May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

নারায়ণগঞ্জে অভিযানে ‘মাস্টারমাইন্ড’ তামিমসহ নিহত ৩

নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি : রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের ঠিক এক মাস পর এবার নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি বাসায় খোঁজ মিলেছে জঙ্গিদের আরেক আস্তানার। শহরের পাইকপাড়ার শাহ সুজা রোডের একটি বাড়িতে শুক্রবার গভীর রাত থেকে শনিবার সকাল পর্যন্ত পুলিশের অভিযানে নিহত হয়েছে তিন জঙ্গি। তাদের মধ্যে ‘নব্য জেএমবির’ শীর্ষ নেতা তামিম আহমেদ চৌধুরীও রয়েছেন। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মূল পরিকল্পনাকারী দাবি করে তাঁকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পুলিশ।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) সোয়াত টিম, পুলিশ সদর দপ্তরের এলআইসি শাখা ও নারায়ণগঞ্জ পুলিশ যৌথভাবে এ অভিযান চালায়। অভিযানের নাম দেওয়া হয় ‘অপারেশন হিট স্ট্রং টুয়েন্টি সেভেন’।

গতকাল বিকেলে ওই বাড়ির তৃতীয় তলা থেকে তিনজনের রক্তাক্ত মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। তামিম ছাড়া নিহত অন্য দুজনের মধ্যে একজন হলেন—যশোরের ফজলে রাব্বি। ঘটনাস্থলে তার জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া গেছে। গুলশান হামলার পর যশোর পুলিশ নিখোঁজ যে পাঁচজনের ছবি দিয়ে পোস্টার ছাপিয়েছিল সেখানে রাব্বির ছবি ছিল বলে জানিয়েছেন সিটিটিসি প্রধান মনিরুল ইসলাম।

অন্যজনের পরিচয় গতকাল রাত ১টা পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে এর আগে পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা তামিম ছাড়া নিহত অন্য দুজন ইকবাল (৩৫) ও মানিক (২৫) বলে ধারণা করেছিলেন। তাদের একজন তামিমের সহযোগী শীর্ষ পর্যায়ের জঙ্গি বলে তাঁদের ধারণা।

গত ২৬ জুলাই কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় ‘অপারেশন স্টর্ম টুয়েন্টি সিক্স’ নামের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চালানো অভিযানে নিহত হয় ৯ জঙ্গি। ওই ঘটনায় পলাতক ১০ জঙ্গির নাম বেরিয়ে আসে।

গতকাল সকালে পাইকপাড়ার বড় কবরস্থানের কাছে গিয়ে দেখা গেছে, পুলিশ শাহ সুজা রোড নামের সড়কটি বন্ধ করে রেখেছে। ওই সড়কেই নূর উদ্দিন দেওয়ানের তিনতলা বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। পুলিশ জানায়, বাড়ির তৃতীয় তলার বাঁ পাশের তিন কক্ষের ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়ে আস্তানা গেড়েছিল জঙ্গিরা।

সিটিটিসি ইউনিটের তদন্তসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ময়মনসিংহের ত্রিশাল থেকে জেএমবির এক সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিটিটিসি ইউনিট নারায়ণগঞ্জের ওই জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পায়। শুক্রবার রাতে আস্তানাটি শনাক্ত করার পর প্রথমে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা করে পুলিশ। তবে আত্মসমর্পণ না করে উল্টো পুলিশের ওপর হামলা চালায় জঙ্গিরা। পরে পুলিশ অভিযান শুরু করে। গভীর রাত থেকে পুলিশ জঙ্গি আস্তানার বাড়িটি ঘিরে ফেললেও মূলত সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে এক ঘণ্টায় মূল অপারেশনটি চালানো হয়।

পুলিশ ও প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, ছদ্মনাম ও পরিচয়ে পাঁচ জঙ্গি গত ৫ জুলাই পাইকপাড়ার ওই বাসাটি ভাড়া নেয়। গতকাল অভিযান শুরুর আগেই দুই জঙ্গি সেখান থেকে পালিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অভিযান শেষে ঘটনাস্থল থেকে চারটি গ্রেনেড, একটি একে-২২ রাইফেল, একটি পিস্তল, চাপাতি, ছুরি, ভাঙা তিন-চারটি মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ বেশ কিছু আলামত জব্দ করা হয়।

