টম এঞ্জেলহার্ট :
আজ ১১ই সেপ্টেম্বর। বৈশ্বিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার এবং টুইন টাওয়ারে বীভৎস হামলার ঐতিহাসিক অন্ধকারাচ্ছন্ন এক দিন। ১৪ বছর আগে ২০০১ সালের এই দিনে যুক্তরাষ্ট্রে ৪টি আত্মঘাতি হামলায় প্রাণ হারান অন্তত ৩ হাজার মানুষ৷ ঘটনার ব্যাপকতায় বিস্মিত হয় মার্কিন জাতি। সেদেশের রাষ্ট্র-মিডিয়া-বুদ্ধিজীবী মিলে সমস্বরে বলতে থাকে, ঐতিহাসিকতার বিচারে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচে ন্যাক্কারজনক ঘটনা এটি। তবে ভিন্ন কণ্ঠে হাজির হন খোদ একজন মার্কিনি। ষাটের দশকের উত্তাল দিনগুলোতে যিনি বিকশিত হয়েছেন, সেই মার্কিন ভাষাতাত্ত্বিক ও রাজনীতি বিশ্লেষক নোম চমস্কি বলেন, ঘটনাটা ঐতিহাসিক বটে। তবে সেটা এই কারণে যে, ’এই প্রথমবারের মতো বন্দুকের নল উল্টোদিকে ঘুরল!’ চমস্কি বলতে চেয়েছিলেন, সারাজীবন যারা দুনিয়াজোড়া আক্রমণ/সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়েছে, তারা প্রথমবারের মতো সস্ত্রাসের শিকার হলো। তবে থেমে থাকেনি যুক্তরাষ্ট্র।
হামলার সাথে সাথেই যুক্তরাষ্ট্রের সন্দেহ গিয়ে পড়ে ওসামা বিন লাদেনের উপর৷ শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের কথিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান৷ ‘অনন্ত যুদ্ধ’দিন শুরু হয়। একের পর এক ধ্বংস হয় এক একটি সভ্যতা। আফগানিস্তান থেকে ইরাক, সেখান থেকে লিবিয়া-সিরিয়া… অনন্ত যুদ্ধ চলছেই। হামলার এতোদিন পর এসেও ওই ৯/১১’র প্রেক্ষাপটেই এই ১৪টি বছরকে দেখতে চেয়েছন বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং ইউনাইটেড স্টেট অফ ফিয়ার এবং হিস্টোরি অফ কোল্ড ওয়ার এর লেখক টম এঞ্জেলহার্ট। ৯/১১’র হামলাকে উপজীব্য করে, মার্কিন স্বেচ্ছাচারী ক্ষমতার এক খতিয়ান হাজির করেছেন তিনি। পাঠকদের জন্য সেই রচনার সংক্ষেপিত ভাবানুবাদ তুলে ধরা হলো।
…………………………………………………………………………..
১৪ বছর পার হয়ে গেল… আপনি কি এখনও বিশ্বাস করেন ৯/১১এ সম্পর্কে যা বলা হয়েছিলো, তার সবটা ঠিক? আমরা কি এখনো সেই ২০০১ সালের ধারণা নিয়েই বাস করছি?
১৪ বছরের যুদ্ধ, আগ্রাসন, হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ, যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার পরিধি বৃদ্ধি, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামি উগ্রবাদ… ১৪ বছরের মহাকাশ বিনিয়োগ, বোমা হামলা, সামরিক নীতি, হতাশা ও ধ্বংসযজ্ঞ… ১৪ বছরে মার্কিন সাম্রাজ্যে ভীতির সংস্কৃতি, সীমাহীন আতঙ্ক ও হুমকি, সন্ত্রাসী আক্রমণের আশঙ্কা… ১৪ বছরের মার্কিন গণতন্ত্র যখন ধনকুবেরদের খেলার মাঠ… ১৪ বছরের গোপনয়ীতা এবং নিরাপত্তার স্বার্থে মার্কিন জনগণকে সবসময় অন্ধকারে রাখা… ১৪ বছরে নাগরিকদের অব্যাহতি, যুদ্ধ-বাণিজ্যের ক্রম-উত্থান, যুদ্ধে তথ্য প্রদানের মাধ্যমে লাভজনক অবস্থা তৈরি এবং পেন্টাগনে অসংখ্য বেসরকারি কন্ট্রাক্টর নিয়োগ… এনএসএ, সিআইএ এবং জাতীয় স্বার্থে অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থায় পরিবর্তন… ১৪ বছরে পুলিশের সামরিকীকরণ এবং ড্রোন ও স্টিংরে এর মাধ্যমে যুদ্ধপ্রযুক্তির প্রসার… ১৪ বছর ধরে ‘হোমল্যান্ড’ নামে ‘অমার্কিনী’ শব্দের প্রচলন… ১৪ বছরে বৈশ্বিক নজরদারির প্রসার যখন শিখরে… এই হলো টুইন টাওয়ার হামলার পর থেকে আজ পর্যন্ত পরবর্তী ১৪ বছর…
