April 28, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

হুমকির মুখে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি

দেলোয়ার হোসেন মহিন:পরিবার পরিকল্পনা সেবা বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত একটি কার্যক্রম। এর মাধ্যমে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু নিয়ন্ত্রণের কাজ করা হয়ে থাকে। তবে গত তিন-চার মাস ধরে ঔষধ মজুদ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সরকারের কর্মসূচী। মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে প্রায় প্রতিটি জায়গায় জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর মজুদ শূন্যতা বিরাজ করছে। পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীর মজুদ শূণ্যতার ফলে সরকারের এই খাতের অগ্রগতি হুমকির মুখে। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এই কার্যক্রম কি কারণে হুমকির মুখে তা নিয়ে চলছে নানা গুঞ্জন।
খোজ নিয়ে জানাগেছে, দেশের প্রায় অর্ধেকের বেশি উপজেলায় পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী কনডম, খাবার বড়ি, ইঞ্জেকশনসহ মা ও শিশু স্বাস্থ্য ঔষধ সামগ্রীর মজুদশূন্যতা বিরাজ করছে। ফলে দেশের সাধারণ জনগণের জরুরী এই সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রী সমূহের উপজেলা পর্যায়ে বর্তমান মজুদ পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, ৩৪৯ টি উপজেলা স্টোরে কোন কনডম নেই, ৯৭ টি উপজেলায় খুব দ্রুত মজুদ শূন্য হবে। এবং ২২ উপজেলা স্টোরে সর্বনিম্ন মজুদ রয়েছে। ৩৮ টি উপজেলা স্টোরে কোন খাবার বড়ি (সুখী) নেই, ১০৫ টি উপজেলা স্টোরে খুব দ্রুত মজুদ শূন্য হবে এবং ২০৭ টি উপজেলা স্টোরে সর্বনিম্ন মজুদ রয়েছে। ৬৭ টি উপজেলা স্টোরে কোন খাবার বড়ি (আপন) নেই, ১০২ টি উপজেলা স্টোরে খুব দ্রুত মজুদ শূন্য হবে এবং ৯৯ টি উপজেলা স্টোরে সর্বনিম্ন মজুদ রয়েছে। ২৯৮ টি উপজেলা স্টোরে কোন ইঞ্জেকশন নেই, ১৫৫ টি উপজেলা স্টোরে খুব দ্রুত মজুদ শূন্য হবে এবং ৩৩ টি উপজেলা স্টোরে সর্বনিম্ন মজুদ রয়েছে।
এছাড়া মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার অন্যতম উপকরণ ডিডিএস কিট এর ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, ৪৭৬ টি উপজেলা স্টোরে কোন ডিডিএস কিট নেই, ১৬ টি উপজেলা স্টোরে খুব দ্রুত মজুদ শূন্য হবে এবং ২ টি উপজেলা স্টোরে সর্বনিম্ন মজুদ রয়েছে। স্বাভাবিক প্রসব সেবা নিশিচতকল্পে প্রয়োজনীয় সাধারণ ডেলিভারি কিট ৩৭৫ টি উপজেলা স্টোরে মজুদ শেষ , ১৯ টি উপজেলা স্টোরে খুব দ্রুত মজুদ শূন্য হবে এবং ২৭ টি উপজেলা স্টোরে সর্বনিম্ন মজুদ রয়েছে।
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সরবারহ ব্যবস্থাপনার তথ্যানুযায়ী এ রিপোর্ট লেখার সময় মাত্র ১ মাসের কনডম, ৫.৫ মাসের খাবার বড়ি (সুখী), ৬.৫ মাসের খাবার বড়ি (আপন) এবং ২০ দিনের ইঞ্জেকশন মজুদ আছে। ডিসম্ভর মাস পর্যন্ত মাসিক বিতরণ হার অনুযায়ী প্রতিমাসে ৬৮,৪৮, ১৩২ পিস কনডম, ৬১,১২,৫৮৯ সাইকেল খাবার বড়ি (সুখী), ৩,৪৯,৫০৩ সাইকেল খাবার বড়ি (আপন), ৯,৬৭,১৬১ ভায়াল ইঞ্জেকশন, ৪৪৫ টি সাধারণ ডেলিভারি কিটের চাহিদা রয়েছে। ফেব্রুয়ারী মাস থেকে কনডম এবং ইঞ্জেকশন এর মজুদ শূন্য হবে। এসকল সেবাগ্রহীতা কিভাবে এ সেবা পাবে সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ।
