May 14, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

ঋত্বিক ঘটক: বাঙালির ভবঘুরে ব্যথিত সিনেমাওয়ালা

আলী আসগর স্বপনঃ  “মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।/এইভাবে, পৃথিবীর ইতিহাস বারবার/বদলে গেছে,/তবুও মানুষ, সবসময় বেঁচেছে।/মানুষ, তোমাকে ভালবাসি।”
‘আমাদের ফেলো না’ কবিতায় এমনি করেই ঋত্বিক ঘটক বলেছেন জীবনবোধের কথা। বুকের মধ্যে মানুষের প্রতি ভালোবাসার কষ্ট আর দায়িত্ব নিয়ে আজীবন ধুঁকেছেন তিনি। বাংলা চলচ্চিত্রের জগতে উল্কার মতো এসে প্রলয় ঘটিয়ে গেছেন তিনি। ৫০ বছরের জীবনে সিনেমা বানিয়েছেন ৮ টি। কিন্তু এই সংখ্যাটা দিয়ে তার শিল্পী জীবনকে যাচাই করতে গেলে ভুল হবে।
তিনি সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন তার চলচ্চিত্রকে। তাকে বলতে শুনি আমরা- ‘ছবি লোকে দেখে। ছবি দেখানোর সুযোগ যতদিন খোলা থাকবে, ততদিন মানুষকে দেখাতে আর নিজের পেটের ভাতের জন্য ছবি করে যাব। প্রতিবাদ করা শিল্পীর প্রথম এবং প্রধান দায়িত্ব। শিল্প ফাজলামি নয়। যারা প্রতিবাদ করছে না তারা অন্যায় করছে। শিল্প দায়িত্ব। আমার অধিকার নেই সে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার। শিল্পী সমাজের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। সে সমাজের দাস। এই দাসত্ব স্বীকার করে তবে সে ছবি করবে।’
চলচ্চিত্রের ইতিহাসে ঋত্বিকই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের চিত্রনাট্য,পরিচালনা ও প্রযোজনায় নির্মিত ছবিতে নিজেরই চরিত্রে অভিনয় করেছেন।
১৯৭৪ সালে মুক্তি পায় ঋত্বিকের শেষ ছবি ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এই সিনেমাটি ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র। মূল চরিত্র একজন মাতাল বুদ্ধিজীবী নীলকণ্ঠ বাগচী,যে তার বন্ধুদের মত সস্তা জনপ্রিয়তার লোভে নিজেকে বিক্রি করে দেয়নি। নীলকণ্ঠ চরিত্রে অভিনয় করেন ঋত্বিক স্বয়ং। সিনেমাটি ঋত্বিকের আত্মজীবনীমূলক হলেও এটা ১৯৪৭ এর দেশভাগ,রাজনৈতিক পরিস্থিতি,১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ আর নকশালবাড়ি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সময়ের একটি নির্মোহ-নির্মম সমালোচনাও বটে। সুশীল লেখক সত্যজিৎ বসু যখন তাকে বলছেন বাংলাদেশ নিয়ে তার ভাবনার কথা,নীলকণ্ঠ বাগচীর কণ্ঠে তখন চরম উপহাস,”ভাবো,ভাবো,ভাবা প্র্যাক্টিস করো।”
“ঋত্বিক মনেপ্রাণে বাঙালি পরিচালক ছিল, বাঙালি শিল্পী ছিল– আমার থেকেও অনেক বেশি বাঙালি। আমার কাছে সেইটেই তার সবচেয়ে বড়ো পরিচয় এবং সেইটেই তার সবচেয়ে মূল্যবান এবং লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য।“ – সত্যজিৎ রায়
ঋত্বিক কতটা তীব্রভাবে বাঙালি ছিলেন, ঋত্বিক কতখানি নিবিড়ভাবে বাংলার মানুষের ছিলেন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ সত্যজিৎ রায়ের এই অকপট সাক্ষ্য।