মার্কিনী অবকাঠামোর ইতিহাসে এই ১৪ বছরে এক মাইল রেলওয়েও তৈরি হয়নি। তবে এই ১৪ বছরে আফগান যুদ্ধ হয়েছে, ইরাকযুদ্ধ হয়েছে, সিরিয়া যুদ্ধ হয়েছে। তাই ১৪ বছর পরে ধন্যবাদ জানাতে হয় ওসামা বিন লাদেনকে। মনস্তাত্তিকভাবে বলতে হয়, ৯-১১ এর হামলা আসলে এমন এক অবস্থা তৈরি করেছে যেটা মার্কিন নেতারা অনেকদিন ধরেই স্বপ্ন দেখে আসছিলো।
৯/১১ এর ঘটনা যেন আমাদেরকে যেকোনো কিছু করার লাইসেন্স দিয়ে দেয়। যেকোনো কাজে নিজেদের নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য ৯/১১ যেন যথেষ্ট। আর এই ব্যাপারটি খুব ভালোভাবে কাজও করেছে। আমাদের বিশ্বাস করানো হয়েছে যে ‘তারা (মুসলমানরা/সন্ত্রাসী-জঙ্গীরা) আমাদের স্বাধীনতা পছন্দ করে না।’ আপনারা (যুক্তরাষ্ট্র) আমাদের দেশকে ১৪ বছর ধরেই যেন বোকা বানিয়ে আইন, পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নিয়ে যাচ্ছেন। যুদ্ধ শুধু আপনার একাই করেন নি, আমাদেরকেও ব্যবহার করেছেন। আর মুসলিম বিশ্বে অশান্তি তৈরির জন্য ঠিক এটাই আপনাদের প্রয়োজন ছিলো।
১৪ বছরের পরে আমি মনে করিয়ে দিতে চাই যে ৯/১১ এর ঘটনা কতটা অভাবনীয় ছিলো এবং আমরা এ বিষয় নিয়ে কতটা অন্ধকারে ছিলাম। ৬ আগস্ট ২০০১ সাল জর্জ ডব্লিউ বুশকে লাদেনের মার্কিন হামলার কথা গোয়েন্দা সূত্রে জানানো হলেও তিনি বিশ্বাস করেন নি। এনএসএ, সিআইএ, এফবিআই সবগুলো গোয়েন্দা সংস্থার কাছেই এই হামলার খবর ছিলো। তবুও তারা এটা ভাবতে পারেনি। এমনকী যখন ঘটনাটি ঘটছে তখনও আমার বিশ্বাস হচ্ছিলো না। আমি তখন আমার বেডরুমে অনুশীলন করছিলাম। টিভি খুলে দেখি ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আঘাত আনা হয়েছে এবং সেখান থেকে ধোয়া বের হচ্ছে। এবং তখন আমার ১৯৪৫ সালে এম্পায়ার বিল্ডিং ধ্বংসের কথাই মনে হয়েছে।
সন্ত্রাসীরা ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ধ্বংস করে ফেলছে? আল-কায়েদা? ব্যাপারটি তখনও বিশ্বাস হচ্ছিলো না। পরে যখন আরো দুটি বিমান নিউইয়র্কে হামলা হলো এবং একটি পেন্টাগনে আঘাত করলো তখন বুঝতে পারছিলাম এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। তখনই আমার মনে হয়েছিলো যে, মার্কিনীদের এই দুর্বলতার প্রতিঘাত হবে অন্যরকম,। এর ভুক্তোভোগী হবে অন্যরা।
১৪ বছর পরে এসে আপনার কি মনে হয় না যে সেই একটি হামলার অজুহাতে (৯/১১এর হামলা) জর্জ বুশ বোঝানোর চেষ্টা করেছেন যে বিশ্বটা আসলে তাদের। বিশ্ব সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে তাদের কোনো সময়ই লাগেনি। ৬০টি দেশে তারা তাদের এই অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে। জেমস বন্ড ছবির মতো ‘খারাপ মানুষদের’ সঙ্গেই যেন যুদ্ধ ঘোষণা করে বসে মার্কিন সরকার। ৯/১১ এর ঘটনার দিকে ফিরে তাকালে কি একটুও অবাক লাগে না?
