May 19, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

শহীদ জননী মেহেরজান বিবির অস্ত্রোপচার সফল

নিজস্ব প্রতিবেদক: অাজ সোমবার জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালে অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে শহীদ জননী মেহেরজান বিবির। মেহেরজানের ছেলে মো. শাহ জাহান পাটোয়াারি দৈনিক প্রথম কথাকে এ কথা জানিয়েছেন। তিনি দেশের সকলের কাছে তার মায়ের সুস্থতা কামনায় দোয়া চেয়েছেন।

চিকিৎসকের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান, তার কোমরের উপরের এ কটা হাড় (বাটি) ভেঙে গেছে। সেখানে আজ সোমবার অস্ত্রোপচার করা হয়। গত শনিবার অস্ত্রোপচার করার কথা ছিলো। কিন্তু শ্বাষকষ্টজনিত সমস্যার কারণে অস্ত্রোপচারের দিন পরিবর্তন করা হয়েছে।মেহেরজান বিবির চিকিৎসার সকল খরচই বহন করছে হাসপাতালটি।

মেহেরজান বিবি মুক্তিযুদ্ধে স্বামীকে হারিয়েছেন। সেইসঙ্গে তার ৬ সন্তানও দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন। যুদ্ধাহত এই জননী ভিক্ষা করেই এতদিন বেঁচে আছেন। সব হারিয়ে তার ঠাঁই হয়েছে ফেনী সদর উপজেলার ধর্মপুর আবাসন ও আশ্রায়ন প্রকল্পের ৩ নম্বর ব্যারাকের ১১ নম্বর কক্ষে। সেখানে থেকেই ৮৮ বছরের এই বৃদ্ধ জননী ভিক্ষা করে পেটের ক্ষুধা মেটাতেন। এরইমধ্যে কয়েকজন তরুণ মানবতার খাতিরে মেহেরজান বিবির পাশে দাঁড়ান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উঠে আসে এই বীরমাতার দুর্দশার চিত্র। গত দুই সপ্তাহ আগে ভিক্ষা করার সময় পড়ে গিয়ে ডান পায়ে আঘাত পান এই জননী। এরপর তাকে ফেনী হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার উন্নত চিকিৎসার জন্য ফেনীর জেলা প্রশাসকের নির্দেশে তাকে রাজধানীর জাতীয় পঙ্গু হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি জাতীয় পঙ্গু হাসপাতালের চতুর্থ তলার ৫৫ নং বিছানায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন। মেহেরজান বিবি ১০ অক্টোবর ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইব্রাহীম উকিল।

জানা গেছে, শহীদ অ্যাডভোকেট ইব্রাহীম ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত উকিল। মেহেরজান বিবির মা বিবি হনুফা। পৈতৃক নিবাস চাঁদপুর সদর উপজেলার বাবুর হাটস্থ ২৬ নম্বর দক্ষিণ তরপুর চন্ডী গ্রামে। তারা তিন ভাই এবং তিন বোন। সোনাগাজী উপজেলার ৬ নম্বর চরছান্দিয়া ইউনিয়নের বড়ধলী হাজী বাড়ির মরহুম মমতাজ উদ্দিনের ছেলে সুবেদার এটিএম সামসুদ্দিনের সঙ্গে মেহেরজান বিবির বিয়ে হয়। পঞ্চাশের দশকে বড়ধলী গ্রাম নদী গর্ভে বিলিন হলে নিঃশ্ব হয়ে তারা ঢাকা শহরে চলে আসেন। ঢাকার মিরপুর ১ নম্বরে জালাল দারোগার বাড়িতে থাকতেন বলে জানা যায়।

