April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ সিলিন্ডারই দুর্ঘটনার কারণ

প্রথম কথা ডেস্ক : মানহীন ও মেয়াদোত্তীর্ণ গ্যাস সিলিন্ডারের কারণেই বিস্ফোরণ ঘটে বলে অভিমত জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের। তা ছাড়া ব্যবহৃত গ্যাস সিলিন্ডারগুলো ঠিকমতো পুনঃপরীক্ষা করা হয় না। ফলে দিন দিন দুর্ঘটনার হার বেড়েই চলেছে। তা ছাড়া গ্যাস সিলিন্ডার কীভাবে সুরক্ষিত রাখা যায় এবং আগুন নির্বাপণের জন্য কী ধরনের প্রস্তুতি রাখা প্রয়োজন, তা পুরোপুরিভাবে গড়ে ওঠেনি বলে মনে করেন তাঁরা।

ইলেকট্রনিকস সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইসাব) সাবেক সভাপতি ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ জহির উদ্দিন বাবর এনটিভি এনটিভি অনলাইনকে এ ব্ষিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন।

এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশে সম্প্রতি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে কেন? 

জহির উদ্দিন বাবর : আমাদের দেশে সিলিন্ডার ও কিটগুলো আসার পর স্থানীয়ভাবে ছাড়পত্র নেওয়ার জন্য পুনঃপরীক্ষা করা হয় না।  প্রধানত এটাই কারণ। বিদেশ থেকে কিছু ব্যবসায়ী অতি মুনাফার আশায় কমমূল্যে সিলিন্ডার ও কিট তৈরি করে নিয়ে আসে।

অগ্নিনির্বাপণের জন্য ফায়ার এক্সিটিংগুইসারের জন্য যেসব কেমিক্যাল আনা হয়, তা বেশিরভাগই ৩০/৩৫ গ্রেডের মানের। যদি ৯০ গ্রেডের মানের কেমিক্যাল আনা হয়, তাহলে অগ্নিনির্বাপণের জন্য ফায়ার এক্সিটিংগুইসার কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। মানসম্মত গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে দুর্ঘটনার ঘটার সম্ভাবনা বহুলাংশে হ্রাস করা সম্ভব।

এ ছাড়া আমাদের দেশে এখনো এসব সিলিন্ডারের মাননিয়ন্ত্রণ করে ছাড়পত্র দেওয়ার মতো সরকারি কার্যকর কোনো সংস্থা নেই। যে কারণে বিদেশি ছাড়পত্র পেয়ে আমদানি করার পর আমাদের দেশে এসব সিলিন্ডার পরীক্ষা করে ছাড়পত্র দেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এ ছাড়া আমাদের দেশে রান্নাঘরে যেসব সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করা হয়, এসব সিলিন্ডারের মুখে রেগুলেটরটি গুরুত্বপূর্ণ। এসব রেগুলেটর অনেক সময় গুণগত মানসম্পন্ন আনা হয় না। আমাদের দেশে এসব জিনিস আনার সময় অনেক সময় কমমূল্যেরটাই আনা হয়।

আমাদের দেশের যেসব ব্যবসায়ী এগুলো আমদানি করে, তাদের ভালোভাবে এগুলো পরীক্ষা করে দেখা উচিত এ রেগুলেটরটি সঠিকভাবে আছে কি না। কেননা, অনেক সময় গ্যাসের প্রেশারের কারণে এসব রেগুলেটরের মুখ হালকা হয়ে যায়। তখন গ্যাস লিক হয়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

এনটিভি অনলাইন : চকবাজার এলাকায় এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, এটাকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

জহির উদ্দিন বাবর : চকবাজার এলাকায় সিলিন্ডার গ্যাস এবং কেমিক্যালের গুদামের কারণে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। আমি মনে করি, একেকটা কেমিক্যাল গুদাম একেকটা ছোট অ্যাটম বোমা। এ ছাড়া সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেসব সিলিন্ডার থাকে, তা যদি বাইরে বিস্ফোরণ হয় তখন এটি ২০০ থেকে ৩০০ হাত পর্যন্ত ওপরে উঠে যেতে পারে। কারণ, এর ভেতরে অনেক হাইপ্রেশার থাকে। কিন্তু প্রেশার রেগুলেটিং করে এগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। কোনো বাড়ির নিচতলায় এসব বিস্ফোরণ হলে ওই বাড়ির একটি অংশ উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা রাখে এসব গ্যাস সিলিন্ডার। যে কারণে গাড়িতে বা বাড়িতে থাকা এসব সিলিন্ডার গ্যাস একেকটা বোমাস্বরূপ।

এনটিভি অনলাইন : এ ক্ষেত্রে কী করণীয়?

জহির উদ্দিন বাবর : এ জন্য প্রতিটি বাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে ফায়ার সেফটিং সিস্টেম রাখা উচিত। এ ছাড়া প্রত্যেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমের ওপর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। প্রশিক্ষণের জন্য বেশি সময় দরকার হয় না। প্রত্যেক মাসে বা বছরে এক ঘণ্টার প্রশিক্ষণই যথেষ্ট। এ ছাড়া আগুন নির্বাপণের বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কেননা এটা জানা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য জরুরি।

এ ছাড়া আমাদের দেশে এখনো বাড়ি নির্মাণ করা হয়, কিন্তু আগুন নির্বাপণের জন্য কোনো ফায়ার ফাইটিং করা হয় না। অথচ দেশে ডেভেলপার কোম্পানি বেড়েছে; বাড়িঘর নির্মাণ বেড়েছে কিন্তু ফায়ার ফাইংটিং সিস্টেম রাখা হয় না।

এনটিভি অনলাইন : সরকারের পক্ষ থেকে সিলিন্ডার গ্যাস বিষয়ে কী উদ্যোগ নিতে পারে?