গতকাল সকালে অভিযান শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হকসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। তখনো বাড়িটি ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। ওই বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরী ও তাঁর দুই সহযোগীর এখানে মৃত্যু হয়েছে। তাদের (দুই সহযোগী) পরিচয় পরে জানানো হবে। ধারণা করছি, তামিম চৌধুরীর সবেচেয়ে বড় সহযোগীরও এখানে মৃত্যু হয়েছে। আমরা মনে করি, তামিম চৌধুরীর চ্যাপ্টার এখানেই শেষ হয়েছে।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা হুজুগে চলি না। আমরা সব কিছু তদন্তের ভিত্তিতে কাজ করে থাকি। আমরা যেটা বাস্তব সেটা নিয়েই কাজ করি। বাস্তবতা হলো, জঙ্গিরা সংখ্যায় খুব অল্প। তারা সমাজ ও জনবিচ্ছিন্ন। জনগণ এদের কোনো আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয় না। বাকিদেরও আমরা দ্রুত ধরতে সক্ষম হব।’

জঙ্গিদের জীবিত ধরা যাচ্ছে না। এতে তদন্তে তথ্যপ্রাপ্তিতে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হবে কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘জীবিত অবস্থায় ধরতে পারলে ভালো হতো। তবে এ নিয়ে আমরা মাথা ঘামাচ্ছি না। আমাদের গোয়েন্দারা কাজ করছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য রয়েছে।’

পুলিশপ্রধান এ কে এম শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘সকাল ৯টা ৩৫ মিনিট থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত প্রায় এক ঘণ্টার অভিযানের নেতৃত্ব দেয় ডিএমপি পুলিশ, সিটি পুলিশ, এলআইসি ও লোকাল পুলিশ। জঙ্গিদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলেও তারা তা না করে পুলিশের ওপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। পরে পুলিশ পাল্টা গুলি চালায়। অপারেশন শেষে আমরা ভেতরে ঢুকে দেখতে পাই তিনজন জঙ্গি নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজনের চেহারা তামিম চৌধুরীর যে ছবি আমাদের কাছে আছে, তার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে। এতে স্পষ্ট, সে তামিম চৌধুরীই হবে। তামিম চৌধুরী নিউ জেএমবির সামরিক শাখার প্রধান। সে গুলশান, শোলাকিয়া ও কল্যাণপুরের জঙ্গি হামলার মূল হোতা।’

আইজিপি বলেন, ‘কানাডাপ্রবাসী তামিমকে ধরার জন্য আমরা আগেই পুরস্কার ঘোষণা করেছিলাম। আজকের অভিযানে নিহত অন্য দুজনের পরিচয় শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে। তারা পাইকপাড়া এলাকায় ওষুধ ব্যবসায়ী পরিচয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছিল। সেখান থেকেই তারা জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। আস্তানা থেকে একটি একে-২২ রাইফেল, একটি পিস্তাল ও চারটি তাজা গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়েছে।’

যেভাবে অভিযান : সিটিটিসি সূত্র জানায়, গত ১ জুলাই গুলশানে জঙ্গি হামলার ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে তামিম চৌধুরীসহ কয়েক জঙ্গির নাম পাওয়া যায়। এর পর থেকে জঙ্গিদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। গত ২৬ জুলাই সকালে রাজধানীর কল্যাণপুরে অভিযানে ৯ জঙ্গি নিহত হয়, জীবিত ধরা পড়ে একজন। তার বয়ান থেকে তামিমসহ কয়েকজনের নাম জানতে পারে পুলিশ। সেই সূত্র ধরে তদন্তের সময় আরেক জঙ্গির দেওয়া তথ্যে নারায়ণগঞ্জের আস্তানার সন্ধান মেলে।

সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, জেএমবির এক সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর তার দেওয়া তথ্যে এই আস্তানার খোঁজ মেলে। এরপর এখানে ‘অপারেশন হিট স্ট্রং টুয়েন্টি সেভেন’ চালানো হয়।

