May 16, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

রথযাত্রা সম্প্রীতির মিলনমেলা

শ্রী চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী: বছর ঘুরে আবার শান্তি ও সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে এলো শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের রথযাত্রা। রথযাত্রা মহোৎসব ২০২৩ উপলক্ষে সবাইকে জানাই আন্তরিক কৃষ্ণপ্রীতি ও শুভেচ্ছা।

রথযাত্রা এখন আর কেবল ধর্মীয় উৎসব নয় সামাজিক জীবন ও সংস্কৃতির অঙ্গ। সাধারণত ভক্ত আরাধনার জন্য ভগবানের মন্দিরে যায়। কিন্তু রথযাত্রা তার ব্যতিক্রম। এখানে ভগবান স্বয়ং ভক্তের প্রতি তাঁর সৃষ্ট জীবের প্রতি কৃপাপরবশ হয়ে মন্দির থেকে রাজপথে বেরিয়ে আসেন। ভগবান জগন্নাথদেবের কাছে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, ধনী, দরিদ্রে কোনো ভেদাভেদ নেই। তাই এ উৎসব ভক্ত ও ভগবানের মহামিলন উৎসব।

রথযাত্রা কী ?
সনাতন ধর্মীয় উৎসবসমূহের মধ্যে অন্যতম শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের রথযাত্রা। ভারতে বঙ্গোপসাগরের পূর্ব উপকূলে ঊড়িষ্যা (বর্তমান ওড়িশা) নামক রাজ্যে অবস্থিত পুরীর জগন্নাথ মন্দির। সেই শ্রীমন্দির থেকে গু-িচা মন্দিরে রথে চড়ে ভগবান শ্রীজগন্নাথ দেবের যাত্রাই রথযাত্রা নামে অভিহিত। এ যাত্রার প্রধান তিন বিগ্রহ- জগন্নাথ (কৃষ্ণ), বলদেব (বলরাম) ও সুভদ্রা (শ্রীকৃষ্ণের ভগিণী ও যোগমায়া শক্তি) সাধারণত তিনটি রথে এ তিন বিগ্রহ স্থাপন করা হয়। প্রতি বছর আষাঢ়ের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এর সাতদিন পর জগন্নাথদেব যখন গু-িচা মন্দির থেকে আবার তাঁর শ্রীমন্দিরে ফিরে আসেন, তাকে বলা হয় উল্টো রথযাত্রা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সম্প্রীতির অনন্য নিদর্শন এই রথযাত্রা মহোৎসব।

কখন রথযাত্রার সূচনা হয় ?
রথযাত্রার ইতিহাস অতি প্রাচীন। তাই কবে থেকে এর সূচনা হয় তা বলা দুঃষ্কর। তবে ত্রয়োদশ শতাব্দীতেও রথযাত্রা উদ্যাপিত হতো এমন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া ‘রথ চকদ’ নামক প্রচীন গ্রন্থ অনুসারে ৮ম শতাব্দীতে রাজা যযাতি কেশরী কর্তৃক রথযাত্রা উদযাপনের ইতিহাস পাওয়া যায়। স্কন্দ পুরাণ অনুসারে, সত্যযুগে মহারাজ ইন্দ্রদ্যুম্ন কর্তৃক জগন্নাথদেবের শ্রীবিগ্রহ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে রথযাত্রা উৎসব উদ্যাপিত হয়ে আসছে।

রথযাত্রা কেন অনুষ্ঠিত হয় ?
ভক্তের বিরহে ভগবানের করণাঘন রূপই জগন্নাথ রূপ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় থাকাকালীন বৃন্দাবনবাসী ভক্তরা তাঁর জন্য তীব্র বিরহ অনুভব করছিলেন এবং তিনিও সেই ভক্তদের বিরহে অত্যন্ত ব্যাকুল ছিলেন। ভক্তবিরহ-কাতর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ একদিন তাঁর ভ্রাতা বলরাম ও ভগিনী সুভদ্রাসহ কিছুকালের জন্য দ্বারকা থেকে রথে চড়ে বৃন্দাবন যাত্রা করেছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ সেই মনোভাব নিয়ে রথযাত্রা পালন করেন।

ভগবানের শ্রীবিগ্রহ দর্শনের মাধ্যমে আমরা তাঁর করণাদৃষ্টি লাভ করি। তাই সাধারণত ভক্ত ভগবানকে দর্শন করার জন্য মন্দিরে যান। কিন্তু যারা কখনো মন্দিরে যাওয়ার সুযোগ পান না, রথযাত্রায় ভগবান জগন্নাথদেব স্বয়ং মন্দির থেকে রাজপথে বেরিয়ে আসেন তাদের দর্শন দানের জন্য। তিনি তাঁর দুই বাহু সামনে প্রসারিত করে সবাইকে তার কৃপা লাভের জন্য আহ্বান করেন এবং করণাসিক্ত অপলক নেত্রে তিনি সকলের প্রতি তাঁর করণদৃষ্টি দান করেন। তাই সম্প্রীতির পাশাপাশি রথযাত্রা ভগবানের করুণা লাভের উৎসব।