বহু প্রেম আর বহু জন্মের নির্বাক সাক্ষী পুরান ঢাকার ঋষিকেশ দাস লেনে জন্ম হয় যমজ ভাই-বোন, ঋত্বিক-প্রতীতির। তাঁদের ডাকনাম ছিল ভবা আর ভবী। ঋত্বিকের পুরো নাম ঋত্বিক কুমার ঘটক।
ছোটবেলা থেকেই ঋত্বিক অন্য ধাঁচের মানুষ ছিলেন। আর দশজন লোকের মতো তো ছিলেনই না, আর দশজন বিখ্যাত লোকের মতোও তিনি ছিলেন না। ছেলেবেলা থেকে আমৃত্যু জীবনকে তিনি নিজের মতো করে গড়েছেন, ভেঙেছেন, তারপর আবার নতুন করে গড়েছেন। ঋত্বিক রাজনীতি করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। গণনাট্যের কর্মী ছিলেন। নাটক লিখেছেন, অভিনয় করেছেন। ঋত্বিক সাহিত্যিক ছিলেন– গল্প লিখেছেন, ছাত্রাবস্থায় ‘অভিধারা’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে ভাইস-প্রিন্সিপালও হন। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সিনেমাওয়ালা, বাংলা এবং বাঙালির সিনেমাওয়ালা।
১৯৪৮ সালে। কলকাতার হাজরা রোডের উপর আট বাই বারো ফিটের মতো একটা চায়ের দোকান – নাম প্যারাডাইস ক্যাফে। প্যারাডাইসের নোংরা চেয়ার-টেবিলে বসে আড্ডা দিতেন একদল তরুণ। এঁদের কয়েকজনের নাম মৃণাল সেন, তাপস সেন, সলীল চৌধুরী আর ঋত্বিক ঘটক। কখনো কখনো আসতেন বিজন ভট্টাচার্য। এইখানেই আড্ডা হতো, তর্ক হতো। মধ্যমণি ঋত্বিক। ঋত্বিকের রাজনীতি আর সিনেমার সূতিকাগার নোংরা চেয়ার-টেবিলে ঠাসা প্যারাডাইস ক্যাফে। এই তরুণদের মধ্যে সবচেয়ে বেপরোয়া ছিলেন ঋত্বিক।
চলচ্চিত্রে আসার কথা ছিল না। তাঁর স্বপ্নের সমস্তটা জুড়ে ছিল নাটক। ঋত্বিক সিনেমাতে এসেছেন, কারণ সিনেমা একসাথে বহু মানুষের কাছে পৌঁছানোর সুযোগ করে দেয়। মেজদা সুধীশ ছিলেন সিনেমার লোক। দাদার বহু সিনেমার সাথে সরাসরিভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। দাদা সুধীশ ঘটকের সূত্রেই সিনেমার বহু লোকের সঙ্গে পরিচিতও হলেন। নিমাই ঘোষের ‘ছিন্নমূল’ সিনেমার কাজ করতে গিয়ে তাঁর পরিচয় হয় সত্যজিৎ রায়ের সাথে। বেশ কিছু সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করার পর অবশেষে নিজের সিনেমার ঝুলি খুললেন ঋত্বিক ঘটক।
‘নাগরিক’ তাঁর প্রথম সিনেমা হলেও প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমা নয়। ‘নাগরিক’ বিশ্বযুদ্ধোত্তর বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনের টানাপোড়নের গল্প। যে গল্প, যে জীবনবোধ, যে তিক্ততা ঋত্বিক দেখেছেন, কোনো ভণিতা না করেই তা বলে গেছেন নাগরিকে। পুরো সিনেমার কাজ শেষ করেও পরে অর্থাভাবে সিনেমাটি আর মুক্তি পায় না (১৯৫২ সালে)। সাতাশ বছরের ঋত্বিকের প্রথম সিনেমা ‘নাগরিক’ মুক্তি পায় তাঁর মৃত্যুর পরে, ১৯৭৭ সালে।
১৯৫৫ সালে আদিবাসীদের জীবনযাত্রা নিয়ে ডকুমেন্টারি ছবি করলেন ‘ওঁরাও’।
১৯৫৮ সালে প্রথম সিনেমা ‘অযান্ত্রিক’ মুক্তি পায়। এর জন্য প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন ঋত্বিক। কেবল ছয় থেকে সাতবার স্ক্রিপ্টই বদলেছেন। তাঁর এত এত পরিশ্রম বৃথা যায়নি। বাংলা সিনেমার জগতে এটি এখনো এক অনবদ্য সিনেমা।
সূত্রঃ অনলাইন।
Print Friendly, PDF & Email