সিটিটিসি ইউনিটের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের প্রধান ছানোয়ার হোসেন বলেন, ময়মনসিংহের ডিবি পুলিশ ত্রিশাল এলাকা থেকে এক জেএমবি জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করে। জিজ্ঞাসাবাদে ওই জঙ্গি নারায়ণগঞ্জের আস্তানার সন্ধান দেয়। পরে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় পাইকপাড়া এলাকায় তল্লাশি শুরু করে পুলিশ। রাতে বাড়িটি শনাক্ত করে তারা। রাত আড়াইটা থেকে বাড়ির চারপাশে অবস্থান নেয় সোয়াত টিম। এরপর আরেকটি দল বাড়ির মালিকের সঙ্গে কথা বলে নিশ্চিত হয়, তিনতলায় কারা কারা অবস্থান করছে। জঙ্গিরা অবস্থান করছে—এমন তথ্য নিশ্চিত হওয়ার পর হ্যান্ড মাইকের মাধ্যমে জঙ্গিদের আত্মসমর্পণ করতে বলা হয়। জঙ্গিরা টের পেয়ে দরজা খোলেনি। ভোরের দিকে আবারও আত্মসমর্পণ করানোর চেষ্টা শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত জঙ্গিদের আটক ও আত্মসমর্পণের চেষ্টা চালানো হয়। এ সময় জঙ্গিরা তাতে সাড়া না দিয়ে উল্টো গ্রেনেড ছুড়ে মারে। পরে অপারেশন ‘হিট স্ট্রং টোয়েন্টি সেভেন’ শুরু হয়। অভিযান চলে এক ঘণ্টা। অভিযান শেষে তৃতীয় তলায় ঢুকে তিনজনের মৃতদেহ দেখা যায়।

ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘জঙ্গিরা ঘটনাস্থলে দুটি গ্রেনেড চার্জ করে। আমরা চারটি তাজা গ্রেনেড উদ্ধার করে নিষ্ক্রিয় করেছি। একটি একে-২২ রাইফেল ও একটি পিস্তল পাওয়া গেছে। কিছু জিহাদি বই পড়ে ছিল। জঙ্গিরা তাদের মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ ভেঙে ফেলেছে। সেগুলো ভাঙা অবস্থাতেই পাওয়া গেছে। তারা আগুন ধরিয়ে এসব জ্বালিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেছে। লাশ সরানোর পর জব্দ তালিকা করা হলে এ ব্যাপারে পুরোপুরি জানা যাবে।’

নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ফারুক হোসেন বলেন, ‘অভিযান শুরুর পর জঙ্গিরা বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, তারা নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলেছে। তবে ওই আগুন খুব একটা ছড়ায়নি।’

যে বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে সে বাড়ির নিচতলার ভাড়াটিয়া খাজা আহমেদ খান বলেন, ‘আমরা সকাল ৭টার পর টের পেয়েছি। বাইরে অনেক পুলিশ ছিল। তারা আমাদের দরজা বন্ধ করে ঘরেই থাকতে বলে। এর অনেক সময় পরে ওপরে গোলাগুলি শুনি। গত মাসে কয়েকজন ওপরের ফ্ল্যাটে ভাড়া ওঠে। তবে তাদের চালচলনে মনে হয়নি যে তারা জঙ্গি হতে পারে।’

ময়নাতদন্ত হবে ঢাকা মেডিক্যালে : অভিযানের পর গতকাল সকালেই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আলামত সংগ্রহ করে। বিকেলে আলামত সংগ্রহ শেষে সন্ধ্যা ৬টার দিকে তিনজনের লাশ উদ্ধার করে নারায়ণগঞ্জের ১০০ শয্যা হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। তবে পরে সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হয়। নারায়ণগঞ্জের সিভিল সার্জন আশুতোষ দাস জানান, এখন লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। সেখানেই ময়নাতদন্ত হবে।

ছবি-ভিডিওচিত্রে ঘটনাস্থল : গতকাল দুপুরে অভিযানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে জঙ্গি আস্তানার ভেতরে লাশ পড়ে থাকার ছবি পেয়েছেন সাংবাদিকরা। এসব ছবিতে দেখা যায়, তামিম আহমেদ চৌধুরী একটি কক্ষে দরজার পাশে উপুড় হয়ে পড়ে আছে, পাশে রক্ত। ছবিতে আগের চেহারার মতোই তার মুখে ফ্রেঞ্চ-কাট দাঁড়ি দেখা গেছে। তার লাশের পাশে একটি সাদা প্লাস্টিকের বস্তা দেখা গেছে।

