April 28, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

ছবি: সংগ্রহিত

প্রতিনিয়ত বুড়িগঙ্গার দূষণ আরও বিস্তৃত হচ্ছে

দেলোয়ার হোসেন মহিন: বুড়িগঙ্গা নদীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক নগরী ঢাকা। মুঘল, ব্রিটিশ আর পাকিস্তান আমল পেরিয়ে গেছে। বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা ঢাকার বয়সও ছাড়িয়ে গেছে ৪০০ বছর। এ নদীকে কেন্দ্র করে ঢাকা হয়ে ওঠে অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক নগরী।

পণ্য আদান-প্রদান থেকে শুরু করে যাত্রী পরিবহন, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সবই বাড়তে থাকে। শিল্পায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে গিয়ে মানুষ এ নদীকে একটু একটু করে ধ্বংস করে দিয়েছে। শিল্পকারখানার বর্জ্য থেকে শুরু করে গৃহস্থালির বর্জ্য সবগুলোর শেষ ঠিকানা আজকের এই বুড়িগঙ্গা।

প্রতিনিয়ত প্রায় ৩ কোটি মানুষের ব্যবহৃত বিষাক্ত পানি ও বর্জ্য এসে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। ঢাকা মহানগর ও কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকার গৃহস্থালি, শিল্পকারখানা ও হাসপাতালের কঠিন বর্জ্যরে একটা বড় অংশ কোনো শোধন ছাড়াই প্রতিদিন বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। অপরিশোধিত বর্জ্যরে প্রতিটি ফোঁটা এ নদীকে ধ্বংস করে দিয়েছে। ক্রমাগত দূষণে এর পানি এখন কালচে আকার ধারণ করেছে। কালো রঙের পানি উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে। পানির দুর্গন্ধে শ্বাস নেওয়াই কষ্ট হয়ে পড়ে। নদীর পানিতে ভাসছে নানা ধরনের ময়লা-আবর্জনা। এর সঙ্গে বিশ শতকের নতুন আবিষ্কার পলিথিন দূষণের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। বুড়িগঙ্গা পরিণত হয়েছে পৃথিবীর অন্যতম দূষিত নদীতে। মাত্রাতিরিক্ত এই দূষণ কমাতে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সাভারের হেমায়েতপুরে সরিয়ে নেওয়া হয় ২০১৭ সালের এপ্রিলে। তবে দূষণ থেকে রক্ষা পায়নি নদী। ট্যানারির জায়গা নিয়েছে বুড়িগঙ্গার দু’পাশে থাকা শতাধিক ওয়াশিং ও ডায়িং কারখানা।

হাজারিবাগ থেকে পোস্তগোলা সেতু পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর দুইপাড় সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নদীর পানি কালো কুচকুচে। পানি থেকে ছড়াচ্ছে উৎকট দুর্গন্ধ। বিভিন্ন ধরনের ময়লা-আবর্জনা যেন বুড়িগঙ্গায় স্থায়ী নিবাস গড়েছে। বুড়িগঙ্গার দুই পাড়ের মানুষের কাছে এই চিত্র এখন অনেকটাই সহনীয় হয়ে গেলেও তারা ভুগছেন নানারকম দূষিত পানিবাহিত রোগব্যাধিতে। এই পথে চলাচলকারীরা কোনোরকমে নাক-মুখ চেপে এখন যাতায়াত করেন।

বুড়িগঙ্গার পাড়ের মীরের বাগের বাসিন্দা নাসির উদ্দিন বলেন, পেশাগত কারণে প্রতিদিনই দুইবার করে বুড়িগঙ্গা পাড়ি দিতে হয়। এই পথে এতই দুর্গন্ধ যে দম (শ্বাস-প্রশ্বাস) নেয়া দায় হয়ে পড়ে। অথচ ২০/৩০ বছর আগেও সকাল-সন্ধ্যায় ঢাকার মানুষ চলে যেত বুড়িগঙ্গার নির্মল বায়ু সেবনের জন্য। অনেকে নৌকা ভাড়া করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘুরে বেড়াত নদীর বুকে। সেই সদরঘাট, সোয়ারীঘাট ও বাকল্যান্ড বাঁধের ধারে ভ্রমণ আর নির্মল বায়ু সেবন এখন অকল্পনীয়।