রথযাত্রার সামাজিক দৃষ্টিকোণ ?
জগন্নাথদেবের রথযাত্রা মহোৎসবের উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর সামাজিক মেলবন্ধন। ‘জগন্নাথ’ শব্দের অর্থ- জগতের নাথ তথা সকলের পরম প্রভু। জগন্নাথ সকলের নাথ, তাঁর কাছে ব্রাহ্মণ-শূদ্র, ধনী-দরিদ্র, সাদা-কালো প্রভৃতি মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই। সেজন্য জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষ এ রথযাত্রায় অংশগ্রহণ করতে পারে। এভাবে সকলের মধ্যে সৌহার্দ্য, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ববোধ তথা সামাজিক মেলবন্ধন গড়ে ওঠে। গড়ে ওঠে হিংসা-বিভেদহীন এক সুশৃঙ্খল সমাজ। তাই রথযাত্রা হলো ধর্মীয় ও সমাজিক সম্প্রীতির মিলনমেলা।

বিশ্বমঞ্চে রথযাত্রা ?
জীবের প্রতি ভগবানের এই করুণা জগৎজুড়ে বিতরণ করার লক্ষ্যে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব তাঁর অন্যতম শুদ্ধভক্ত কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদকে এ পৃথিবীতে প্রেরণ করেছিলেন। এখন আর রথযাত্রা উৎসবের সীমা ও মহিমা শুধু জগন্নাথ পুরী ধামে আবদ্ধ নয়। শ্রীল প্রভুপাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত সংস্থা আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন)-এর মাধ্যমে আজ তা ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে।

১৯৬৭ সালে শ্রীল প্রভুপাদ আমেরিকার সান-ফ্রান্সিসকো শহরে জগন্নাথদেবের রথযাত্রার শুভ সূচনা করেছিলেন। তিনি পাশ্চাত্যে যে রথযাত্রা উৎসবের প্রবর্তন করেছিলেন, তার ধারা আজও অব্যাহত। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের কোনো না কোনো নগরে ও গ্রামে এখন প্রতি বছর রথযাত্রা মহোৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, প্রতি বছরই কোনো না কোনো নতুন স্থানে শ্রীশ্রীজগন্নাথ, বলদেব ও সুভদ্রাদেবীর রথযাত্রা অনুষ্ঠিত হচ্ছে এবং ক্রমশ এ উৎসবের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশেও এখন প্রতিটি জেলায় রথযাত্রা উদ্যাপিত হচ্ছে। বর্তমানে ইস্কন আয়োজিত, ঢাকায় অনুষ্ঠিত রথযাত্রা পৃথিবীর অন্যতম রথযাত্রা, যেখানে প্রায় লক্ষাধিক ভক্তের সমাগম হয়।

জগন্নাথদেবের প্রকাশ কীভাবে হল ?
স্কন্দ পুরাণে বর্ণিত রয়েছে যে, ভারতের অবন্তীনগরে ইন্দ্রদ্যুম্ন নামে এক বিষ্ণুভক্ত রাজা ছিলেন। ভগবানকে দর্শনের জন্য তাঁর ছিল প্রবল উৎকণ্ঠা। একদিন এক তৈর্থিক ব্রাহ্মণ এসে তাঁকে বললেন যে, উড়িষ্যার নীলগিরি পর্বতে ভগবান নীলমাধব রূপে অবস্থান করছেন। তা শুনে রাজা তৎক্ষণাৎ রাজপুরোহিতের ভ্রাতা বিদ্যাপতিকে সেখানে পাঠালেন নীলমাধবের সন্ধানে। বহু পথ অতিক্রম করে বিদ্যাপতি নীলগিরিতে পৌঁছান এবং সেখানকার শবররাজ বিশ্বাবসুর সহায়তায় তিনি নীলমাধবের শ্রীবিগ্রহ দর্শন করেন। বিদ্যাপতি অবন্তীনগর ফিরে গিয়ে রাজাকে নীলমাধবের সংবাদ জানান।

রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তাঁর লোকজন নিয়ে বিদ্যাপতি সহ নীলাদ্রিতে পৌঁছান, কিন্তু ততদিনে নীলমাধব অন্তর্হিত হয়ে যান। ভগবানের দর্শন না পেয়ে রাজা অত্যন্ত দুঃখভারাক্রান্ত মন নিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসেন। ভগবান রাজাকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বললেন যে, “ইন্দ্রদ্যুম্ন”, তুমি নীলমাধবরূপে আমার দর্শন পাবে না। সমুদ্রপথে শীঘ্রই তিনটি কাষ্ঠখ- ভেসে আসবে, তা দিয়ে তুমি আমার শ্রীবিগ্রহ নির্মাণ করবে এবং পুরুষোত্তম ক্ষেত্রে (পুরীধামে) এক সুবৃহৎ মন্দিরও নির্মাণ করবে। সেখানে দারূব্রহ্ম জগন্নাথরূপে আমি তোমার সেবা গ্রহণ করবো।”

কিছুকালের মধ্যে সমুদ্রে ভেসে আসে সেই দারুব্রহ্ম। রাজার নির্দেশে তা তুলে আনা হয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সেই কাঠ কেউই খোদাই করতে পারছিল না। রাজা ভীষণ চিন্তিত। তখন ভগবান স্বয়ং ‘অনন্ত মহারাণা’ নামে আত্মপরিচয় প্রদানপূর্বক এক বৃদ্ধ শিল্পীর ছদ্মবেশে এসে ২১ দিনের মধ্যে বিগ্রহ নির্মাণ করবেন বলে রাজাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন। তাতে শর্ত ছিল যে, এ ২১ দিনের মধ্যে নির্মাণগৃহের দ্বার বন্ধ থাকবে। বিগ্রহের নির্মাণ কাজ আরম্ভ হলো।

দু’সপ্তাহ অতিবাহিত হওয়ার পর সেই গৃহ থেকে বিগ্রহ নির্মাণের যন্ত্রপাতির কোনো শব্দ শুনতে না পেয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন খুব উৎকণ্ঠিত হলেন। মন্ত্রীগণের বারবার নিষেধ সত্ত্বেও মহারাণী গু-িচার পরামর্শে ২১ দিন অতিবাহিত হওয়ার পূর্বেই রাজা দ্বার উন্মোচন করলেন। কিন্তু সেখানে তিনি সেই বৃদ্ধ শিল্পীকে দেখতে পেলেন না, দেখলেন দারুব্রহ্ম তিনটি শ্রীমূর্তি রূপে প্রকাশিত হয়েছেন।

বিগ্রহের হাতের আঙ্গুলি ও শ্রীপাদপদ্ম প্রকাশিত হয়নি দেখে, রাজা নিজেকে অপরাধী ভেবে প্রাণত্যাগের সংকল্প নিয়ে কুশশয্যায় শয়ন করলেন। মধ্যরাতে জগন্নাথদেব রাজাকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বললেন, “ইন্দ্রদ্যুম্ন, তুমি ভেবো না আমার এই রূপ অসম্পূর্ণ। আমার দেহ অপ্রাকৃত। তাই আমি প্রাকৃত হস্তপদাদিরহিত হয়েও অপ্রাকৃত হস্তপদাদির দ্বারা আমার ভক্তের প্রদত্ত সেবা-উপকরণ গ্রহণ করি এবং জগতের মঙ্গলের জন্য সর্বত্র বিচরণ করি, বেদের এই কথা সত্য প্রমাণ করার জন্য আমি তোমাকে নিমিত্ত করে এই রূপে প্রকটিত হয়েছি। প্রেমাঞ্জনযুক্ত ভক্তিনেত্রে আমার ভক্ত আমাকে শ্যামসুন্দর মুরলীবদন কৃষ্ণ রূপেই দর্শন করে।”

রাজা জগন্নাথদেবের কথা শ্রবণ করে কৃতার্থ হলেন এবং প্রার্থনা জানালেন যে, সেই বৃদ্ধ শিল্পীর বংশধরগণ যেন যুগযুগ ধরে জগন্নাথের তিনটি রথ নির্মাণ কার্যে ব্যপৃত থাকেন। জগন্নাথদেব ঈষৎ হেসে বললেন, “তা-ই হবে”। সত্যযুগে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেব এভাবে প্রকাশিত হয়েছিলেন।

প্রেমপুরুষোত্তম পরমেশ্বর ভগবান শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রচারিত কৃষ্ণভাবনামৃত তথা সাম্যবাদ ও প্রেমধর্মের জয় রথ অপ্রতিরোধ্যভাবে বিশ্বজুড়ে অগ্রসর হচ্ছে এ রথযাত্রার মাধ্যমে। তাই রথযাত্রার পুণ্যলগ্নে ভগবান শ্রীজগন্নাথদেবের প্রতি আমরা আমাদের ঐকান্তিক শ্রদ্ধা ও প্রণতি নিবেদন করি এবং সেই সাথে সবাইকে এ উৎসবে যোগদান করে জগন্নাথদেবের করুণা লাভ করার জন্য আমন্ত্রণ জানাই।

লেখক: সাধারণ সম্পাদক, ইস্কন বাংলাদেশ

Print Friendly, PDF & Email