April 28, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

কুটির শিল্প: জাতীয় গৌরব এবং ঐতিহ্যের স্মারক

সুমন জাহিদ: আমি একজন নগন্য বাংলাদেশী। আমার দেশের গৌরব, ঐতিহ্য এই কুটির শিল্প সম্পর্কে ভ্রমণপ্রেমী বন্ধু আপনাদের না বলা পয’ন্ত আমার কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করতে পারছি না। আমি জানি আমার দেশের ভ্রমণপ্রিয় দেশবাসী আপনারা দেশের গৌরব, ঐতিহ্যের স্মারক কুটির শিল্প সম্পর্কে ভালোই জ্ঞান রাখেন, তবুও যারা বর্তমান তরুণ প্রজম্ম তাঁদের দেশ ভ্রমণের সাথে সাথে আরো একটি দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে ।
আমাদের দেশের অতীত গৌরব, ঐতিহ্যময় কুটির শিল্পকে বিশ্বের সামনে আবার নতুব ভাবে তুলে ধরতে হবে । আমাদের দেশে দেখার মতো সুন্দর স্থান যেমনি আছে, তেমনি দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অহংকার করার মতো কুটির শিল্প সামগ্রি । একটি গান আছে, “বাশিঁ শুনে আর কাজ নাই সে যে ডাকাতিয়া বাঁশি” । আমাদের দেশে নদীর পাড়ে বসে রাখালের বাঁশির সুর শুনে কতো বিদেশী বাঁশিতে সুর সাধনা করতে এই দেশে বারে বারে ছুটে এসেছেন তার খবর কয়জন রাখেন? “আমি যখন রান্ধিবাড়ি বন্ধু বাজাও বাঁশি, রান্নাবাড়া ছেড়ে আমি কেমন করে আসি”? আসলেই ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়ার বাঁশি আমরা বাজিয়ে চলেছি । পাগল করা বাঁশির সুর এই দেশের নানা প্রান্তে এখনও বেজে চলেছে, যা এই কুটির শিল্প পরিবারের অনুজ ।  কেন এ কথা বলছি? বান্দবানের লামা থানার নয়াপাড়া নামক গ্রামে উপজাতি মারমাদের একট সমবেত নৃত্য ঊপভোগ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল । সেখানে আমি দেখেছি একটি গরুর বাছুরকে খুঁটির সাথে বেঁধে রেখে নারীরা ঘুরে ঘুরে নৃত্য করে, আর পুরুষেরা কানে ফুল চড়িয়ে লম্বা লম্বা বিশেষ ধরনের বাঁশিতে ফু দেয় । সেই বাঁশির সুর অসাধারণ সুরের ব্যাঞ্জনা সৃষ্টি করে । আপনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেই সকল সাধারণ মানুষের হাতে তৈরী অসাধারণ কুটির শিল্প (Handicraft) দেখে বিশ্ময়ে বিমুগ্ধ হবেন । আশা করি বুঝাতে পেরেছি কেন আপনি পর্যটন করতে গেলে এই সকল কুটির শিল্প পণ্যের সাথে পরিচিত হবেন । আমাদের দেশের ঐতিহ্য এই সকল কুটির শিল্পকে প্রনোদনা দিবেন, এই আমার প্রতাশা । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “বহু দিন ধরে বহু ক্রোশ দূরে,/বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে,/দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা,/দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু ।/দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,/ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া,/একটি ধানের শীষের উপরে,/একটি শিশির বিন্দু” । আমাদের দেশে যা কিছু সুন্দর স্হান, লোকজ সংস্কৃতি, মেলা, কুটির শিল্প পণ্য, আমাদের দেশের তরুণ সমাজকে উদাত্য আহবান করছে, আসুন আপনার পদধুলি দিন।  আমাদের কুটির শিল্প কমী’দের আপনাকে এই মুহূতে’ খুবই প্রয়োজন । আজ কুটির শিল্প বিলুপ্ত প্রায় ।