সরেজমিনে দেখাযায় অবৈধভাবে নদীর দুই তীরে গড়ে ওঠা অসংখ্য শিল্প-কারখানা, বহুতল মার্কেট, ইট-পাথর-সিমেন্টের মহাল, কাঁচামালের আড়ত, ছিন্নমূল মানুষের শত শত বস্তি, নদী ভরাট করে মসজিদ, মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির কারণে ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে নদীর প্রস্থ। সেই সঙ্গে একশ্রেণীর বিবেকহীন মানুষের যথেচ্ছ অপব্যবহারে বুড়িগঙ্গা নদীর পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়েছে। বর্তমানে দূষণ অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করে গেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে কাজ করছে বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন। পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ, পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা), রিভারাইন পিপল সব সংগঠনের অন্যতম। সংগঠনগুলো কাজ করছে নদ-নদী রক্ষার তাগিদে। তারা সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি আইনগত লড়াইও চালাচ্ছে। একের পর এক রিট করছে। কিন্তু বুড়িগঙ্গা রক্ষা, দূষণ রোধ এবং স্বাভাবিক প্রবাহ ফেরানোর চেষ্টার ফলাফল এখনো বলতে গেলে শূন্য। বুড়িগঙ্গা এখন ক্ষয়িষ্ণু।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের গবেষকরা জানিয়েছেন, কেরানীগঞ্জের শতাধিক ওয়াশিং কারখানা থেকে দৈনিক অন্তত ১৮ লাখ লিটারের বেশি বিষাক্ত তরল বর্জ্য মিশছে বুড়িগঙ্গায়। শ্যামপুর শিল্প এলাকার শতাধিক প্রিন্টিং, নিট, ডায়িং কারখানা থেকে প্রতিদিন বের হয় ৩০ হাজার ঘনমিটারেরও বেশি অপরিশোধিত তরল বর্জ্য, যা নদীতে যাচ্ছে সরাসরি। প্রতিষ্ঠানটির এক নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, হেমায়েতপুরের চামড়া শিল্পনগরীর বর্জ্যও ধলেশ্বরী হয়ে ফের বুড়িগঙ্গায় মিশছে। এ ছাড়া কয়েক ডজন অতি-ক্ষুদ্র পর্যায়ের কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান এখনও হাজারীবাগে কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

বুড়িগঙ্গা দূষণের এ চিত্রের সত্যতা মিলেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগ, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুম লীয় দূষণ কেন্দ্র (ক্যাপস) ও ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ে গঠিত কনসোর্টিয়ামের গবেষণায়ও। শ্যামপুরে বুড়িগঙ্গার পানি গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বর্ষার আগে, বর্ষা এবং বর্ষার পর পরীক্ষা করেছেন গবেষকরা।

ফলাফলে দেখা যায়, বুড়িগঙ্গায় পানির অম্লত্বের (পিএইচ) মান বর্ষার আগে-পরে থাকে ৭ দশমিক ৬ থেকে ৮ দশমিক ৫, যা ক্ষারীয়ধর্মী। ডায়িং শিল্পের তরল বর্জ্যের কারণে নদীর পানির পিএইচ এমন। পানিতে অদ্রবণীয় ক্ষুদ্র কঠিন পদার্থ (টোটাল সাসপেন্ডেবল সলিডস, টিএসএস) পাওয়া গেছে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫, অথচ পানিতে এর আদর্শ মান ১০। পানিতে অ্যামোনিয়া ২ থেকে ৪ দশমিক ৮ পর্যন্ত ছিল, যার আদর্শ মান শূন্য দশমিক ৫। তিনটি ভিন্ন ঋতুতে শ্যামপুরের পানিতে তেল ও গ্রিজের পরিমাণ ১ দশমিক ৯ থেকে ৫ দশমিক ৬ পর্যন্ত। অথচ এটি শূন্য দশমিক শূন্য ১ শতাংশ থাকার কথা।

