April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর সংগঠন গোছাতে শুরু করি: শেখ হাসিনা

ডেস্ক : জাতীর পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। দেশ স্বাধীনের পর শূন্য হাতে যাত্রা শুরু করেন। গোলাঘরে খাবারের চাল নেই, ব্যাংকে টাকা নেই, বৈদেশিক মুদ্রা নেই, রাস্তা-ঘাট-পুল-কালভার্ট সব ধ্বংসপ্রাপ্ত ও যোগাযোগ ব্যবস্থাও ধ্বংসপ্রাপ্ত। ধ্বংসপ্রাপ্ত দেশে খুব তাড়াতাড়ি তিনি যোগাযোগ ব্যবস্থা বিশেষ করে ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেগুলো শত্রুবাহিনী ধ্বংস করেছিল সেগুলো পুনঃস্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণের সময় বাংলাদেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত এক জনপদ। বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে বঙ্গবন্ধু সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। বঙ্গবন্ধুর একক প্রচেষ্টায় ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৭২-এর ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। দেশের সর্ববৃহৎ এই রাজনৈতিক দলটি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই বাঙালীর রাজনৈতিক ইতিহাসকে দিয়েছে সমৃদ্ধির গতি। তবে গতিময় এই চলার পথে কখনো কখনো থামতেও হয়েছে তাদের। ষড়যন্ত্রের শিকার হওয়ায় তৈরি হয়েছে ক্ষত। রবিবার গণভবনে তৃণমূলের নেতাদের সেই ক্ষতের গল্পই শুনিয়েছেন দলটির বর্তমান সভাপতি শেখ হাসিনা তৃণমূলের নেতাদেরকে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৮২ সালে আওয়ামী লীগ ভাঙায় আমাদের বড় ক্ষতি হয়েছিল।

তিনি বলেন, ‘১৯৮২ সালে আব্দুর রাজ্জাক সাহেব পার্টি ভেঙ্গে চলে গেল, এই যে মতিয়া চৌধুরী আপা এখানে আছেন, তিনি রাজ্জাক সাহেবের পা ধরে বসে ছিলেন যে আপনি পার্টিটা ভেঙে যাইয়েন না। জলিল ভাই (প্রয়াত সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিল) গিয়ে পা ধরে ছিলেন, পার্টিটা ভেঙে যাইয়েন না। আমি নিজে বলেছিলাম, আপনি পার্টি ভেঙে যাচ্ছেন কেন, রাজনীতি তো আপনার সঙ্গে করে আসছি। আপনি ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন, আমি ইন্টারমিডিয়েটে কলেজের ভিপি হলাম। আপনি পার্টি ভাঙবেন কেন? উনি তখন বাকশাল করবেন বলে পার্টি ভাঙলেন।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৭৫-এর ঘটনার পরে আবার আওয়ামী লীগের ওপর যে আঘাত আসে- তখন এটাই ধারণা করেছিল যে আওয়ামী লীগ আর কখনো ক্ষমতায় যেতে পারবে না। এটাই ছিল সকলের পরিকল্পনা।’

অতীতের স্মৃতিচারণা করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর আমি সংগঠন গোছাতে শুরু করি। আপনাদের মনে আছে এই সংগঠন গোছাতে কম কষ্ট করতে হয়নি। সবচেয়ে দুঃখজনক হলো আমি ৮১ সালে আসলাম ৮২ সালে পার্টি ভাঙলো। এই ভাঙাটা আমাদের জন্য খুব ক্ষতি ছিল। আমার দুঃখ লাগে যে যাদের ওপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করেছি, দেশের বাইরে থাকতে যারা আমার সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ করেছেন যে তাদের সঙ্গে কাজ করবো তারাই আমাকে হতাশ করেছে।

তিনি বলেন, ‘১৯৭৯ সালে মুক্তি পাওয়ার পর ৮০ সালে লন্ডনে আমার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এর আগে ১৯৭৯ সালে আমার সঙ্গে যখন তাদের যোগাযোগ হত তখন সব সময় যার কথা বলে দিতাম, তিনি যাতে দলটা চালাতে পারেন তার কিছু ব্যবস্থাও আমি করে দিয়েছিলাম। যাদের জন্য করে দিয়েছি আমি ফিরে আসার পর তারাই আমার সঙ্গে বিট্রে করে চলে গিয়েছে। এটা হচ্ছে আমাদের দুঃভাগ্য।’

বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘তখন আওয়ামী লীগের নেতারা জিজ্ঞেস করতেন, আমরা কাকে নিয়ে কাজ করবো? এত গ্রুপিংয়ের মধ্যে কোথায় যাবো? ৮২ সালে পার্টিটা ভেঙে চলে গেলেন। ঐ ভাঙনটা যদি না হতো তাহলে হয়তো আওয়ামী লীগ ৮০ দশকে সরকার গঠন করতে পারত, নির্বাচন করে জয়ী হতে পারত। তখন আর এরশাদ ওভাবে মার্শাল’ল দিয়ে গেঁড়ে বসতে পারত না।’