আমি আপনাদের আহবান করছি, আপনার জানা আশে পাশের কুটির শিল্পগুলোকে প্রমোট করুন ।
কুটির শিল্প  বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী একটি শিল্প । এ শিল্পে বাংলার আবহমান সংস্কৃতির চিত্র ফুটে ওঠে, যার নির্মাতা পল্লী অঞ্চলের মানুষ । বাংলার প্রকৃতি, মানুষ, পশুপাখি, লতাপাতা, গাছপালা, নদ-নদী ও আকাশ কুটির শিল্পের ডিজাইনে বা মোটিভে দেখা যায় । প্রাক-ব্রিটিশ বাংলায় বাংলার কুঠির শিল্পের ছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি । আমাদের জাতির সংস্কৃতির পরিচয় পাওয়া যায় আমাদের কুটির শিল্পে । কিন্তু কালের বিবর্তনের কারনে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্প । আমরা গর্বের সাথে নতুন করে তুলে ধরতে চাই আমাদের এই শিল্পকে । ফিরিয়ে আনতে চাই আমাদের এই শিল্প পণ্যের ব্যবহার । তাই আমাদের শ্লোগান হোক “আমাদের ঘরে ঠাই হোক আমাদেরই ঐতিহ্যের”। কারন “ঘর থেকেই শুরু হয় বিশ্বযাত্রার” ।
বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্পের ঐতিহ্য অনেক পুরনো । বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে লোক ও কারুশিল্পের অবস্থান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক, কায়িক শ্রমে ও নান্দনিক কৌশলে ব্যবহারিক বস্তুকে সৌন্দর্য ও কারুমন্ডিত করার উদ্দেশ্য অলঙ্ককরণকেই আমরা ‘কারুশিল্প’ হিসেবে অভিহিত করি । অন্যদিকে যৌথ চেতনার ফসল হচ্ছে লোকশিল্প । যা স্বতঃস্ফূর্তভাবে সহজ-সরল পরিবেশে তৈরি হয় । গঠনশৈলী, বিষয়বস্তু, উৎপাদন ও নির্মাণ কৌশলে লোকজ রূপ থাকায় তা লোকশিল্প হিসেবে অভিহিত করি । সুশৃঙ্খল সূত্রমাফিক তৈরি করা হলেও কারুশিল্পে থাকে ঐতিহ্যের সমাচার । এরপরও তা সৃজনশীলতা পাশাপাশি বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাসে বাংলাদেশের কারুশিল্প ও কারুশিল্পীদের অবদান অনস্বীকার্য । আবহমানকাল থেকেই  এদেশের লোক ও কারুশিল্প নিজ নিজ ধারায় প্রবহমান । কারুশিল্প হলো  লোকশিল্পের দোসর, এ দুয়ের ব্যবধানও খুব সামান্য । এ কারণেই অনেক সময় এ দু’টিকে এক ও অভিন্ন মনে হয় । দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের পাশাপাশি লোক ও কারুশিল্প আমাদের সংস্কৃতিরও পরিচয় বহন করে । লোক ও কারুশিল্পের কল্যাণেই বহির্বিশ্বে এক সময় বাংলাদেশের পরিচিতি ছিল সেরা মানের শিল্পের দেশ হিসেবে । এক্ষেত্রে আমাদের এক গৌরবময় অতীত ছিল । এ দেশের লোক ও কারুশিল্পীদের সহজাত রুচি, সৌকর্য ও শিল্পবোধ থেকে সৃষ্ট শিল্পকর্ম যুগ যুগ ধরে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে এই অপরুপ বাংলার গ্রামীন জনপদে টেনে নিয়ে এসেছে ।