গবেষণা দলের নেতা স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার জানান, বিশ্বব্যাংক ৭২টি রাসায়নিক উপাদানকে বিষাক্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যা শুধু টেক্সটাইল ডায়িং থেকে তৈরি হয়। বুড়িগঙ্গার পানিতে ক্ষতিকর সব উপাদান পাওয়া গেছে। এগুলো জলজ প্রাণী ও মানব স্বাস্থ্যের জন্যও হুমকি। এই চিত্র এটাই প্রমাণ করে, বুড়িগঙ্গার দূষণ আরও বিস্তৃত হচ্ছে।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের গবেষকরা আরও জানায়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত শ্যামপুরের পানি পরীক্ষা করা হয়েছে। তিন ঋতুতে রাসায়নিক অক্সিজেন চাহিদা বা সিওডি যথাক্রমে ১৯০, ২২৭ ও ২৭৬। যা আদর্শমান ৪ এর চেয়ে বহুগণ বেশি। এ সময়ে জৈবিক অক্সিজেন চাহিদা বা বিওডি‘র পরিমাণ যথাক্রমে ৮৭, ৭২ ও ১০৬। যা আদর্শমান ০ দশমিক ২ এর তুলনায় অনেক বেশি। পানিতে অ্যাম্যোনিয়ার পরিমাণ তিন ঋতুতে ৪ দশমিক ৮, ৪ দশমিক ২ ও ২ দশমিক ৮, যা আদর্শমান ০ দশমিক ৫ এর চেয়ে বেশি। শ্যামপুরের পানিতে উচ্চমাত্রার তেল ও গ্রিজ পাওয়া গেছে। তিন ঋতুতে তেল ও গ্রিজের পরিমাণ যথাক্রমে ২ দশমিক ৬, ১ দশমিক ৯ ও ৫ দশমিক ৬। পানিতে তেল ও গ্রিজের আদর্শমান ০ দশমিক ০১। এ ছাড়া ফেনলের উপস্থিতি পাওয়া গেছে ০ দশমিক ১৪, ০ দশমিক ৪৩৫ ও ০ দশমিক ২, যা আদর্শমান ০ দশমিক ০০২। এ ছাড়া টোটাল সাসপেন্ডেবল সলিডস (টিএসএস) পাওয়া গেছে ১০৮, ৫৭ ও ১৯৫। পানিতে টিএসএস এর আদর্শ মান ১০। টিএসএস পানিতে দ্রবীভূত হয় না এবং পানির নিচে নদীর তলদেশে পাতলা আস্তরণ সৃষ্টি করে। যা জলজ উদ্ভিদের বিকাশে বাধা দেয়।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, শ্যামপুরে বুড়িগঙ্গার পানির দূষণ পরীক্ষা করে দেখার দরকার পড়ে না। পানির দিকে তাকালেই দেখা যায় রং গোলাপী। ডায়িং শিল্প বন্ধ চাই না, চাই টেকসই উন্নয়ন। আমরা চাই নদী আবার আগের রূপে ফিরে আসুক। ডাইং কারখানার বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা বন্ধ করতে হবে। কারখানাগুলোকে বর্জ্য শোধনাগার স্থাপন করতে হবে।

