May 16, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

এই মিছিল থামাবে কে?

নাদিম মাহমুদ : আমি যখন ল্যাব থেকে ফিরি তখন অনেক সময়ই রাত ১২ টা পার হয়। কখনো কখনো ৩ টাও বাঁজে। এই মাঝ রাতে ফাইভস্ট্রোকের বাইসাইকেল বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে ৫/৭ মিনিটের মধ্যে ডরমিটরিতে ফিরি। আমার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডরমিটরিতে যেতে অন্তত দুইটি ট্রাফিক সিগন্যাল পার হতে হয়।

জাপানে আসার একবারেই শুরুর দিকের কথা। একদিন ল্যাব থেকে রাত আড়াইটার দিকে সুনসান পথে সাইকেলকে সঙ্গী করে ডরমিটরিতে ফিরছি। চার মাথার একটি রাস্তায় যে সিগন্যালটি ছিল যা ৪/৫ কদমে পার হওয়া যায়, সেটি পার হবো এমন সময় দেখি ‘লাল বাতি’ জ্বলে উঠছে। আশে পাশে চেয়ে দেখলাম কেউ নেই। ফাঁকা রাস্তা দেখে সহচা পার হয়ে গেলাম। দ্বিতীয় দিন এই রকম ফাঁকা রাস্তা, কিন্তু একজন জাপানি দাঁড়িয়ে আছে। এইবারও ফাঁকা দেখে পার হয়ে গেলাম। ভদ্রলোক আমার দিকে একবার শুধু তাকাইলো কিন্তু কিছু বললো না।

এই ভাবে তৃতীয়দিন এই রকম রাতেই ফিরছি। সিগন্যালে ‘লাল বাতি’ জ্বলে উঠছে। এমনই সময় ওই সেই জাপানি যিনি আমাকে ফাঁকা রাস্তা দেখে লাল বাতি জ্বলা অবস্থায় পার হতে দেখেছে সেই ব্যক্তি কাছে এসে ‘মাথা নূয়ে’ পরিচয় জানতে চাইলো। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলতেই সে বলে আমার ল্যাবের পাশে বিল্ডিং এক ল্যাবে সে কাজ করে। যাই হোক চেহারায় ভারতীয় ভাবখানা দেখে উনি ধরেই নিয়েছেন আমি ভারতীয় লোক। তাই আমাকে বলে বসলো, আপনাদের ভারতে ট্রাফিক সিগন্যাল নেই?

–আমি বললাম, আমি ভারতীয় নই, বাংলাদেশি। হ্যাঁ আমাদের দেশেও ট্রাফিক সিগন্যাল আছে। তবে এই রকম ছোট ছোট রাস্তায় থাকে না।
এইবার জাপানি ব্যক্তি বললো, তাহলে ওই সিগন্যালেআপনি কখনো মেনে চলেননি?
এইবার লজ্জায় পড়ে গেলাম। ভদ্রলোক আমাকে বললো না যে সেদিন আমি লাল বাতি জ্বলা অবস্থায় পার হয়ে গেছি। কিন্তু সে কৌশলে দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা বিষয়ে জানতে চাইলো।
–আমি একটু মাথা নিচু করে বললাম, আসলে যখন সমগ্র রাস্তায় ফাঁকা থাকে তখন কেউ এইভাবে সিগন্যালের জন্য ওয়েট করে না।
ভদ্রলোক তখন, শুধু বললো হুম। দেখুন এটা জাপান। এখানে আপনি ট্রাফিক রুল ভংগ করলে আপনাকে কঠোর শাস্তি পেতে হবে। যেহেতু আপনি নতুন এসেছেন তাই হয়তো অনিচ্ছাকৃত ভুলটি করেছেন। আশা করি, এরপর আপনি আর ভুলে যাবেন না।