আয়তন ও বৈচিত্র্যের তুলনায় বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্পের ভান্ডার অনেক বেশি সমৃদ্ধ । কারুশিল্পের বিশাল ভান্ডারে রয়েছে জামদানি, বেনারসি, কাতান, খদ্দর কাপড়, ঢাকাই শাড়ি, রেশমের তৈরি কাপড়, কম্বল, সতরঞ্জি, অলঙ্কার (চুরি, বাজু, শাঁখা),  ধাতব শিল্প, সুচি শিল্প, রঞ্জন শিল্প, শঙ্খ শিল্প, মৃৎ শিল্প, চামড়া শিল্প, দারু শিল্প, শামুক ও ঝিনুক শিল্প, হাতির দাঁতের শিল্প, পুতুল শিল্প, পিতল-কাঁসা শিল্প, বাঁশ-বেত শিল্প, শোলা শিল্প,  বিয়ের সাজসজ্জার উপকরণ শিল্প ইত্যাদি । এছাড়া নকশি কাঁথা, নকশি শিকা, নকশী পিঠা, শীতল পাটি, খেলনা পুতুল, মাটির ফলকচিত্র, ছাঁচ, আলপনা, কোমর তাঁতে বোনা কঠিন চীবন,  লোকবাদ্য যন্ত্র, ধানের খড়ের সোপিচ,  শষ্য দানায় তৈরী শিল্পকম’ প্রভৃতি আমাদের লোক ও কারুশিল্পের নিদর্শন । বেঁচে থাকার তাগিদে  কাজ করতে গিয়ে এবং অবসর মুহূর্তে বসে এসব শিল্পসম্পদ তৈরি করেছেন কারুশিল্পীরা । বাংলাদেশের লোকজীবনের শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যগুলোই উঠে এসেছে আমাদের লোক ও কারুশিল্পে । এসব শিল্প আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক,  সেই সাথে গৌরবেরও অংশ । কিছু কারু শিল্প পণ্যের পরিচিতি তুলে ধরছিঃ-
তাঁত ও বয়ন শিল্পঃ
বাংলাদেশের তাঁত ও বয়ন শিল্পের ঐতিহ্য সর্বজনবিদিত । বিশেষ করে এ দেশের মসলিন ও জামদানির রয়েছে বিশ্বজোড়া খ্যাতি । কথিত আছে,  এই মসলিন এবং জামদানি সারাবিশ্বে উঁচুমানের বস্ত্র হিসেবে বিবেচিত ছিল প্রায় অষ্টাদশ শতকের শেষ পর্যন্ত । হস্তচালিত তাঁত শিল্পেরই ফসল ঢাকাই মসলিন । আর সূক্ষ্ম জমিনের ওপর বিচিত্র সব নকশামন্ডিত মসলিনের নাম হচ্ছে- জামদানি । জামদানি মূলত মসলিনেরই অংশ । প্রাচীন আমলে উন্নতমানের জামদানি তৈরি হতো ঢাকা, ধামরাই, সোনারগাঁ, বাজিতপুর, জঙ্গলবাড়ী প্রভৃতি স্থানে । বর্তমানে নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জ, সোনারগাঁ, আড়াইহাজার, নরসিংদী, মনোহরদী প্রভৃতি স্থানে জামদানী শাড়ী তৈরি হয় । আর ডেমরার হাট হচ্ছে জামদানির প্রধান বিক্রয় কেন্দ্র । জামদানি নকশা এখন শুধু শাড়িতেই সীমাবদ্ধ নেই । এমব্রয়ডারি পোশাক, শুভেচ্ছা কার্ড, বিয়ের আলপনা, চিঠির প্যাড এমনকি চামড়ার জিনিসপত্রেও বিস্তৃতি লাভ করেছে । প্রাচীনকাল থেকে এখন পর্যন্ত অক্ষুণ্ন রয়েছে জামদানির কদর । সময়ের প্রয়োজনে মসলিন,  জামদানি কালের আবর্তে বিলীন হলেও আজও অক্ষুণ্ন রয়েছে ঢাকাই শাড়ির গৌরবময় জনপ্রিয়তা ।