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এরশাদের বিরুদ্ধে আমরা যখন আন্দোলন করি তখনও একটা ষড়যন্ত্র ছিল। এক জেনারেলের পরিবর্তে আরেক জেনারেল। আমি সেটা মানিনি। আমি বলেছি, এক জেনারেলের পরিবর্তে আরেক জেনারেল না, আমরা গণতন্ত্র চাই। আমরা নির্বাচন চাই, গণতন্ত্র চাই। এর জন্য অনেক সমালোচনা সম্মুখিন আমাকে হতে হয়েছে। অনেকে অনেক কথা বলেছে, অনেক ষড়যন্ত্র করেছে। কিন্তু আমি আমার বাবার কাছ থেকে শিখেছি, যেটা নীতি হিসেবে জানবো, সেটা মেনে নিবো। সেখানে কে কি বললো সেটা বড় কথা না। সবশেষে দেখা গেছে যে যেটা আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সেটা ঠিক ছিল।’

তিনি বলেন, ‘দলের ভেতরে বাইরে সমালোচনা অনেক কিছু ছিল। ভাঙন হলো। কারণ আমি তখন কেবল আসছি। কেবল আসার পর যখন এ রকম একটা ধাক্কা খেলাম, তারপর সারা বাংলাদেশ আমাকে ঘুরতে হয়েছে, সংগঠন তৈরি করতে হয়েছে। দিনের পর দিন মিটিং, রাতের পর রাত সবার সঙ্গে বসে আলোচনা করে করে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সংগঠনগুলোকে নতুন ভাবে তৃণমূল থেকে গড়ে তুলতে হয়েছে। ওভাবে সংগঠন করে করে আজকের আওয়ামী লীগ একটা পর্যাায়ে এসে পৌঁছেছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘সেসময় আমাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ছিল আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে দেশ বেচে দিবে, মসজিদে আজান হবে না, উলুধ্বনি হবে। এ রকম নানা অপপ্রচার করা হত। সেগুলো আমাদের মোকাবেলা করতে হয়েছে, জবাব দিতে হয়েছে।’

আব্দুর রাজ্জাকের ফিরে আসা প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ‘১৯৯১ সালে উনি আসলেন জোটের সঙ্গে নির্বাচন করতে। তাকে দুটি সিট দিতে হবে। মাদারীপুর ও শরিয়তপুরে দুইটা সিট নিল আর সব জায়গায় কাঁচি মার্কায় একজন করে প্রার্থী দাঁড় করিয়ে দিল। মানে ঐ কাঁচি মার্কা দিয়ে আওয়ামী লীগকে কাঁচি কাটা করা। ২ বা ৪ হাজার করে ভোট কেটে নিল।’

স্বৈরাচার পরবর্তী সময়ে প্রথম জাতীয় নির্বাচনের স্মৃতিচারণা করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচনে জেতা কিন্তু আলাদা বিষয়। অনেকে অনেক বড় নেতা হতে পারেন কিন্তু জনগণের ভোটে নির্বাচিত হওয়াটা কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। কে মানুষের কাছে বেশি যেতে পেরেছেন, কে মানুষের সবচেয়ে বেশি আস্থা অর্জন করতে পেরেছেন, কে ভোট আনতে পারবেন এটা কিন্তু অংকের মতো হিসেবের ব্যাপার। ইলেকশন করাটা কিন্তু একদম অংকের মতো হিসেব।’

তিনি বলেন, ‘সে সময়ের বৈরি পরিবেশে জনগণের সমর্থন ছিল আমাদের একমাত্র শক্তি। জোটের মধে যদি বেঈমানি না হতো, মনোনয়নগুলো যদি দিতে পারতাম তাহলে আমরা জয়ী হয়ে আসতে পারতাম। ভোট চলে গেল জোটে। তার মধে ৩৫টি সিট জোটকে দিয়ে দেওয়া হল। যাদের কোন ভোটই নাই। নইলে আওয়ামী লীগের ভোট কখনো জামানাত বাজেয়াপ্ত হয় না। সেটাও হলো। এভাবে একটা হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হল। আপনারা জানেন একানব্বই সালের নির্বাচনের পর আমি পদত্যাগ করলাম। আমার যদি স্বাধীনতা না থাকে, মনোনয়ন দিয়ে যদি জিততেই না পারি। তাহলে পদে থেকে লাভটা কি?’