বর্তমান এই সংকটের দ্রুতই যে কোন সমাধান রয়েছে তা নয়। মজুদশূন্যতার বিষয়ে জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী সমূহের চাহিদা প্রেরণকারী পরিচালক (অর্থ) ও লাইন ডাইরেক্টর (এফপি-এফএসডি) সোহেল পারভেজ কে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, গত বছর মে মাসের ২৪ তারিখ তিনি এ পদে যোগদান করেন। যোগদানের পর এ পর্যন্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রী ক্রয়ের বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন কিন্তু সফল হতে পারেননি। এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্রয় করার জন্য। কিন্তু সরকারে বিধি অনুযায়ী এই ক্রয় সম্পন্ন করে মালামাল পেতে ৩-৪ মাস সময় লাগতে পারে। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী এই সংকট আরো দীর্ঘ হওয়ার আশংকা রয়েছে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপকরণ ও সরবরাহ বিভাগের পরিচালক মার্জিয়া হক বলেন, নারী ও শিশু স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট ঔষধ বর্তমান সময়ে কিছুটা মজুদ কম রয়েছে। বিশেষ করে কনডম-পিল সরবরাহ শেষ পর্যায়ে। তবে চেষ্টা করা হচ্ছে মজুদ বাড়ানোর জন্য। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে এ সংকট কাটানো সম্ভব হবে।
এবিষয়ে জানতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক সাহান আরা বানু কে ফোন দিলে সাংবাদিক পরিচয় যেনে ফোন কেটে দেন।
১৯৫৩ সাল থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, মা ও শিশু স্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যুর মত বিষয় গুলোর উপর গুরুত্ব আরোপের মধ্য দিয়ে এ দেশে পরিবার পরিকল্পনা সেবার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বারোপ করেন। তখন থেকেই যাত্রা হয় বহুমুখী ও দেশব্যাপী জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম। পরিবার পরিকল্পনা সেবা বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারভুক্ত একটি কার্যক্রম। এ প্রোগ্রামের মাধ্যমে সরকারের সফলতাও কম নয়। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং মা ও শিশু স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে গত ১৫ বছরে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের সফলতা চোখে পড়ার মতো।
জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু কমানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। স্বাধীনতার পর এদেশে জন্মহার ছিলো ৬.৩ যা বর্তমানে ২.৩ এর নিচে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের আওতাধীন পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর বিভিন্ন ক্যাটাগরির কর্মী দ্বারা মানুষের বাড়িতে, স্যাটালাইট ক্লিনিকে, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা সেবা, মা ও শিশু স্বাস্থ্য সম্পর্কিত ঔষধ সামগ্রী সরবরাহ এবং নরমাল/সিজারয়িান ডেলিভারী সেবা দিয়ে থাকে। জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ক্ষেত্রে কনডম, খাবার বড়ি (সুখী), খাবার বড়ি (আপন), ইঞ্জেকশন, আইউডি, ইমপ্লান্ট ও স্থায়ী পদ্ধতি (পুরুষ ও মহিলা) ইত্যাদি সেবা দিয়ে থাকে।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষের সামগ্রিক বক্তব্য হলো, স্বাধীনতার পর থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে অনেক অগ্রগতি হয়েছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের হারও বেড়েছে, প্রজনন হার কমেছে, মাতৃমৃত্যু হার প্রায় ৪০ শতাংশ কমে প্রতি হাজারে ১৬৯ এ নেমে এসেছে: ২০৩০ সাল নাগাদ এ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭০ জনে। এছাড়া শিশুমৃত্যু হারও উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। আর এই সাফল্যে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো এমডিজি অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। পরিবার পরিকল্পনা সামগ্রীর মজুদ শূণ্যতার ফলে সেই অগ্রগতি ধরে রাখায় বড় চ্যালেঞ্জ।

Print Friendly, PDF & Email