গবেষনায় দেখা যায় সরকারি প্রতিষ্ঠানই বুড়িগঙ্গা নদীতে বেশি দূষণ করছে। যদিও দখল-দূষণে বিপর্যস্ত বুড়িগঙ্গায় প্রাণবৈচিত্র্য ও স্বচ্ছ পানি ফিরিয়ে আনতে বিগত ২০১৭ সালে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নেয়া হয়। তারপর সরকারের বিভিন্ন সংস্থা থেকে একাধিক প্রকল্প নিয়ে ঢাকার এই প্রধান নদীকে দূষণ মুক্তির চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সরকারি সংস্থাগুলোই বুড়িগঙ্গা দূষণের সঙ্গে বেশি জড়িত। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সমীক্ষায় বুড়িগঙ্গা নদীর ঢাকা অংশে ৯৫টি দূষণের উৎস চিহ্নিত হয়েছে। তার মধ্যে ঢাকা ওয়াসা ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) দূষণের উৎসই ৫৯টি। পরিবেশবিদদের মতে, সাম্প্রতিক সময়ে বুড়িগঙ্গায় শিল্পদূষণ কমলেও সরকারি সংস্থার মাধ্যমে দূষণের মাত্রা অনেক বেড়েছে। সিটি করপোরেশনের বা ওয়াসার মাধ্যমে ঢাকার চারপাশের নদণ্ডনদী দূষণ দ্রুত বন্ধ করা জরুরি। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের উদ্যোগে পাঁচ বছর ধরে দেশের ৪৮টি প্রধান নদণ্ডনদীর ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। গত ডিসেম্বরে ওই সমীক্ষার কাজ শেষ হয়েছে। সমীক্ষায় পাওয়া তথ্যমতে, ২০১৯ সালের ২৮ এপ্রিল থেকে ২৮ জুন পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর সমীক্ষা পরিচালনা করেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা। ওই সমীক্ষায় বুড়িগঙ্গা নদীতে ২৫৩টি দূষণের উৎস চিহ্নিত হয়। দূষণের উৎসগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ঢাকা অংশে ৯৫টি উৎস থেকে বুড়িগঙ্গা দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে ৫৯টি উৎসই ঢাকা ওয়াসা ও ডিএসসিসির। দুটি সংস্থার মধ্যে ঢাকা ওয়াসার ৩০টি ও ডিএসসিসির ২৯টি উৎসের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা দূষিত হচ্ছে। বুড়িগঙ্গার ঢাকা অংশের বাকি ৩৭টি উৎসের মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) চারটি, শিল্পণ্ডকারখানার সাতটি, সংযুক্ত নদী ও খালের মাধ্যমে দুটি, কঠিন বর্জ্যরে স্তূপ ১২টি এবং বসতবাড়ি ও অন্যান্য উৎস ১২টি। সূত্র জানায়, হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্পকে একটা সময় বুড়িগঙ্গা দূষণের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হতো। শিল্পটি স্থানান্তরে ওই দূষণ এখন কমেছে। কিন্তু বুড়িগঙ্গা দূষণের তালিকায় এখন ঢাকা ওয়াসা ও ডিএসসিসির নাম বড় করে উঠে এসেছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়। যদিও জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে বারবার নদী দূষণকারী ব্যক্তি ও সংস্থাকে সতর্ক করা হচ্ছে। চিঠি দেয়া অব্যাহত রয়েছে। ঢাকা ওয়াসার সুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমেই মূলত বুড়িগঙ্গা দূষিত হচ্ছে। পাগলায় ওয়াসার একটি পয়ঃশোধনাগার আছে। সুয়ারেজ লাইনটা শুধু পাগলার লাইনের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেই হয়। কিন্তু ডিএসসিসি ও ওয়াসার সমন্বয়ের অভাবে তা করা হচ্ছে না। ফলে প্রতিনিয়ত পয়োবর্জ্য বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের নদণ্ডনদীতে পড়ছে। ঢাকা ওয়াসার বোর্ড সংশ্লিষ্টরাও তা স্বীকার করে জানান, সরকারি দুই সংস্থার মাঝে সমন্বয়ের অভাবে বুড়িগঙ্গা দূষণ কমানো যাচ্ছে না। একইভাবে কঠোর আইনি প্রয়োগ না থাকায়ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। নদীদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করতে পারে। কিন্তু সেটাও তো সরকারি সংস্থা। এক সরকারি সংস্থা কি আরেক সরকারি সংস্থার বিরুদ্ধে মামলা করবে? ফলে ঢাকা ওয়াসা, ডিএসসিসি, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সবার অবহেলায়ই বুড়িগঙ্গা পরিষ্কার করা সম্ভব হচ্ছে না। তবে এ চর্চা অব্যাহত রাখা নদীর জন্য সুখকর কোনো বার্তা নয়। প্রধানত সিটি করপোরেশনের স্লুইস গেট, খাল ও ড্রেনের পানি সরাসরি নদীতে পড়ে বুড়িগঙ্গা দূষিত করছে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ি থেকেও সরাসরি বুড়িগঙ্গায় বর্জ্য ফেলার অভিযোগ রয়েছে। এদিকে ডিএসসিসির মাধ্যমে বুড়িগঙ্গা দূষণের অভিযোগ মানতে নারাজ সংস্থাটির জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের। তার মতে, ডিএসসিসি বুড়িগঙ্গা দূষণ করছে না, বরং দূষণমুক্ত করার জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি বুড়িগঙ্গার আদি চ্যানেল পুনরুদ্ধার ও তাতে পানিপ্রবাহ দৃশ্যমান করার মতো চ্যালেঞ্জিং কাজ এর বড় প্রমাণ।’ অন্যদিকে সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘দূষণকারীর উৎসের তালিকায় বেসরকারি সংস্থার নাম থাকে এটা দেখে আমরা অভ্যস্ত। কিন্তু সে তালিকায় যদি সরকারি সংস্থার নাম থাকে, তাহলে কেবল তাদের সক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা যথেষ্ট নয়, বরং সদিচ্ছা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। যদি একটা দেশের আদালত নদীকে জীবন্ত সত্তা বলে ঘোষণা করেন, তাহলে সে দেশের সরকারি সংস্থা কি কোনো বিবেচনায় পারে নদী বা জলাশয় দূষণের মতো কার্যক্রমকে অব্যাহত রাখতে পারে।