বস্ত্রশিল্পঃ
কুটির শিল্পে উৎপাদিত বস্ত্র শিল্পের কথা বলতে গেলেই বাঙালি মনে স্মরণে আসবে মসলিনের কথা, যা একদিন বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল । তাঁত শিল্পে এখন আর নেই সেই মসলিন । তবে তাঁত শিল্প শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা ইত্যাদি উৎপাদনে ভূমিকা রাখছে ।  বস্ত্র শিল্পের মধ্যে বাংলাদেশের বিখ্যাত এলাকা হলো- নরসিংদী, রায়পুরা, ডেমরা, বাববাজার, কেরানীগঞ্জ, মুঞিগঞ্জের দোহার, টাঙ্গাইল, শাহজাদপুর, বেড়া, কুমিল্লার মনোহরপুর, মুরাদনগর উপজেলা,  কুমারখালি, মাগুরা, রাজশাহী,  সিলেটের খাদিমনগর, রাঙ্গামাটি, প্রভৃতি অঞ্চল । সাম্প্রতিককালে ঐতিহ্যবাহী উপজাতীয় বস্ত্র, মসলিন, জামদানী, পাবনার শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি, রাজশাহীর রেশমবস্ত্র ও কুমিল্লার খদ্দর বস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন ধরনের ফ্যাশন শো অনুষ্ঠিত হচ্ছে ।
গালিচা বুননঃ 
বাংলাদেশের গালিচা বুননের ঐতিহ্যও সুপ্রাচীন । ষোড়শ শতাব্দীতেই ঘোড়াঘাটে পাটের বস্ত্র বয়ন করা হতো বলে কথিত আছে । সতরঞ্জি বয়নের প্রাচীন কেন্দ্র অবস্থিত রংপুরের রবাট’সনগঞ্জে । ঢাকার বেশ কয়েকটি কারখানায় পাট ও উল দিয়ে তৈরি করা হয় কার্পেট । উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ঢাকায় পাট দিয়ে বোনা হতো ছালা ও লেপের কাপড় ।
রঞ্জন শিল্পঃ
বিলুপ্তপ্রায় রঞ্জন শিল্প বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থার (বিসিক) প্রকল্প সহায়তায় নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে । বর্তমানে সোনারগাঁ,  রূপসী,  সাভার এবং কুমুদিনী, প্রশিকা, গণস্বাস্থ্য, ব্র্যাক প্রভৃতি সংস্থার উৎপাদন কেন্দ্রে বেশ কিছু কারিগর এ শিল্পে নিয়োজিত রয়েছেন । আর এসব কারখানায় উৎপাদিত রঙও রফতানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ।
নকশি কাঁথাঃ
নকশি কাঁথা বাংলাদেশের লোক ও কারু শিল্পের ঐতিহ্যমন্ডিত ও নান্দনিক নিদর্শন । পুরনো কাপড়ের কাঁথা সেলাই করে তার ওপর গ্রামবাংলার মহিলারা বিভিন্ন নকশা তোলেন-একেই বলে নকশি কাঁথা । এই নকশি কাঁথায় জড়িয়ে থাকে অনেক সুখ-দুঃখের স্মৃতি । ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, খুলনা, রাজশাহী,  যশোর, ফরিদপুর, পাবনা, দিনাজপুর, বগুড়া প্রভৃতি জেলায় তৈরি হয় বিচিত্র ধরনের নকশা সংবলিত কাঁথা । এসব নকশি কাঁথার ব্যবহার ভেদে বিভিন্ন নামও রয়েছে । যেমন গায়ে দেয়ার কাঁথা, বিছানার কাঁথা, শিশুর কাঁথা,  সুজনী কাঁথা, বর্তনী রুমাল কাঁথা, পালকর কাঁথা, বালিশের ঢাকনি,  দস্তরখানা, পান পেঁচানী, আরশীলতা প্রভৃতি । বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ সুচিকর্ম হলো নকশি কাঁথা । ১৩ ধরনের নকশি কাঁথা এদেশে তৈরি হয় । তার মধ্যে প্রসিদ্ধ চিত্রিত কাঁথা,  মাটিকাঁথা ও পাইড় কাঁথা । বাংলাদেশের সর্বত্র কাঁথা প্রস্তুত হলেও যশোহর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রংপুর, ফরিদপুর ও কুষ্টিয়ার কাঁথা সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট মানের । এসকল অঞ্চলে লেপ কাঁথা,  দুজনী কাঁথা,  দুরনীকাঁথা,  আরশীলতা,  ওড়কাঁথা,  বাতায়নকাঁথা ও দস্তরখানা প্রস্তুত হয় ।
শিকাশিল্পঃ
বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী লোক ও কারুশিল্প স্বতন্ত্র ও আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল শিকাশিল্প । পাট হচ্ছে শিকা তৈরির প্রধান উপকরণ । তবে নকশি শিকা তৈরিতে কঞ্চি সুতলি,  ঝিনুক, কড়ি, শঙ্খ, কাপড়, পোড়ামাটির বল ইত্যাদিও ব্যবহৃত হয় । বইপত্র,  কাঁথা-বালিশ,  শিশি-বোতল,  বাসনপত্র, পাতিল-কলসি, আয়না-চিরুনি এসব সর্বত্রই বিভিন্ন সাইজের শিকা তৈরি করেন গ্রামীণ মাহলারা । হালে শিকার ব্যবহার কিছুটা কমলেও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি । গ্রামীন মহিলাদের তৈরি নকশি শিকার অসংখ্য আঞ্চলিক নাম রয়েছে, যেমন- উল্টাবেড়ী, ফুলটুংগী, রসুন দানা, আংটিবেড়, ফুলমালা, ডালিম বেড়,  ফুলচাং, গানজা ইত্যাদি । বিদেশিদের কাছেও বাংলাদেশের শিকাশিল্প আবেদন তৈরিতে সক্ষম হয়েছে । পাট দিয়ে ঐতিহ্যবাহী শিকা তৈরির পাশাপাশি আজকাল পাটের তৈরি টেবিল ম্যাট, মানি ব্যাগ, ফ্লোর ব্যাগ, নেট, প্লেটম্যাট,  লেডিস ব্যাগ, দেয়াল সজ্জা ও গৃহসজ্জারও রকমারি সামগ্রী তৈরি হচ্ছে । এসব সামগ্রীও দেশ-বিদেশে সমানভাবে সমাদৃত হচ্ছে ।
নকশি পিঠাঃ
বাংলাদেশের লোক কারুশিল্পে নকশি পিঠার ঐতিহ্যও অনেক দিনের । পিঠার গায়ে নকশা এঁকে অথবা ছাঁচে ফেলে পিঠাকে চিত্রিত করে তৈরি করা হয় নকশি পিঠা । নকশায় তোলা হয় দৈনন্দিন জীবনের রকমারি চিত্র । এসব নকশি পিঠা একান্তভাবেই নারীমনের সৃজনশীলতার ফসল । ঋতুভিত্তিক বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎসব, পার্বণ, আচার-অনুষ্ঠান, পূজা-পার্বণ, বিয়ে-শাদী প্রভৃতি উপলক্ষে নানা স্বাদের নকশি পিঠা তৈরি করা হয় । এসব পিঠারও রয়েছে বিভিন্ন নাম । যেমন- চিতল পিঠা, ভাপা পিঠা, চিরল পাতা, সজনেপাতা, কাজলপাতা, জামাইমুখ, কন্যামুখ, পাকন, বিবিখানা প্রভৃতি ।
নকশি পাখাঃ
