May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

অতঃপর, তারপর কি?

অনল রায়হানঃ মীর কাশিম এখন কোথায় আছেন? এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম আমাকে বললেন,‘এখন? এখন কবরের আযাবের মধ্যে আছে।’ কেমন সেই আযাব? উনি বললেন,‘সেটা আমি জানি না। তবে উনার পাপের ওজন এত বেশি, আযাবও নিশ্চয়ই ভয়াবহ হবে।’ আমি ভাবলাম, আর জসিম এখন কোথায়? কিশোর এক দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা জীবনের রস-রঙ উপভোগ করার আগেই মীর কাশিমদের অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে অকালে মারা গেল! আল্লাহ নিশ্চয়ই তাঁকে পুরস্কৃত করেছেন।
এবার? এই পৃথিবীর মাটিতে দাঁড়িয়ে আমাদের তো কিছু দায় আছে। মীর কাশিমের ফাঁসির মধ্যে দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া আরেকটি ধাপ এগোলো। জামাতের অর্থনৈতিক মেরুদন্ডের প্রধান হাড়টাকে ছিটকে ফেলা গেল। এতে এই মানব হত্যার রাজনৈতিক দলটির পার্টি সিস্টেমের ক্ষতি হয়েছে সত্যি তবে আমার ধারনা তাদের ব্যাকআপ সিস্টেমও আগে থেকে তৈরী ছিল। কাদের মোল্লা-কামারুজ্জামান-নিজামিদের একের পর এক ফাঁসি কার্যকর হতে দেখে জামাতের বিশেষ করে যুবক নেতৃত্ব কি চুপ করে বসে ছিল বা আছে? একটি দিক তো পত্র-পত্রিকাতেই এসেছে। জামাতের মধ্যমসারির নেতৃত্ব একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে জড়িত নেতাদের পার্টির নেতৃত্ব থেকে বাদ দিয়ে নিজেদের নতুন ইমেজ তৈরীর কথা ভাবছেন। জামাত পার্টি হিসেবে নিষিদ্ধ হলে, নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করার পরিকল্পনাও এদের আছে। এমনকি, নতুন এই পার্টি তাদের মেন্যুফেস্টোতে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের পার্টি হিসেবেও ঘোষণা দিতে পারে। কি হবে তখন? এখন যারা জামাতের কেন্দ্রীয় শুরার সদস্য বা রুকন, তারা কি মওদুদীবাদ ঝেড়ে ফেলে ভোল পালটে ফেলবে? আমি নিশ্চিত, তেমন হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শুণ্যের কোঠায়। আমি যেমন হঠাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে পাকিস্তানীপন্থী হয়ে উঠতে পারবো না, তারাও মওদুদীবাদ ছাড়তে পারবেন না। যার অর্থ, যে নামে-যে আদর্শের ধোঁয়া তুলেই তারা নতুন পার্টি করুক, এর অর্ন্তস্থল ছেয়ে থাকবে মওদুদীবাদে। ফের ষড়যন্ত্র করবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তথা বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিরুদ্ধে। ফের গুপ্ত ও প্রকাশ্য হত্যাকান্ড চালাবে ভিন্ন মতাবলম্বী, প্রগতিশীল মানুষদের বিরুদ্ধে। এবং শেষতঃ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের পদাঙ্কই অনুসরণ করবে। ইতিমধ্যে পত্রপত্রিকায় আমরা দেখেছি , স্থানীয় পযার্য়ে জামাত নেতা-কর্মীদের সরকারি পার্টি আওয়ামী লীগে যোগ দিতে। এটাও তাদের টেকটিক্যাল স্ট্র্যাটিজি। যেমন নানা নামের জঙ্গী দলগুলোর মধ্যেও জামাত-শিবিরের কর্মীরা ছড়িয়ে আছেন। কীর্তি ঘটাচ্ছেন। পার্টি নিষিদ্ধ হলে পূনর্জাগরণ কি ভাবে ঘটাতে হয় সেটা তারা মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই করে দেখিয়েছেন। একই উৎসাহে তারা আবারও সংগঠিত হওয়ার মহা পরিকল্পনা নিয়ে এগোবে। সুতরাং, বাঙালি জাতিবিদ্বেষী এই রাজনৈতিক দলটিকে শুধু নিষিদ্ধ করলেই চলবে না, এর শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে এ দেশের মাটি থেকে। এই উপড়ে ফেলার কর্মসূচির ভেতর দিয়েই বাংলাদেশ থেকে চির বিদায় জানাতে হবে সকল ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, যে কোনো ধরনের ধর্মীয় রাজনীতি, প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মচর্চার নামে বিশেষ রাজনৈতিক প্রচার চালানো ইত্যাদি। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে আমাদের প্রয়োজন এখন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে নূন্যতম হেলাফেলা হবে ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের সংগে বেইমানীর সমতূল্য।