এদিকে সরকার অনেকদিন থেকেই যমুনা নদী থেকে পরিষ্কার পানি এনে বুড়িগঙ্গাকে ধৌত করা হবে মর্মে একটি পরিকল্পনার কথা শোনা গিয়েছিল। নদী বাঁচতে হবে। তবে এখন পর্যন্ত বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।

তবে বুড়িগঙ্গার প্রাণ চাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে ৮.৫০ লাখ ঘনমিটার বর্জ্য উত্তোলন করেছে। নদী দূষণের উৎসমুখ বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। এ ছাড়া নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করতেও কয়েকবার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে। এত কিছুর পরও প্রাণ ফিরে পাচ্ছে না বুড়িগঙ্গা। দিন দিন এ নদীর দূষণ বেড়েই চলছে।

অন্যদিকে আইন করেও ঠেকানো যাচ্ছে না বুড়িগঙ্গা দূষণ। বুড়িগঙ্গা, তুরাগসহ দেশের সকল নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের আদেশে নদী হত্যাকে মানুষ হত্যার মতোই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। ফলে নদী দখল, ভরাট, নদী দূষণ ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য।‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদের মতে, মানুষ হত্যা করলে যে বিচার, নদী হত্যা করলে একই বিচার হবে। হাইকোর্টের এই নির্দেশনা মেনেই নদী রক্ষার আইন প্রণয়ন এবং পরিবর্তন করতে হবে। নদীর অস্তিত্ব বিনাশ করা নদী হত্যার শামিল অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় আইন সংশোধন করতে বলেছেন আদালত।

বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী এবং বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের ডিভিশন বেঞ্চ ওই রায় দেন। রায় বাস্তবায়নে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ১৭ দফা নির্দেশনাও দেয়া হয়। এসব নির্দেশনার মধ্যে ছিলো, হাইকোর্টের রায়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো, নদী দখল ও দূষণকারীদের একটি তালিকা করে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করা, নদী দখল ও দূষণকারীদের নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করা, বাংলাদেশ ব্যাংক নোটিস জারি করে সব ব্যংককে নদী দখল ও দূষণকারীদের ঋণ প্রদানে নিষেধাজ্ঞা আরোপ, নদী দখল ও দূষণের জন্য দায়ীদের অর্থেই নদী দখল ও দূষণমুক্তকরণ, নদী ও জলাধার সংক্রান্ত কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হলে নদী কমিশনের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক করণ এবং নদী রক্ষায় জাতীয় নদী কমিশন সব নদীর আইনগত অভিভাবক ঘোষণা। হাইকোর্টের এ আদেশ দ্রুত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে বলা হয় সরকারকে। কিন্তু চোখে পরে ভীন্ন চিত্র। হাইকোর্টের এই শক্ত রায়ের পরও যেন ক্রমশ মৃত্যুর দিকেই ধাবিত হচ্ছে ঢাকার প্রাণ বলে পরিচিত বুড়িগঙ্গা নদী। অনর্গল তরল বর্জ্য নিঃসরণে নদীটি পরিণত হচ্ছে নর্দমায়। বুড়িগঙ্গা তার খর স্রোতা রূপ হারিয়েছে নব্বইয়ের দশকেই। এটির পানিও আর ‘পানি’র সংজ্ঞায় পড়ে না। পরিণত হয়েছে বিষে। মাছ বিলুপ্ত হয়েছে বহু আগে। জীব বৈচিত্রও নেই। এ নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন প্রায় শূন্যের কোঠায়।

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী বসবাসের জন্য প্রতি লিটার পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি থাকা প্রয়োজন। অন্যদিকে দ্রবীভূত হাইড্রোজেনের মাত্রা কমপক্ষে ৭ মিলিগ্রাম থাকা উচিত। অথচ বুড়িগঙ্গা নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ ২ মিলিগ্রামের মতো। এ অবস্থায় বুড়িগঙ্গায় প্রাণের অস্তিত্ব টিকে থাকার সুযোগ একে বারেই কম। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ও ওয়ার্ক ফর বেটার বাংলাদেশের ডাব্লিউবিবি) যৌথ উদ্যোগে বুড়িগঙ্গা নদীর পানির দূষণমাত্রা পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে এ তথ্য।

প্রায় ৬২ রকমের রাসায়নিক বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে গেছে বুড়িগঙ্গার পানি। বাতাসে ছড়াচ্ছে দুর্গন্ধ। নদীর তলদেশে জমাট বেঁধেছে ৮ ফুট পুরু পলিথিনের স্তর। এর পানিতে অ্যান্টিবায়োটিকসহ হাসপাতালের বর্জ্যও মিশছে। বুড়িগঙ্গার দুই তীরের মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বুড়িগঙ্গার পানির রঙ এখন সবচেয়ে কালো। এই কালো পানির উৎকট গন্ধে নদীর পাড়ে দু-দন্ড দাঁড়ানো দায়। রাজধানী ঢাকার প্রাণরূপী বুড়িগঙ্গা এখন নগরবাসীর আবর্জনা ফেলার যেন ভাগাড়। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, বুড়িগঙ্গার বিষাক্ত পানি ও উৎকট গন্ধ থেকে আশপাশের এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে চর্মরোগ, শ্বাসকষ্টসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি আনেক বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীবাসীর পয়ঃবর্জ্য ও গৃহস্থালি বর্জ্য, ট্যানারিশিল্পের বর্জ্য, শিল্প-কারখানার বর্জ্য এবং নৌযানের বর্জ্য বুড়িগঙ্গা দূষণের অন্যতম কারণ। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, রাজধানী ঢাকায় পয়ঃবর্জ্যরে পরিমাণ প্রায় ১৩ লাখ ঘনমিটার। এসব বর্জ্য পরিশোধনের জন্য এক লাখ ২০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন ক্ষমতাসম্পন্ন পাগলায় ওয়াসার পরিশোধনাগার রয়েছে, যেখানে মাত্র ৫০ হাজার ঘনমিটার পরিশোধন করা হচ্ছে। বাকি ১২ লাখ ৫০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। ফলে নদীর পানির গুণগতমানের অবনতি, মাছ ও জলজ প্রাণীর ক্ষতি, শিল্প-বাণিজ্য, কৃষি ও গৃহস্থালি কাজে ব্যবহার অনুপযোগী এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email