নকশিকাঁথা, নকশি শিকা আর নকশি পিঠার মতোই বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্পের ঐতিহ্যের আরেক প্রতীক হচ্ছে নকশি পাখা । তালপাতা, সুপারীর পাতা ও খোল, সুতা, পুরনো কাপড়, বাঁশের বেতি,নারিকেল পাতা, চুলের ফিতা, পাখির পালক ইত্যাদি অতি সাধারণ ও সহজলভ্য উপকরণ দিয়ে পাখা তৈরি করা হয় । আগে গ্রীষ্মকালে শরীর ঠান্ডা করার জন্য গ্রামবাংলায় হাতপাখার ব্যাপক প্রচলন ছিল । এখনও গ্রামবাংলায় নকশি পাখার ব্যবহার রয়েছে । তা নগর জীবনের অসহনীয় লোডশেডিংয়ের সময়ও ব্যবহার করা হয় । এসব নকশি পাখার রয়েছে বিভিন্ন নাম- যেমন বাঘাবন্দী, শঙ্খলতা,  কাঞ্চনমালা,  সজনে ফুল ইত্যাদি । এক সময় বর, বধূ ও তাদের সঙ্গে আসা মেহমানদের বড় সাইজের তালপাতার হাতপাখা দিয়ে বাতাস করা হতো ।
শীতলপাটিঃ
বাংলাদেশের প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী এক শিল্পের নিদর্শন হচ্ছে শীতলপাটি । মুর্তা নামক এক ধরনের বেতি বা পাতি দিয়ে শীতলপাটি বোনা হয় । এতে লাল, নীল, সবুজ, কালো ও বেগুনিরঙের বাহার থাকে । সিলেটের বালাগঞ্জ,  রাজনগর, বরিশালের স্বরূপকাঠি, ফরিদপুরের সাতৈর, নোয়াখালীর সোনাগাজী, ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা, কুমিল্লার ময়নামতি প্রভৃতি স্থানে উন্নতমানের শীতলপাটি তৈরি হয় । আজকাল মানিব্যাগ, হাতব্যাগ, কাঁধে ঝোলানোর ব্যাগ,  টেলিম্যাট প্রভৃতি কাজে ব্যবহৃত হয় শীতলপাটি ।
লোকচিত্রঃ
লোকচিত্র বাংলাদেশের লোক ও কারু শিল্পের এক বর্ণাঢ্য ও ঐতিহ্যবাহী ভুবন । নানা সৃষ্টিতে রূপ লাভ করেছে সৃজনশীল চিত্রশিল্প । আবহমানকালের লোক সমাজের দৈনন্দিন জীবন, ধর্ম বিশ্বাস, লৌকিক আচার-আচরণ ধারণ করে আসছে এ দেশের এক অমূল্য সম্পদ চিত্রিত হাঁড়ি । অঞ্চলভেদে এসব চিত্রিত হাঁড়ির রয়েছে বিভিন্ন নাম । বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্রই চিত্রিত হাঁড়ি, কলসি পাওয়া যায় । এরপরও ঢাকার ধামরাই, নয়ারহাট, টাঙ্গাইলের কালিহাতি,  রাজশাহীর বসন্তপুর এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের বারোঘরিয়া প্রভৃতি এলাকার চিত্রিত হাঁড়ি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । রাজশাহীর শখের হাঁড়িতে রয়েছে বাংলাদেশের আবহমানকালের ঐতিহ্য । এসব হাঁড়িতে ঘোড়া, পাখি, শাপলা ফুল, পানপাতা, মাছ প্রভৃতি প্রতিকৃতি ব্যবহৃত হয় ।
মৃৎশিল্পঃ
বাংলাদেশের লোক ও কারু শিল্পে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছে মৃৎশিল্প । এ শিল্পের হাজার বছরের ইতিহাস  রয়েছে । এ শিল্পকে ঘিরে গ্রামবাংলার অনেক পরিবার জীবন-জীবিকাও নির্বাহ করেন । ঢাকা, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল,  ফরিদপুর, কুমিল্লা, সিলেট, যশোহর, দিনাজপুর, কক্সবাজার প্রভৃতি জেলার মৃৎ শিল্পীরা ঐতিহ্যগতভাবে মাটির জিনিসপত্র তৈরি করে আসছেন । দেশের ঐতিহ্যবাহী মৃত শিল্পসামগ্রীর মধ্যে রয়েছে হাঁড়িপাতিল, কলসি, সানকি, চুলা,  মাটির ব্যাংকখ্যাত শাক-সবজি, ফলমূল, বাচ্চাদের খেলনা, মাটির ময়না পুতুল, ঘরের টালি, পানি সেচের নালি,ধর্মীয় প্রতিকৃতি (মুতি’),  প্রাণীর