আপনার কি মনে হয় না বুশ প্রশাসন সামরিক কতৃপক্ষের দ্বারা মোহাবিষ্ট ছিলো। বিশ্ব বদলানোর এবং শান্তির জন্য সামরিক বাহিনীর অসীম শক্তি কি একটুও অবাক করে আপনাকে? আপনার কি মনে হয় না, পেন্টাগন হামলার পর প্রতিরক্ষা সচিবের দেয়া নির্দেশে ইরাক আক্রমণের ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত? কারণ তিনি তো জানতেনই যে হামলা আল-কায়েদা করেছে। তিনি স্বষ্ট করে বলেছিলেন, ‘জোর পদক্ষেপ নাও, সব ধুয়ে ফেলো সেটার সম্পর্ক থাকুক বা না থাকুক।’ আক্রমণের প্রতিশোধ যে শুধু ওসামা বিন লাদেনের উপর নয়, বরং আফগানিস্তান, ইরাক এবং সম্ভবত ইরানের উপরও পড়ছে এই ব্যাপারগুলো কি একটুও কৌতুহল জাগানিয়া নয়?
১৪ বছর পরে এটা কতটা কল্পনীয় যে তখন যেই দেশটিকে পরম পরাশক্তি মনে করা হতো, সেই দেশটিকে অল্প কিছু জিহাদীদের নিয়ে একটা সংগঠন এরকম চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। যেখানে আল-কায়েদার চেয়ে মার্কিন সামরিক বাহিনী ১০ থেকে ১৩ গুণের চেয়েও বেশি শক্তিশালী। এবং বলা হতো তাদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা কোনো যুদ্ধ জয় করতে সম্ভব নয়। কিন্তু এই বিষয়গুলো যদি ১২ সেপ্টেম্বর ২০০১ এ আপনি বলতেন তবে নিশ্চিতভাবে জনগণের মার খেতে হতো আপনাকে।
১৪ বছর পরে কি আপনার মনে হয় না যে মার্কিন সরকার এখনো তাদের ইরাক ও আফগানিস্তান থেকে মুক্ত করতে পারেনি? যদিও ২০১১ সালে একটি দেশ ছেড়ে চলে আসে তারা এবং ২০১৪ সালে আবারো ফিরে যায়। বারবার এই অভিযানের সমাপ্তি ঘোষণা করলেও পুনরায় যেন সেখানেই ফিরে যায় তারা।
১৪ বছর পরে কি আপনার মনে হয় না যে, ওয়াশিংটনের ৯/১১ এর পরবর্তী নীতিগুলো মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেট এর ‘খিলাফত’ তৈরি করতে সাহায্য করেছে? ভঙ্গুর ইরাক ও সিরিয়ায় যাত্রা শুরু করা এই সংগঠনটি এখন লিবিয়া, নাইজেরিয়া এবং আফগানিস্তানেও তাদের শাখা খুলেছে। কিন্তু যদি ২০০১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর এই সম্ভাবনার কথা বলা হতো তবে নিশ্চিতভাবেই পাগল মনে করা হতো আপনাকে।
১৪ বছর পরে আপনার কি অদ্ভূত লাগে না যে যুক্তরাষ্ট্রই এখন হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। আপনার কি অবাক লাগে না যে এসব কিছুই সন্ত্রাস নির্মুলের নামে করা হচ্ছে? আমাদের ড্রোন যেখানেই আঘাত আনুক না কেন আমরা তো আসলে সন্ত্রাস নির্মুল করছি!
১৪ বছর পরে এটা ভাবতে অবাক লাগে না যে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের এই যুদ্ধ সবসময় সন্ত্রাসের যুদ্ধই ( war of and for terror) হয়ে দাঁড়ায়? আমাদের পদ্ধতিই যেন ইসলামি উগ্রবাদী নেতাদের হত্যা করা। সেই ২০০১ এর হামলার পর যেটা আসলে আমাদের সামনে নিয়ে আসা হয়েছিলো। এসকল সংগঠনগুলো শক্তি সম্পর্কে কি ওয়াশিংটনের কোনো ধারণাই ছিলো না?
১৪ বছর পরে এটা চিন্তা করা কি সম্ভব নয় যে, ৯/১১ আসলে একটি গণকবর যেখানে মার্কিন জীবনকে আমরা যেরকম জানতাম, চিরকালের জন্য তা ঘুমিয়ে গেছে?
এ বিভাগের আরো..
অতিরিক্ত ভালোবাসা ঠিক নয়
সংসদ সদস্যকে আইন প্রনয়ন নয়, মানতেও হবে
জাতীয় চারনেতা হত্যা নেপথ্যে থাকা কুশলীব কারা