May 16, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

মুক্তিযুদ্ধে ছোট ভাইয়ের আত্মত্যাগ

শ্রীরাস বিহারী আদিত্য: একাত্তরকে স্মরণে রাখা খুব প্রয়োজন। অনেকে ভুলে গেলেও আমি কখনো ভ’লতে পারিনি আমার ছোট ভাইয়ের কথা। ভুলতে পারা যায় না, ভুলতে পারি না।

১৯৭১-এর কথা লিখতে গেলে শুরু করতে হয় সিলেটের ভাটি অঞ্চলের দিরাইয়ের কথা দিয়ে। আমি, কুঞ্জ বিহারী মজুমদার (কাব্যতীর্থ) ও প্যারীকে সাথে নিয়ে সৎসঙ্গের এক অনুষ্ঠানে যাই। যতদূর মনে পরে প্যারী মোহন আদিত্য আলোচনায় বলেছিল যে, ’মানুষের দেহ-মন একটি যন্ত্র। ভালভাবে খুঁচিয়ে দেখলে দেখা যাবে, দেহ ও মনের সমাবেশ ঘটে একটি নিয়মের মধ্যে। যেমন, মানুষের চোখ একটি সুন্দর ক্যামেরা। কোন জিনিসের দিকে তাকালে তার উল্টো ছবি ধরা পড়ে চোখের রেটিনাতে। অপটিক র্নাভ ব্রেনে একটি সিগ্যন্যার পাঠিয়ে এই উল্টো ছবি সোজা করার ব্যবস্থা করে। এ কাজটি কীভাবে হয় তা এখনো রহস্যের মধ্যে’। ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বাস্তবতাকে মেনে কাজ করাই ওর বড় গুণ ছিল। প্যারী মোহন ছিলো শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র প্রতিষ্ঠিত পাকুটিয়াস্থ সৎসঙ্গ আশ্রমের কার্যকরী পরিষদের সদস্য এবং সৎসঙ্গ সংবাদের সহ-সম্পাদক। তাঁর লিখার লিখনিতে ছিল মানবতা, ধর্ম এবং বাঙালী এবং বাঙালী জাতিয়তাবাদের কথা। হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একাত্ম।

১৯৭১ এর মার্চে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে অন্যান্য অফিসের মত সৎসঙ্গ ফিলনথ্রপীর কর্মীদের সাথে নিয়ে অফিস বন্ধ করেছে। সে সময়ে দেশে বাঙালী ও অবাঙালী দৃশ্যত দুটি ভাগ দেখা দেয়। যাই হোক, সে আশ্রমের চারিপাশে ফুল ও সবজ্বির বাগান করতো। একদিন বাগানে পায়চারী করতে ছিল। সময়টা ফের্রুয়ারী মাস। বসন্তের হাওয়া আমাদের বাগানটিতে ফুলে ফুলে পরিপূর্ণ ছিল। বাগানে মৌসুমি ফুলের ঢল নেমেছে। মাঝে মাঝে ও তন্ময় হয়ে ফুলগুলো দেখতো। মনে হতো ফুলগুলো ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আমরা কেউ জানতাম না এই ফুল, এই বাগান, এই হাসি, এই আনন্দ, এই সবজ্বির বাগান, ছবির মতো সাজানো পরিপাটি সংসার একাত্তরেই শেষ হয়ে যাবে। সত্যিই শেষ বেলায় শেষ বারের মতো দুই হাত দিয়ে বাগানটি সাজিয়েছিল।

ভয়ঙ্কর একটি তারিখ ২৫ মার্চ, ১৯৭১। মাত্র একদিন আগেই প্যারী মোহনকে সাথে নিয়ে জাতির জনককে আশ্রম পরিদর্শনে জন্য আবেদন জানিয়েছিলাম। ২৫ মার্চ রাতে প্যারী মোহন জানতে পেরেছে যে, ঢাকার অবস্থা ভাল না। প্যারীকে উত্তেজিত মনে হল এরং বলল পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। আমরা কেউই এখন নিরাপদে নেই। প্রতিটি বাঙালী ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে চারিদিক আরো খারাপ হতে লাগল। এদিকে আমাদের গ্রামটি জনশুন্য হয়ে আসছে। আমরা আশ্রম থেকে অনেক দুরে চলে গেলাম। প্যারী পরে আসবে না বলে আশ্রমে রয়ে গেল। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভষণের পর থেকে প্যারী মোহন বীরপ্রতীক মোঃ খোরশেদ আলম তালুকদারের সাথে আরো বেশি যোগাযোগ বাড়িয়ে দিল। অবশেষে ২৫ র্মাচ মধ্য রাতে ঢাকা ও অন্যান্য শহরে নিরস্ত্র সাধারণ মানুয়ের উপর ইতিহাসের এক ঘৃন্য গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এবং রাত ১.১০ মি. বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নং বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।