প্রতিকৃতি, মৃৎঅলঙ্কার প্রভৃতি । গ্রামীণ হাটবাজার এবং শহর-বন্দরেও মাটির জিনিসপত্র পাওয়া যায় । ঢাকার রায়েরবাজার এবং আড়ং, কারিতাস,  প্রবর্তনা, কারুপণ্য, ও অন্যান্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহ মিরপুর রোডের পাশে, টিএসসি সংলগ্ন ফুটপাতে, ইডেন মহিলা কলেজের প্রাচীর সংলগ্ন, শিশু একাডেমীর সামনে সহ বিভিন্ন স্থানে মাটির জিনিসপত্র বেচাকেনা হয় । এছাড়া সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের কাছে মৃৎশিল্পের পর্যটন বাজার  গড়ে উঠেছে । মৃৎশিল্পের সাথে সম্পৃক্ত বহু পরিবার বংশানুক্রমিকভাবে বরিশাল, ঢাকা,  ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, পাবনা, বগুড়া এবং কুমিল্লায় জীবনযাপন করছেন । কিন্তু বর্তমানে মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, বাসনপত্র, কলস ইত্যাদির পারিবারিক এবং ব্যক্তিগত ব্যবহার কমে যাওয়ায় মৃৎশিল্পের মালিকরা উল্লেখিত সামগ্রীসমূহের উৎপাদন পূর্বের তুলনায় কমিয়ে দিয়েছেন । বর্তমানে মূলত ফুলের টবসহ অন্যান্য সৌখিন সামগ্রী উৎপাদন করে এ শিল্পটি বেঁচে আছে ।
পাটজাত শিল্পঃ
বাংলাদেশের সোনালী আঁশখ্যাত পাট দিয়ে প্রস্তুত পাটজাত দ্রব্যে হস্তশিল্পের কারুকার্যের মাধ্যমে ফুটে উঠে এক নিপুন শিল্প । সৌখিনতার সবচেয়ে বড় নিদর্শন এ পাটজাত শিল্প । পাট দিয়ে বিভিন্ন মোটিভের সিকা, টেবিলম্যাট,  শতরঞ্জি, কার্পেট, সৌখিন হ্যান্ডব্যাগ, থলে ইত্যাদি তৈরি হয় ।
কাঁস পিতল শিল্পঃ
কাঁসা-পিতলজাত শিল্প এ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে  জড়িত । ঢাকার ধামরাই, সাভার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুরের ইসলামপুর,  রংপুর, কুমিল্লা, টাঙ্গাইল ও শরিয়তপুরে পারিবারিক শিল্প হিসেবে বংশ পরম্পরায় তৈরি হয়ে আসছে ।
বাঁশ ও বেত শিল্পঃ
এ শিল্পে কুমিল্লা চথা’, কোটবাড়ী, দিনাজপুর, বরিশাল, খুলনা, নোয়াখালী, সিলেট, ও চট্টগ্রাম জেলার মানুষ তুলনামূলক বেশি জড়িত আছেন ।
শিল্প একটা দেশের সংস্কৃতিকে ফুঁটিয়ে তুলে । প্রাক-ব্রিটিশ সময় থেকে কুঠির শিল্প বাংলার ঐতিহ্য বহন আসছে । আর এ ঐতিহ্য ধরে রাখতে কুঠির শিল্পের উৎপাদন ও ব্যবহারের বিকল্প নেই । এই সকল কুটির শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে এবং পল্লী অঞ্চলের সহজ-সরল মানুষের মুখের হাঁসি ফুটাতে সরকারসহ আমাদের সকলের একটু ইচ্ছাই যথেষ্ট । এ ইচ্ছাই পারে বাঁচিয়ে রাখতে আবহমান বাংলার চিরায়ত রুপসহ ঐতিহ্যবাহী শিল্প কুটির শিল্পকে । আমরা গ্রুপে বা পরিবারে ভ্রমণ করলে সেই সকল কুটির শিল্প অবশ্যই কিনে আনবো ।
লেখক: মুক্তিযোদ্ধা ‘শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন’ এর সন্তান।
Print Friendly, PDF & Email