল হয়ে উঠবে আজকের এই পৃথিবী। হবেই তো। হতেই হবে। আর সেই মহাবিশ্বমিলনের মিছিলের নেতৃত্বদানকারী অন্যতম প্রাণী হবে মানুষ। সেই যোগ্যতা অর্জনের পথে আজকের মানুষ যদি মানুষে মানুষে মিলন ঘটাতে না পারে তাহলে চলবে কি করে! এই ঢাকা শহরেই তো কত রকমের মানুষ থাকতো। আজকের পুরনো ঢাকার যে চক বাজার, একসময় তার নাম ছিল পাদশাহী বাজার। সে মোঘল আমলের দিন। তিন চারশো বছর আগের কাহানী। বাজার ভরা থাকতো লোকে। আর সেই লোক কারা? ইংরেজ, পর্তূগীজ, পার্শিয়ান, চীনা, আর্মেনিয়ান, ইরানী,আরবের লোক, হিন্দু-খৃষ্ঠান-বৌদ্ধ-মুসলমান-শিয়া-সুন্নি-ব্রাম্ভণ-কায়স্থ, কালো-সাদা-লাল-ফ্যাকাশে কত রকমের মানুষ! এদের ভাষা আলাদা। সংস্কৃতি আলাদা। ধর্ম আলাদা। রুচি আলাদা। কিন্তু সবাই এই পৃথিবীবাসী এক বুদ্ধিমান প্রানী। যার নাম মানুষ। আশরাফুল মাকলুকাত। এরা শ্রেষ্ঠ। কারন এদের মত উদার আর কোন প্রানী হতে পারে না। এদের সহনশীলতা আর ভালোবাসার ক্ষমতার গভীরতা মহাসমুদ্রের চেয়েও বিশাল। চারশো বছর পরের ঢাকাইয়া আমি। ভারী দূর্ভাগ্য। প্রকৃতির সেই বিচিত্রতায় অবগাহন করার সুযোগ এখন নেই। হয় এদেশ হতে হবে বাঙালির একার। নয়ত মুসলমানদের একার। আল্লাহর ভূমির নীতি নির্ধারক হলাম আমি এক মানুষ। এ হয়? হয় নাকি? গোটা পৃথিবীটাই তো আমার! আমিই মুসলমান। আমিই খৃষ্ঠান। আমিই বাঙালি। আমিই আইরিশ কিংবা অষ্ট্রেলিয়ার সেই আদীবাসী যে এখনও কিনা কাঁচা মাংস খায়।
মার্থা, নিওনি আর আমি কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে শহীদ মিনারের বেদীতে উঠে ফুল দিলাম।

লেখক : সদস্য প্রজন্ম ’৭১।

Print Friendly, PDF & Email