জহির উদ্দিন বাবর :  গাড়িতে তেলের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে তেলের ওপর মুনাফা বাদ দেওয়া উচিত। কেননা, যখন আমেরিকায় তেলের দাম লিটারপ্রতি বাংলাদেশি টাকায় ৫৫ টাকার কাছাকাছি বিক্রি হয়, তখন বাংলাদেশে বিক্রি হয় ৮৯ টাকারও বেশি। এটা কেন হচ্ছে? অথচ বাংলাদেশের চেয়ে ওই সব দেশের তেলের গুণগতমান বেশি।

এ জন্য সরকার এ খাতে অতিরিক্ত মুনাফা না করে বরং সহনীয় পর্যায়ে তেল বিক্রি করলে মানুষ গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে আনবে। পাশাপশি একটি গাড়ি তেল দিয়ে চললে অনেক দিন আপনাকে সার্ভিস দেবে। কিন্তু একই গাড়ি গ্যাস দিয়ে চললে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে এর ইঞ্জিন বদলাতে হয়।

জ্বালানি তেল থেকে সরকার বছরে হয়তো এক থেকে দেড় হাজার কোটি টাকা মুনাফা করে। কিন্তু দেশের মানুষের প্রতি মাসে লাখ কোটি টাকা লোকসান হয়। কেননা, দেশের সব মানুষ সরাসরি বা ভিন্নভাবে জ্বালানি তেলের ব্যবহারের ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে মিল, কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবকিছুই এর ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে তেলের দাম কমানো ছাড়া বিকল্প নেই।

এনটিভি অনলাইন : ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমের ওপর আপনারা কোনো প্রশিক্ষণ প্রদান করেন কি না?

জহির উদ্দিন বাবর : এ ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইসাব) পক্ষ থেকে বিভিন্ন  ট্রেনিং করানো হয়েছে। এমনকি প্রত্যেক বছর ট্রেনিং করানোর পরিকল্পনা আছে। নতুন সংগঠন হিসেবে ইসাবের পক্ষ থেকে জনগণকে সচেতন এবং শ্রমিকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হবে। ভবিষ্যতে এ প্রক্রিয়া আরো বৃদ্ধি করা হবে।

এ ছাড়া বর্তমান বিশ্বে আগুন নির্বাপণের জন্য অনেক প্রযুক্তি রয়েছে। অটোফায়ার এক্সিটিংগুইসিং সিস্টেম এমন একটি প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে অগ্নিকাণ্ডের প্রাথমিক প্রর্যায়ে ২০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিটের মধ্যে আগুন নির্বাপণ করা সম্ভব। এ ছাড়া শপিংমল, বহুতল আবাসিক ভবন, বাড়িঘর, কলকারখানা নির্মাণে পরিকল্পিতভাবে ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ব্যবহার করা উচিত।

এনটিভি অনলাইন : বাসায় গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে কী করণীয় বলে মনে করেন?

জহির উদ্দিন বাবর : বাসায় অটোফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ব্যবহার করা যায়। যার মাধ্যমে মাত্র ২০ সেকেন্ড থেকে ১ মিনিটের মধ্যে এ প্রক্রিয়ায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে আগুন নিভে যায়। এ ছাড়া বাসার ছোট-বড় সবাইকে আগুন নির্বাপণের বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি।

এনটিভি অনলাইন : বাংলাদেশে অগ্নিনির্বাপণসামগ্রী আমদানিতে কী কী সমস্যা আছে?

জহির উদ্দিন বাবর : আমাদের দেশে অগ্নিনির্বাপণের এক্সিটিংগুইসার আমদানির ক্ষেত্রে বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। এরপর নৌবাহিনী থেকে অনুমোদন নেওয়ার পর খালাস করতে হয়। এটা তো কোনো বোমা তৈরির সরঞ্জাম না। এটা বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে কেন ছাড়পত্র নিতে হবে? এটি একটি বড় সমস্যা। অনেক জাহাজ এই হ্যাসেলের কারণে অধিক শিপমেন্ট চার্জ দাবি করে, এমনকি অনেক জাহাজ জাহাজীকরণও করতে চায় না। এতে সময় এবং খরচ উভয়ই বেড়ে যায়। ফায়ার ডোরের (অগ্নিনিয়ন্ত্রণ দরজা) ট্যাক্স অনেক বেশি। এ ক্ষেত্রে ফায়ার ডোরের ট্যাক্স কমাতে হবে।

এনটিভি অনলাইন : বাসায় আগুন লাগলে কী করণীয় বলে মনে করেন?

জহির উদ্দিন বাবর : এ ক্ষেত্রে ছাদের ওপর ফায়ার ডোর ব্যবহার করতে হবে। কেননা, বিল্ডিংয়ে আগুন লাগলে সেখানে ফায়ার দরজা লাগানো হলে কমপক্ষে দুই থেকে তিন ঘণ্টা মানুষ ছাদে গিয়ে অবস্থান করতে পারবে। এসব দরজা দিয়ে সহজে আগুন প্রবেশ করতে পারে না। সিঁড়ির মুখে এ দরজা লাগানো হলে আগুনকে রুখতে পারবে। ওই দুই-তিন ঘণ্টা সময়ের মধ্যে মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে আনা সম্ভব। -সূত্র এনটিভি অনলাইন

Print Friendly, PDF & Email