May 17, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

আইলার ৭ বছর : পুনর্বাসিত হয়নি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সাত বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ মে সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সৃষ্ট সর্বনাশা আইলা আঘাত হানে দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় জনপদে। মুহূর্তের মধ্যে সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও খুলনা জেলার কয়রা ও দাকোপ উপজেলার উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকা লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। সর্বগ্রাসী আইলার সাতবছর পূর্তি হলেও আইলা কবলিত হাজার হাজার পরিবার এখনও পুনর্বাসিত হয়নি। আশ্রয়হীন এ জনপদে এখনও চলছে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও খাবার পানির জন্য তীব্র হাহাকার। সর্বগ্রাসী আইলা আজও উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা ও খুলনার ক্ষতিগ্রস্ত হাজার হাজার মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে।

ভয়াবহ আইলায় স্বাভাবিকের চেয়ে ১৪-১৫ ফুট উচ্চতায় সমুদ্রের পানি এসে নিমিষেই ভাসিয়ে নিয়ে যায় নারী ও শিশুসহ কয়েক হাজার মানুষ, হাজার হাজার গবাদিপশু ও ঘরবাড়ি। ক্ষণিকের মধ্যে গৃহহীন হয়ে পড়ে লাখো পরিবার। লাখ লাখ হেক্টর চিংড়ি আর ফসলের ক্ষেত তলিয়ে যায়। ধ্বংস হয়ে যায় উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধ আর অসংখ্য ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। সর্বনাশা আইলার আঘাতে শুধু সাতক্ষীরায় নিহত হয় ৭৩ জন নারী, পুরুষ ও শিশু আর আহত হয় দুই শতাধিক মানুষ।

প্রলয়ঙ্কারী আইলা আঘাত হানার সাত বছর পেরিয়ে গেলেও উপকূলীয় অঞ্চল সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর ও আশাশুনির প্রতাপনগর এবং খুলনার কয়রা ও দাকোপ এলাকায় মানুষের হাহাকার এতটুকু থামেনি। দু’মুঠো ভাতের জন্য জীবনের সাথে রীতিমত লড়াই করতে হচ্ছে তাদের। আইলার পর থেকে এসব এলাকায় সুপেয় পানি সঙ্কট প্রকট আকার ধারণ করেছে। খাবার পানির জন্য ছুটতে হচ্ছে মাইলের পর মাইল। আইলা কবলিত এ অঞ্চলের রাস্তাঘাট এখনও ঠিকমত মেরামত হয়নি। ফলে উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত সবাই চালাচ্ছে বেঁচে থাকার সংগ্রাম। ক্ষতিগ্রস্ত আইলা কবলিত এ বিশাল জনপদে খুবই কম সংখ্যক সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। আইলা’র ভয়াবহতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নে বসবাসরত মানুষের চোখে মুখে এখনও ভয়ঙ্কর সেই স্মৃতি। আইলার সাত বছর পেরিয়ে গেলেও আইলাকবলিত অঞ্চলের ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট এখনও ঠিকমত সংস্কার হয়নি। আইলার আঘাতের পর থেকে গোটা এলাকা উদ্ভিদশুন্য হয়ে পড়ে। কৃষি ফসল ও চিংড়ি উৎপাদন বন্ধ থাকায় গোটা এলাকাজুড়ে তীব্র কর্মসংস্থান সংকট। কর্মহীন মানুষ অনেকেই এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে বাইরে চলে গেছে। অপরদিকে বনদস্যুদের অত্যাচারে সুন্দরবন, কপোতাক্ষ ও খোলপেটুয়া নদীর উপর নির্ভরশীল এ এলাকার মানুষের জীবনযাপন দুর্বিসহ হয়ে পড়েছে। ফলে বিকল্প কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা না থাকায় স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে পারছেন না উপকূলীয় এ জনপদের প্রায় ৮০ হাজার মানুষ। আইলার পরপরই কিছু সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে কাজের বিনিময় খাদ্য প্রকল্পের কাজ হলেও এখন আর কোনো কাজ হচ্ছে না। আর এ কারণেই ক্রমে ক্রমে বাড়ছে দরিদ্র ও হতদরিদ্রের সংখ্যা।

এদিকে, আইলার সাত বছর অতিবাহিত হলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপকূলরক্ষা বেড়িবাঁধগুলোর ভয়াবহ ফাঁটল দেখা দেওয়ায় ও সংস্কার না করায় সামান্য ঝড় কিংবা বৃষ্টিতে ঝুঁকির মধ্যে থাকতে হচ্ছে এ জনপদের কয়েক লাখ মানুষকে। তাই উপকূলীয় এ জনপদের মানুষের সরকারের কাছে দাবি টেকসই উপকূলরক্ষা বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মস্থানের ব্যবস্থা করা।

আইলা বিধ্বস্ত শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলী আজম টিটো জানান, দুর্গত এলাকা এখনও নানা সমস্যায় জর্জরিত। খাবার পানির তীব্র সংকট। আইলায় মিষ্টি পানির আধারগুলো সব নষ্ট হয়ে গেছে। আজও পুকুর বা জলাশয় খনন করে মিষ্টি পানি সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এলাকায় কাজ নেই। উপকূল রক্ষা বেড়িবাঁধের অবস্থা খুবই নাজুক। নদীতে বড় ধরনের জোয়ার এলেই বেড়িবাঁধ উপচে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। এলাকায় কাজ-কর্ম না থাকায় বহু মানুষ আইলার পরে আর এলাকায় ফিরতে পারেনি। তারা দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলে গেছে। সুন্দরবনে উপর নির্ভরশীল বনজীবীরা ডাকাতির উৎপাত বৃদ্ধি পাওয়ায় সেখানেও যেতে পারছে না।

এ ব্যাপারে শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু সায়েদ মো. মনজুর আলম জানান, আইলার ক্ষত কাটিয়ে তুলতে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থা এখনও দুর্গত অঞ্চলে কাজ করে যাচ্ছে। বেড়িবাঁধ, সুপেয় পানিসহ যে সব সমস্যা রয়েছে তা সমাধানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার যৌথ প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নদী ভাঙন বা বেড়িবাঁধগুলো স্থায়ীভাবে সংস্কার করার জন্য ইতোমধ্যে ঊর্ধ্বতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে।

এলাকাবাসীর দাবি, প্রতিশ্রুতি নয়, তারা দেখতে চায় সরকার অতিদ্রুত এসব সমস্যার সমাধানে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।

Print Friendly, PDF & Email