৪ এপ্রিল, ১৯৭১ বেলা বারটার সময সৎসঙ্গ আশ্রমের বিপদঘন্টা বেজে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আত্ম চিৎকার, ছুটাছুটি, গুলির শব্দ এবং চারপাশের বাড়ী ঘড়ে আগুন। গুলি ও সেল নিক্ষেপে আশ্রমের মঠটি বিকট শব্দ করে ভেঙ্গে পড়ল। জানতে পারলাম পাক হানাদার বাহিনী আশ্রম আক্রমন করেছে এবং আশ্রমের অনেক ক্ষতি করেছে। পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোলাটে এবং বিপদগ্রস্থ। সমস্ত গ্রাম প্রায় জনশূন্য। হাট বাজার বসছে না। দোকান পাট বন্ধ। আশ্রমের পূর্ব দিকে পাহাড় ও গ্রামের ঝোপে আশ্রয় নিয়েছে অনেক মানুয়। তাদের এখন খাদ্যের দরকার। ভীষণ অভাব। মুক্তিযোদ্ধাদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য পাকিস্তানী সৈন্যরা বিমান থেকে বোমা বর্ষণ করছে।

আমরা সবাই আরও কিছদিন আত্মগোপন করে থাকলাম। এই রকম যখন পরিস্থিতি তখন (২১মে) পাকুটিয়া থেকে পাকবাহিনী প্যারীকে তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে গিয়েছিল। ওর কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না। সকাল থেকে অস্থিরতা বোধ করছিলাম। ’প্যারী কি করছে, কোথায় কেমন আছে জানতে পারছি না। ওর স্ত্রীও অসুস্থ অন্য এক বাড়ীতে। শুধু জানতে পারলাম কয়েক জনকে হত্যা করে তাদের লাশ রাস্তায় ফেলে দিয়েছে। আরো ভিষণ খারাপ লাগলো, প্যারীকে না জানি কি ভিষণ অত্যাচার করছে? বেঁচে আছে কিনা তাও জানতে পারছি না। পরে জানতে পারলাম পাক ক্যাম্প থেকে প্যারী পালিয়েছে। শ্র্যীশ্রীঠাকুরের ভক্ত থাকায় শ্রীশ্রীঠাকুরের কথা বলে ভাড়তে পাঠিয়ে দেই। কিন্তু দেশকে ভালবাসার জন্য ১৯৭১ এর আগষ্টেই আবার চলে আসে।

সেই ১৯৭১ সালের ৮ই আগষ্ট পাকুটিয়া সৎসঙ্গ আশ্রমে আলহাজ্ব খোরশেদ আলম তালুকদার (বীরপ্রতিক) নিজ কোম্পানীর জোয়ানসহ অবস্থান করছিলেন। ঐদিন আনুমানিক বিকাল ৩ টায় পাক সেনা বাহিনী টাঙ্গাইল থেকে মধুপুর যাওযার পথে সৎসঙ্গ আশ্রমে আক্রমন চালায়। শুরু হয় পাল্টা আক্রমন। এক পর্যায়ে প্যারী মোহনের পেটে গুলি লেগে পরে গেলে ঘাতকরা বেয়নেট চার্চ করে ও বুট দিয়ে আঘাত করে মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাটির সন্ধান চায়। তবুও মুখ খোলেনি, কোন তথ্য না দেয়ায় অতঃপর বেয়নেটের খোঁচায় নির্মমভাবে শহীদ হয় মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্যারী মোহন আদিত্য।

ছোট ভাইয়ের কথ মনে হলেই মিষ্টি হাসি ভরা মুখটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ওকে তেমন রাগতে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না। সব সময় ওর মূখে একটা আশ্চার্য হাসি লেগেই থাকতো। ছোট ভাই শহীদ হয়েছে জানি, কিন্তু তা মানতে রাজি নই। অনেক সময় মনে হয় আমার ভাই আমাদের ছেড়ে চলে যেতে পারে না। হয়তো ফিরে আসবেই। সমস্ত বাস্তবতা মেনে নিয়েও কেন যেন অপেক্ষায় থাকি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও একটিবার আর্তনাদ করেনি, আক্ষেপ করেনি। প্রাণ ভিক্ষা চায়নি। অত্যাচারি জল্লাদের কাছে একটি বারের জন্য অভিযোগ করেনি কেন এই অত্যাচার, কেন এই মৃত্যু?