প্রথমত, একাত্তরের মানবতাবিরোধীদের প্রত্যেকের বিচার কাজ সম্পাদন করতে হবে। যুদ্ধাপরাধের দায়ে দন্ডিত প্রত্যেক অপরাধীর সমস্ত সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে মুক্তিতযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন এবং শহীদ পরিবারগুলির ন্বাচ্ছন্দ্যের জন্য ব্যয় করতে হবে। জামায়াত এবং সকল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সামাজিক সংগঠন নিষিদ্ধ করতে হবে। জামায়াতসহ এই ঘরানার উগ্র-সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের সকল অর্থনৈতিক উৎস আইনী প্রক্রিয়ায় বন্ধ করতে হবে। পাকিস্থানী সেনাবাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার আইন বাস্তবায়ন করতে হবে যেন খালেদা জিয়ার মত কেউ ভবিষ্যতে অপমান করার সুযোগ না পান। এই আইনী ও প্রশাসনিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের পাশাপাশি অতি জরুরী আরেকটি কাজও করতে হবে সরকারকে। সারা দেশব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়ন ও বাঙালি জাতিসত্তার বিকাশে এক নব-জাগরণের উদ্যোগ নেয়া। এবং এই উদ্যোগকে হতে হবে বহুমুখী। দেশের বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রথমেই প্রয়োজন তথ্য-সংস্কৃতি-অর্থ-শিল্প-শিক্ষা-মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়গুলির প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি কনসোর্সিয়ামের মত করা। আমি ব্যক্তিগত ভাবে সব সময় বলে আসছি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন যেন মিডিয়া, সাংস্কৃতিক কর্মী, লেখক, শিক্ষক-ছাত্র, কিছু বুদ্ধিজীবী, একজন মাশরাফি বিন মোর্তজা আর শেখ হাসিনার দায়। আমরা বাকি যারা বাংলায় কথা বলছি, বাংলাদেশের পাসপোর্ট পকেটে নিয়ে ঘুরছি, বাংলাদেশের ক্রিকেট টিমের খেলায় গলা ফাটাচ্ছি আর গুলশান আরিধারা-বারিধারা করে বেড়াচ্ছি…আমরা কি করছি?
বিভিন্ন টেলিফোন কোম্পানি, এফএমসিজি মার্কেট, ডেভেলপার, ব্যাংক, পোশাক শিল্প ইত্যাদি প্রতিটি বিজনেস সেক্টর এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে পারে। সরকারের উল্লেখিত কনসোর্সিয়ামের সংগে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সবাই মিলে বেশ বড় একটা ফান্ড গড়ে তোলা সম্ভব। সেই সংগে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে বিজনেস কমিউনিটির সম্মিল্লিত কমিটমেন্টও এতে প্রকাশ পাবে। এই ভাবে প্রতিটি পেশাকেন্দ্রীক ঐক্যমত্যের দিকে আমাদের এগোনো উচিত। ধরা যাক, বিজনেস কমিউনিটি থেকে পাওয়া গেল পাঁচশো কোটি টাকা। এই টাকা বাঙালি ঐতিহ্য-জাতিসত্তা-একাত্তরের চেতনা বিকাশে সঠিক পথে কিভাবে ব্যবহার করা যায় তার দিক নির্দেশনার জন্য সর্বজন বিশ্বস্ত, শ্রদ্ধেয় নাগরিকদের নিয়ে একটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন কমিটির মত একটা প্লাটফর্ম করা যেতে পারে। ধরা যাক এই কমিটির প্রধান হলেন প্রফেসর আনিসুজ্জামান স্যার। এই কমিটিই লম্বা সময় কাজ করে একটি প্রায়োগিক তত্ত্ব দাঁড় করাতে পারবেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আছে। এদের এই কাজের মধ্যে কোনো সরকারি আমলা-সচিবদের ঢুকতে দেয়া যাবে না। প্রায়োগিক তত্ত ও কর্মসূচি নির্ধারন করার পরেই শুরু হবে সরকারি কর্মকর্তাদের কাজ। কারন তাদের অভিজ্ঞতা আছে জটিল কর্মসূচি বাস্তবায়নের। এই কর্মসূচি হতে পারে পাঁচ বছর, দশ বছর বা পনের বছর ব্যাপী। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কর্মসূচি না থাকলে, আমাদের আবারও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও মানসিকতার বিপদের মধ্যে পড়তে হতে পারে। পঁচাত্তরের পরিণাম যে আমাদের দীর্ঘদিন শুধু পিছিয়ে দিয়েছে তাই নয়, আরও বহু নিরপরাধ মানুষের প্রাণও কেড়ে নিয়েছে বছরের পর বছর জামাতি এবং এই রাজনৈতিক ঘরানার পিশাচদের হাতে।
আমাদের জাতীয় কবি তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন, কৃষ্ণ মোহাম্মদ। মুক্তিযুদ্ধের ত্রিশ লাখ শহীদ পারস্পরিক মমতাময়, অসাম্প্রদায়িক, সকল জাত-পেশা-ধর্মের বৈষম্যহীন এক সোনার বাংলাদেশের স্বপ্নে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ দিয়ে গেছেন। ইতিহাসের কাছে আমাদের দায় কিন্তু অনেক ভাই! এ যে মাত্র শুরু হলো।
লেখক : সদস্য প্রজন্ম ’৭১।

Print Friendly, PDF & Email