গতকাল রবিবার বিকালে শহীদ সন্তান তৌহীদ রেজা নূর এবং শহীদ সন্তান নটো কিশোর আদিত্য জাতীয় পঙ্গু সপাতালে শহীদ জননী মেহেরজান বিবির সাথে দেখা করেন এবং কিছু সময় তার সাথে অতিবাহিত করেন। সে সময় তার কষ্টের কথা তুলে ধরেন শহীদ জননী। নিজের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে অশ্রুশিক্ত হয়ে তিনি বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। খুব সকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে শেখ মনি এসে ডেকে নিয়ে গেল আমার ছয় সন্তানকে। রাতে হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে দিল ঘরবাড়ি। সেই যে সন্তানরা গেল আর তো ফিরে এলো না। বঙ্গবন্ধু যতদিন ছিলেন খবর নিয়েছিলেন। তিনি মারা যাওয়ার পর কেউ আর তেমন খবর রাখেনি।’ মেহেরজান বিবি জানালেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী তার স্বামী ও ৬ সন্তানকে হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি, মুক্তিযোদ্ধা পরিবার জানতে পেরে মিরপুরে তাঁদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে তিনি ঢাকার মিরপুরে বাংলা মিডিয়াম হাই স্কুল (বর্তমানে মিরপুর বাংলা উচ্চ বিদ্যালয়) এর শিক্ষিকা ছিলেন বলে জানান তিনি।

তিনি আরো জানান, স্বাধীনতার পর তার দুঃখ-কষ্টের কথা শেখ ফজলুল হক মনির দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় ছাপা হলে তখন তিনি বঙ্গবন্ধুর নজরে আসেন। বঙ্গবন্ধু তাকে ও তার এক পুত্রবধূ করফুলের নেছাকে ডেকে নিয়ে দুই হাজার টাকা করে অনুদান দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর স্বামী সন্তানদের শহীদ হওয়ার খবরে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিনেও তার পুরোপুরি মানসিক সুস্থতা ফিরে আসেনি। স্বজন-পরিজন সব হারিয়ে চরম অসহায়ত্বের কারণে ভিক্ষাবৃত্তির পথ বেছে নেন তিনি। ২০০৯ সালে ফেনী রেল স্টেশনে ভিক্ষা করতে দেখে জনৈক জিআরপি পুলিশ তাকে ফেনী জেলা প্রশাসনে পাঠান। তখন জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তাকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয় ধর্মপুর আবাসন প্রকল্পে। সেই থেকে তিনি সেখানেই বসবাস করতেন।

মেহেরজান বিবির ৮ পুত্র ও ২ মেয়ে ছিল। তার ছয় পুত্র এবং স্বামী এ টি এম সামসুদ্দিন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহীদ হন। তার শহীদ সন্তানেরা হলেন ছায়েদুল হক (সে সময়ে সিলেটে রিলিফ অফিসার পদে কর্মরত), দেলোয়ার হোসেন, বেলায়েত হোসেন, খোয়াজ নবী, নুরের জামান ও আবুল কালাম। দুই মেয়ে মরিয়ম বিবি ও হাসনা বিবি মারা গেছেন।’ সম্প্রতি মেহেরজান বিবিকে নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পর তার এক ছেলেকে ৩২ বছর পর পাওয়া গেছে। তার নাম মোঃ শাহ জাহান। তবে তার আরও এক ছেলে এখনও নিখোঁজ। তার নাম মোঃ শাহ আলম।

বয়সের ভারে ন্যুজ্ব ৮৮ বছর বয়স্কা অসহায় মেহেরজান বিবি প্রতিদিন মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ভিক্ষা করেন। তার দুঃখে ভারাক্রান্ত জীবন কাহিনী বলতে বলতে অঝোরে চোখ বেয়ে নেমে আসে বেদনার অশ্রু। নিজে কাঁদেন এবং অন্যকেও কাঁদান। এই বয়সে দুই বগলে স্টেচারে ভর দিয়ে গ্রামের দারে দারে দু’মুঠো ভিক্ষার জন্য ঘুরে বেড়ান মেহেরজান। চরম অসহায়ত্বের মাঝে দিন কাটছে তার। সহায় সম্বলহীন মেহেরজারেন আকুতি এখন একটু বেঁচে থাকার।

Print Friendly, PDF & Email