কবিতা পড়তে ও আবৃতি করতে ভালবাসতো। বিশেষ করে ঠাকুর অনুকূল চন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথের বানী ও কবিতা। তবে দুঃখের বিষয়, গলার স্বর তেমন গুরু-গম্ভীর ছিল না বলে আবৃতিকার হতে পারেনি। প্যারী মোহন আদিত্যকে যে কোন মানুষ খুবই পছন্দ করত। ছোটদের সঙ্গে তার খাতির ছিল খুব। মজার মজার গল্প বাচ্চাদের বলত। আর সে গল্পের নাম ছিল ভালবাসা ও জীবে প্রেম। শুধু দেশের ঐতিহ্য নয়, শিল্প ও সংস্কৃতি সম্বদ্ধে শ্রদ্ধাবোধ জাগানোর জন্য বিভিন্ন গান-বাজনার আসর ও নাটকের আয়োজনও করতো।

সত্যবাদিতার মূর্ত প্রতিক প্যারী মোহন আদিত্য। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আপোষ করেনি কোন মিথ্যাচরতার সঙ্গে। কর্তব্যপরায়ণ ছিলো চিরদিন। গ্রামের মানুষ সহ আশ্রমের ভক্তদের সাথে যেমন ভালো ব্যবহার করতো, তেমনি শ্রমিকদের সাথেও করেছে আন্তরিক ব্যবহার।

প্যারীর কাছে পাক ক্যাম্পে অত্যাচারের কাহিনী ও মৃত্যুর কাহিনী শোনার পর আমার কি অবস্থা হয়েছিল আজ আমার মনে হলেই বুকটা ফেটে কান্না আসে। কেবল তাঁর অশ্রু সজল চোখ দুটি আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কিছু মনে করার শক্তি তখন আমি হারিয়ে ফেলি।

পাকিস্তানী জল্লাদরা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল এবং প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। যে কোন মুহূর্তে আমাদের মেরে ফেলতে পারে। সহায়সম্বলহীন, আশ্রয়হীন হযে আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আছে তাদের থেকে বিচ্যুত হয়ে একটি নির্জন স্থানে আমাকে আমার চার সন্তান ও অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে থাকতে হয়েছিল। সেই ঘুট ঘুটে অন্ধকারে, চোরা পথে গিয়ে পাহাড়ে একটি বাড়িতে আত্মগোপন করেছিলাম। অমর ও কুজ্ঞ ওরা বিভিন্ন ভাবে বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে ছিল। অথচ কিছুদিন আগে আমার এই ভাইটি ছিল। কিসের ইঙ্গিতে কার ইশারায় এক দমকা হাওয়া সব কিছু ভেঙ্গে চুরমার করে দিল। কেন হলো? এ প্রশ্নের উত্তর আমরা কেউ কোন দিন দিতে পারব?

আমার প্রায়ই মনে হয় ৪ এপ্রিলের আশ্রম আক্রমণ ও প্রতিকৃতিতে গুলি, ২১মে প্যারীকে পাকিস্তানী ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন অবশেষে ৮আগষ্ট গুলি করে এবং বেয়নেট ও বুটের আঘাতের মতো আয়োজন করে হত্যা। নিশ্চয়ই এর পিছনে কোন বিরাট কারণ আছে যা আমার কাছে গোপন রেখে ছিল প্যারী। কিন্তু আমার এ অনুমান সঠিক ছিল। মুক্তিযুদ্ধে যুদ্ধাহতদের শুধু সেবা যতœই করেনি। যোদ্ধাদের খাবার যোগাড়, তথ্য, সেবা আর আশ্রয়ের মতো গুরু দায়িত্ব নিয়েছিলো প্যারী মোহন আদিত্য নিজেই। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিভিন্ন মালামাল ও অস্ত্র আনা নেওয়া সহ সরাসরি সাহায্য করতো এবং লিফলেট প্রকাশ করতো। এ কারণেই প্যারীকে খুঁজতে আলবদর-আলশামস বাহিনী চষে বেড়িয়েছে হত্যা করার জন্য।

প্যারী মোহন আদিত্য বলতো, কল্যাণ বা সেবা ছাড়া কখনো ভালো মানুষ, উন্নততর মনের মানুষ হওয়া যায় না। আর সেবা মানে টাকা পয়সাই একমাত্র বিষয় নয়; আসল হলো আন্তরিক ইচ্ছা। সেবা যে কত ভাবে করা যায়, তার কোন হিসেব নেই। কারো গায়ে কাপড় নেই, তাকে একটা কাপড় দিতে পারেন। ক্লান্ত মানুষকে বসার জায়গা করে একটু বসতে দিতে পারেন। আর যদি মনে করেন কিছুই পারছেন না তবে তার পাশে গিয়ে একটু বসুন, সঙ্গ দিন। কেউ অসুস্থ হলে তাকে দেখতে যান। কেই যদি কোন আসার পথ খুঁজে না পেয়ে বিষণœ হয়, তাকে সান্ত¦না দিন। এভাবে অসংখ্য উপায়ে ভাল ভাল কাজ করা যেতে পারে”। এই ছিল প্যারী মোহন আদিত্যেও ধর্ম।
লেখক: সম্পাদক, সৎসঙ্গ বাংলাদেশ এবং সৎসঙ্গ সংবাদ।

Print Friendly, PDF & Email