আরেক দৃশ্যে দেখা গেছে, নিহত অন্য দুই জঙ্গির লাশ পাশাপাশি পড়ে আছে। একজনের মৃতদেহ চিত হয়ে আছে, তার গলায় রাইফেল ঝোলোনো। পাশে রক্ত, একটি ইট, কয়েকটি পানির বোতল ও প্লাস্টিকের বস্তা। ওই জঙ্গির পাসহ শরীরে বিস্ফোরণের আঘাতের চিহ্নও আছে। তার পাশেই বাঁদিকে কাত হয়ে পড়ে আছে আরেক জঙ্গির মৃতদেহ। তিনজনের পরনেই টি-শার্ট ও প্যান্ট ছিল। অভিযানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তিন কক্ষের মধ্যে ভালো শোওয়ার কক্ষ বা মাস্টার বেডের দরজার কাছে ছিল তামিমের লাশ। অন্য দুজনের লাশ ছিল ভিন্ন কক্ষে। দুজনের শরীরে বোমা বিস্ফোণের আলামতের চিহ্নও আছে। পুলিশের অভিযানের সময় জঙ্গিরা নিজেরাই বোমা ফাটিয়ে থাকতে পারে বলেও সন্দেহ করছেন তদন্তকারীরা।

পুলিশের করা একটি ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, একটি কক্ষে একটি প্লেটে তিন-চার টুকরা কাটা আপেল পড়ে আছে। একজনের লাশের পাশে একটি ছুরি ও একটি চাপাতি পড়ে ছিল। ওই চত্বরের মধ্যেই একটি টিনশেড বাসা আছে। তার চালে অবিস্ফোরিত একটি গ্রেনেডও দেখা যায়।

উদ্বেগে কেটেছে রাত, সকালে আতঙ্ক : স্থানীয়রা জানায়, শুক্রবার থেকেই এলাকায় পুলিশের আনাগোনা ছিল। তবে সেখানে কোনো জঙ্গি আস্তানা থাকতে পারে—এমন ধারণা ছিল না স্থানীয় কারো কাছে। স্থানীয় বাসিন্দা সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘রাত থেকেই বুঝতে পারছিলাম কিছু হচ্ছে। প্রথমে ভেবেছি এক মাদক ব্যবসায়ী আছে, ওরে ধরতে আসছে পুলিশ। পরে অনেক রাতে দেখি পুলিশে ভরে গেছে। সারা রাত ঘুম হয়নি। সবার মধ্যেই টেনশন ছিল—কী না জানি হয়েছে। পরে সকালে গুলির শব্দ পাই। তখন এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।’

টিটু নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, ‘ভোররাতেই টের পাইছি। ভোরে নিতাইগঞ্জে যাব, দেখি পুলিশ রাস্তা আটকে দিছে। সকালে ১০টার দিকে দেড় শর বেশি গুলি হইছে। এর আগে একবার বোমার শব্দও শুনছি।’

পাইকপাড়া বড় কবরস্থানের সহকারী খাদেম সাইদুর রহমান বলেন, সকাল ৭টার দিকে তিনি কবরস্থানে আসার সময় পুলিলের বেষ্টনী দেখেন। এরপর ৯টার দিকে গোলাগুলির শব্দ শুনতে পান। তবে তখনো কিছুই বুঝে উঠতে পারেননি। পরে জঙ্গি আস্তানার ব্যাপারে জানতে পারেন। সাইদুর বলেন, ‘ওই বাসায় জঙ্গি থাকতে পারে, তা ভবতেও পারছি না।’

কে এই তামিম চৌধুরী : সূত্র জানায়, কানাডায় বেড়ে ওঠা তামিম আহমেদ চৌধুরী (৩০) হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় মূল পরিকল্পনাকারী বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় ঘরছাড়া তরুণ-যুবকদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিখোঁজ ১০ জনের যে প্রথম তালিকা দিয়েছিল, তাতে সিলেটের তামিমের নাম ছিল। এর আগে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস বাংলাদেশে দলের শাখাপ্রধান হিসেবে যে আবু ইব্রাহিম আল হানিফের নাম ঘোষণা করেছিল, তামিমকে সেই আবু ইব্রাহিম বলে মনে করছিল অনেকে। কানাডার পত্রিকা ন্যাশনাল পোস্ট এক খবরে বলেছে, বাংলার খেলাফত দলের প্রধান শায়খ আবু ইব্রাহিম আল হানাফি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক। তার নামই তামিম চৌধুরী। গত ২ আগস্ট তাকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেন আইজিপি।