সবুজ বাতি জ্বলে উঠার সাথে সাথে রাস্তা পার হলাম। এরপর সমগ্র রাস্তা হেটে এসেছি আর ভেবেছি, আসলেই তো ভুল করে ফেলছি। এর কয়েকদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কিভাবে বাই সাইকেল চালাতে হয়, কিভাবে ট্রাফিক নিয়ম মানতে হয়, তা দেখে শরীর ইতি রকম শিউরে উঠেছে। এখানে কোন সড়ক দূর্ঘটনা ঘটলে সেই ব্যক্তির পুরো চিকিৎসা খরচ থেকে শুরু করে পুরো পরিবারের জন্য দণ্ডিত ব্যক্তিকে বহন করতে হয়, যা আমাদের দেশের টাকার হিসেবে ৪০ থেকে ৬০ লাখ টাকা। প্রতিটি মোড়ে মোড়ে বলতে গেলে সমগ্র জাপানের কয়েক মিনিট পর পর ট্রাফিক সিগন্যাল চোখে পড়ে। আর পুরো রাস্তায় সিসিটিভি সার্ভিলেন্স করা। মূলত জাপানের পুলিশ থানা বা পুলিশ ফাঁড়িতে বসে বসে ট্রাফিক সিগন্যাল ও ট্রাফিক রুল মনিটর করে। রাস্তায় পুলিশ দেখলে বুঝা যায় কোথাও কোন দূর্ঘটনা ঘটেছে। অথচ কোথাও কোন ট্রাফিক পুলিশ থাকে না। পরে ল্যাবমেটদের কল্যানে জানতে পেরেছিলাম, জাপানি শিশুরা যখন স্কুলে কেবল মাত্র ভর্তি হয়, তখন তাদের স্ব-শিক্ষার প্রথম পাঠ হলো ‘ট্রাফিক নিয়ম’ কিভাবে মেনে চলা হয়।

মাস দুয়েক আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নোটিশ দিয়েছিল ‘প্রতিটি সাইকেল’ চালকের সাইকেল ইনসূরেন্স থাকা বাধ্যতামূলক। সেটিও করেছিলাম। এখন রাস্তা বের হলে, ওই সেদিনের কথাটি মনে পড়ে যায়। গত দুই বছরে ভুলেও ‘লাল বাতি জ্বলা অবস্থায় রাস্তা পার হইনি। এমনকি গভীর রাতে ল্যাব থেকে ফিরার সময় সমগ্র রাস্তা ফাঁকা দেখেও কখনো সিগন্যাল ভাঙার দুঃসাহস হয়নি। রাস্তায় কখনো, গাড়িগুলোতে হর্ণ দিতে দেখিনি। সারি সারি গাড়ি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে কখনো ওভারটেকও করতে দেখি না। সাইকেল রিং কিংবা গাড়িতে হর্ণ দেয়া মানে ‘সে কোন বিপদে আছে’। ভুলেও কখনো দুই বছরে সাইকেলে রিং দিতে হয়নি।

দিন শেষে যখন বাসায় ফিরলাম, তখন অনলাইন পোর্টালগুলোতে সড়ক দূর্ঘটনায় লাশের মিছিল। এই লাশের মিছিল ছত্রভঙ্গ হবে কবে? কবে পরিবারগুলোর কান্না থামবে? আমাদের দেশের যে সিগন্যালগুলোর অধিকাংশ অকেঁজো কিংবা বাতি-জ্বলা নেভার মধ্যেই থাকে। এই জ্বলা নেবার মধ্যে নিভে যায় অসংখ্য জীবন প্রদীপ। আনন্দের যাত্রা হয়ে যায় কান্নার। মূলত ট্রাফিক দূর্ঘটনায় ‘শাস্তির বিধান’ কড়া কড়ি না হওয়া যার যত্রতত্র লাইসেন্স পাওয়ায় সড়ক দূর্ঘটনার জন্য দায়ি। কৈই সরকার একবার একটা আইন করে দেখাক দেখি যে ‘দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য আমরন চিকিৎসাসেবা, ভুক্তিভোগীর পরিবারের খরচ এবং নিদিষ্ট অংকের টাকা যা দিয়ে সে সারাজীবন বসে বসে খেতে পারে। একটাই আইন করে দেখান, দূর্ঘটনা কেউ করলে তার লাইসেন্স বাতিল, সেই সংগে তাকে ৮/১০ বছরের জেল দেয়ার বিধান। বলবেন, আইন আছে প্রয়োগ নেই। যদি আইন থাকে প্রয়োগ থাকে না সেই আইনের প্রয়োজনটা কি? প্রয়োগ ঠিকই হয়, যখন কেউ গণতন্ত্রকে হারিকেন ধরে দেয় তখন ৫৭ ধারা খাড়া হয়ে যায়।

আঙুল কচলায়ে উন্নতি হয় না। অসভ্যতার চর্চা করে সভ্যতার ছাতা খোঁজতে যাওয়া মূলত ভণ্ডামি। ফাঁটা কেষ্টের সংসাঁজ না হলেও চলবে। ঘরে বসেই নিয়ন্ত্রিত হবে ট্রাফিক যদি আমরা হতে পারি সভ্য। নিরাপদ সড়ক হোক বাংলাদেশ। ঈদ ফেরত সবার গন্তব্যস্থলের যাত্রা হোক ‘নিরাপদ।

লেখক : প্রবাসী সাংবাদিক। (Source : FB)

Print Friendly, PDF & Email