কবি সুফিয়া কামাল তাকে চিঠি লিখেছিলেন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি পদত্যাগ করার পর নেতাকর্মীরা সবাই আমাকে চিঠি লিখল, কবি সুফিয়া কামাল আমাকে চিঠি লিখলেন, যে তোমার পদ ছাড়া ঠিক হবে না। পার্টির সবাইও উঠে পড়ে লাগলো তাই আমি আবার দায়িত্ব নিলাম।’

তিনি বলেন, ‘তারপর থেকে চেষ্টা করলাম যে এবার নিজেদের মতো করে নির্বাচন করব। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করব। এত বাধার পরেও আমরা আসতে পারলাম। ২০০১ সালে আসতে পারলাম না। তখন গ্যাস বিক্রির জন্য আমার ওপর প্রচণ্ড চাপ, আমি বললাম যে দেশের স্বার্থ আমি বিক্রি করব না। এটা আওয়ামী লীগের নীতি নয়।’

২০০১ সালে হারার পর কোন কোন কেন্দ্রে আমরা হেরেছি তার একটা হিসেব করে আমাদের প্রতিটি প্রার্থীর সঙ্গে বসেছি। দিনের পর দিন আলোচনা করেছি। ইউনিয়ন নেতাদের নিয়ে এসে দশটা প্রশ্ন দিয়ে, কোয়েশন পেপার নিয়ে সায়েন্টিফিকালি প্রস্তুতি নিয়েছি। যার ফলটা পেয়েছি ২০০৮ সালে। কাজেই হঠাৎ আমার সঙ্গে অনেক লোক ঘুরে বেড়ায়, আর ভাল ভাল স্লোগান দেয়, আমি বড় নেতা, আমি জিতে যাবো নির্বাচন কিন্তু আসলে তা নয়। এটা আমি সব নেতাদের বলি। মনোনয়ন না পেলে মন খারাপ করেন, ঘটনা সেটা না। অংকের মতো হিসেব করে বের করা যায় নির্বাচনে কার পজিশন কি? আমরা এখন সেটাই করি। এবারের নির্বাচনেও আমরা তাই করেছি।’

তিনি বলেন, ‘অনেকে একবার এমপি হয়ে গেলে পরেরবার জিতে না। কেন জিতে না? কারণ সে জনগণের আস্থাটা ধরে রাখতে পারে না। জনগণের আস্থাটা ধরে রাখতে হবে। আপনাকে যে ভোট দিলো আপনি যে এমপি হলেন- আর যদি মনে করেন এবারই হইছি, বানায়ে বুনায়ে খাইয়ে বসে থাকি। অনেক টাকা হলে জিতে আসব। সেটা কিন্তু হয় না।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘তারেক জিয়া গর্ব করে বলত দুই হাজার কোটি টাকা যদি সে বানাতে পারে তবে জীবনেও কেউ বিএনপিকে হারাতে পারবে না। তো ২ হাজারের জায়গায় ৫ হাজার কোটি টাকা বানায়ে কিন্তু থাকতে পারেনি। ৫ হাজার কোটি টাকার ওপর বানিয়েছে তারা। ক্ষমতায় কিন্তু থাকতে পারে নাই। তাদের দুর্নীতি, তাদের সন্ত্রাস, তাদের জঙ্গীবাদ, আওয়ামী লীগের ওপর অত্যাচার ও নির্যাতন।’

‘দেশটা যে আওয়ামী লীগই উন্নতি করে সেটা প্রমাণিত। এটা মানুষের কাছে গেছে। তবে একটা কথা মনে রাখবেন আমরা খুব উন্নয়ন করেছি বলেই সবাই ঢেলে ভোট দিবে তা না। মানুষের চাওয়ার কোন সীমা থাকে না। যত পাবে তত চাইবে। এটা মাথায় রাখতে হবে। আমরা যে উন্নয়ন করে যাচ্ছি সে কথা মানুষকে বার বার বলতে হবে। এটা আপনাদের দায়িত্ব। আপনারা বিভিন্ন জেলা, বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছেন। এটা আপনাদের দায়িত্ব- মানুষকে বলে দিতে হবে যে আপনাদের জন্য আমরা এ কাজ করেছি। আগে ছিল না এখন হয়েছে।’

মানুষ সুখ পেলে দুঃখের কথা ভুলে যায়। আর সুখটা যে কারা দিল সেটাও মনে রাখতে চায় না। সেই কারণে তাদেরকে বার বার স্মরণ করাতে হবে। বলতে হবে- আজকে বাংলাদেশ যে পর্যায়ে এসেছে সেটা আওয়ামী লীগ করেছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দারিদ্রের হার এখন ২০ ভাগে নেমেছে। আমি তো মনে করি আমরা সবাই যদি উদ্যোগ নেই- আমাদের নেতা-কর্মীদের বলবো আপনাদেরও উদ্যোগ নেওয়া উচিত। যে আপনার এলাকায় কয়টা লোক দরিদ্র আছে। কয়টা লোক ভুমিহীন আছে নিজেরাই খুঁজে বের করে বলেন, আমাদেরকে দেন। হিসেব বের করে দল হিসেবে এটা আমাদের একটা কর্তব্য। আমরা করতে পারি, আমাদের দলই পারে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচন করতে চান, ভোট চান, সংগঠন করতে চান, নেতা হতে চান তো আগে মানুষের কাছে যান। মানুষের কি সমস্যা আছে দেখেন। মানুষের জন্য কাজ করেন তাহলে মানুষই আপনাদের সব সুযোগ করে দিবে। আপনাদের কারো কাছে গিয়ে ধর্ণা দিতে হবে না। চাইতেও হতে না।
সুত্র: সারাবাংলা

Print Friendly, PDF & Email