তামিম সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার দুবাগ ইউনিয়নের বড়গ্রামের প্রয়াত আব্দুল মজিদ চৌধুরীর নাতি। মজিদ চৌধুরী একাত্তরে শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তামিমের বাবা শফি আহমদ জাহাজে চাকরি করতেন। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে তিনি সপরিবারে কানাডায় পাড়ি জমান। কানাডার উইন্ডসরে থাকার সুবাদে তামিমের বেড়ে ওঠাও সেখানে। পরিবার সম্পর্কে বিস্তারিত জানা না গেলেও গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তামিম তিন সন্তানের জনক। সে ২০১৩ সালের অক্টোবরে দুবাই হয়ে বাংলাদেশে এসেছিল বলে গত ২ আগস্ট সংবাদ সম্মেলনে জানান সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম। ওই সময় তামিমের সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতার দাবি প্রত্যাখ্যান করে আইজিপি তাকে (তামিম) নব্য জেএমবির শীর্ষনেতা বলে চিহ্নিত করেন। আইজিপি বলেছিলেন, গুলশান হামলাকারীদের তামিমই রিক্রুট করেছিল।

গুলশান হামলার পর কল্যাণপুরে যে জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালানো হয়, সেখানেও তামিমের অবস্থান ছিল। অভিযানের আগে সে পালিয়ে যায়।

গতকাল অভিযানের পর আইজিপি শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ‘তামিম চৌধুরী সিরিয়াতে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে এসেছিল। গুলশান হামলা, শোলাকিয়ার ঘটনাসহ যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, সবগুলো তামিমের নেতৃত্বে ‘নিউ জেএমবি’ ঘটিয়েছে।

তামিমের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কেউ : তামিম চৌধুরীর সঙ্গে নিহত অন্য দুই জঙ্গি সম্পর্কে সিটিটিসি ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘এদের একজন নব্য জেএমবির ‘গুরুত্বপূর্ণ’ কেউ বলে আমরা ধারণা করছি।’

সিটিটিসি সূত্র জানায়, কল্যাণপুরের জঙ্গি আস্তানায় তামিমের নিয়মিত যাতায়াত ছিল। সে দেশীয় জঙ্গিদের আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছিল। কল্যাণপুরের আস্তানা থেকে গ্রেপ্তার রাকিবুল হাসান ওরফে রিগ্যান পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে এই দলটির ব্যাপারে তথ্য দেয়। রিগ্যান পুলিশকে জানিয়েছে, কল্যাণপুরে তাদের জঙ্গি আস্তানায় তামিম চৌধুরী, রিপন, খালিদ, মামুন, মানিক, জোনায়েদ খান, বাদল ও আজাদুল ওরফে কবিরাজ নামের ব্যক্তিরা নিয়মিত যাতায়াত করত। তারা তাদের ধর্মীয় ও জিহাদি কথাবার্তা বলে উদ্বুদ্ধ করত। প্রয়োজনে টাকা-পয়সা দিয়ে যেত। সূত্রমতে, পলাতক জঙ্গিদের মধ্যে তামিম চৌধুরী ও জোনায়েদ খান ছাড়া অন্য নামগুলো জঙ্গি নেতাদের ছদ্মনাম বলে ধারণা করা হচ্ছে।

১০ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ :  গত রাতে নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন জানান, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়াসহ ১০ জনকে আটক করা হয়েছে। তারা হলো বাড়ির মালিক নূর উদ্দিন, তাঁর স্ত্রী রুনা, ছেলে নিপুণ, সিয়াম, ভাড়াটিয়া হুমায়ূন কবীর, তাঁর স্ত্রী ঝর্ণা বেগম, চটপটি বিক্রেতা সোলেমান, তাঁর স্ত্রী সালমা, মেয়ে সুমাইয়া ও ভাগিনা বাবু।

জব্দ তালিকা : গত রাতে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি আসাদুজ্জামান জানান, জঙ্গি আস্তানা থেকে ২০ রাউন্ড গুলি, দুটি ম্যাগাজিন, একটি একে ২২ রাইফেল, একটি পিস্তল, তিনটি চাপাতি, একটি ছোরা, কয়েকটি হাতুড়িসহ কিছু জিনিসপত্র জব্দ করা হয়েছে। এ ঘটনায় একটি মামলা দায়েরের প্রক্রিয়া চলছে বলেও জানান ওসি।

Print Friendly, PDF & Email