April 28, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

মুক্তচিন্তা দুধভাত, ধর্মব্যবসা জিন্দাবাদ!

চিররঞ্জন সরকার : ভারতের প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশে’ নামক জনপ্রিয় চলচ্চিত্রটির কথা খুব মনে পড়ছে। হীরক রাজা ছিলেন প্রজানিপীড়ক এক শাসক। তার অত্যাচারে প্রজারা অতিষ্ঠ, জর্জরিত ছিল। হীরক রাজার দেশে হীরকের খনি থাকলেও প্রজারা না খেয়ে মারা যেত। তিনি সব সম্পদ রাজকোষে জমা রাখতেন। যত আকাল-অভাবই হোক না কেন, খাজনা বকেয়া রাখতে পারত না প্রজারা। যারা এসবের প্রতিবাদ করত, মগজধোলাইয়ের জন্য হীরক রাজা তাদের ‘যন্তরমন্তর’ ঘরে পাঠিয়ে দিতেন। বিজ্ঞানী সন্তোষ দত্ত (গবেষক গবুচন্দ্র জ্ঞানোতীর্থ জ্ঞানরত্ন জ্ঞানবুদ্ধি জ্ঞানোচূড়ামণি) উদ্ভাবিত সূত্র অনুসারে তাদের মগজধোলাই করা হতো। হীরক রাজার মন্ত্রীরা ছিল ক্রীড়নক। হীরক রাজার একমাত্র শত্রু ছিলেন উদয়ন পণ্ডিত। তিনি একজন স্কুলশিক্ষক। তিনি মূল্যবোধে বিশ্বাস করতেন। রাজা জোর করে তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেন। হিতোপদেশকে ফুৎকারে উড়িয়ে শিক্ষামন্ত্রী উদয়ন পণ্ডিতের পাঠশালায় ছাত্রদের আদেশ দিয়েছিল, ‘হীরক রাজের বচন শোনো।’ সে রাজ্যের মানুষ ভাগ্যবান, মস্তিষ্ক প্রক্ষালক যন্ত্র দিয়েও শেষ পর্যন্ত তাঁদের বশ করা যায়নি। কিন্তু আমাদের ভাগ্য ততটা ভালো না-ও হতে পারে। দেশজুড়ে রাজা, মন্ত্রী, পাত্রমিত্রদের বচনের বন্যা বইছে। আমরা, অভাগা দেশের নিরুপায় শ্রোতা, শুনছি শুধু শুনছি।
কথামৃতের অনর্গল ধারায় সম্প্রতি দু’ফোঁটা প্রজ্ঞা ঢেলেছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রামপালবিরোধীদের কঠোর সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সুন্দরবনের বাঘ নয়, দেশের মানুষের কথা ভাবুন। যারা রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরোধিতা করছে তাদের মানুষের জন্য কোনো দুঃখ নেই। তাদের চিন্তা সুন্দরবন ও বাঘের জন্য। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের সঙ্গে তাদের দেখা করে কথা বলা উচিত। তাদের জেনে নেওয়া উচিত যে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা।
প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পর ‘গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ভিন্নমত’ বিষয়ে আর কোনো আলোচনা চলে না। বিশেষজ্ঞ মতেরও আর কোনো দাম থাকে না। সবার সব মত, সব বিশ্লেষণ, সব সমীক্ষা মিথ্যে হয়ে যায়, প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ও বক্তব্যই একমাত্র সত্য হিসেবে টিকে থাকার দাবি করে!
প্রশ্ন আসে, এমন একটি বিশাল প্রকল্পের সম্ভাব্য বিপদ-ঝুঁকি-ক্ষতি নিয়ে তাহলে কি কথা বলা যাবে না? নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা যাবে না? তার জন্য সুন্দরবন গিয়ে বাঘেদের সঙ্গে দেখা করতে হবে, বাঘেদের সঙ্গে কথা কথা বলতে হবে? বাঘের ভাষা আয়ত্ত করতে হবে?
অথচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মুখেই মাত্র দুই বছর আগে আমরা ভিন্ন কথা শুনেছিলাম। ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সালে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বিশ্ব বাঘ পর্যালোচনা (স্টকটেকিং) সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, বাঘ না থাকলে সুন্দরবনের অস্তিত্ব থাকবে না। আর জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, সাইক্লোন, লবণাক্ত পানির প্রবেশ প্রভৃতি কারণে সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই বাঘসহ অন্যান্য জীব-বৈচিত্র্য সংরক্ষণের পাশাপাশি সুন্দরবন রক্ষায় বিশ্ব সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, সুন্দরবনকে রক্ষা করে বাঘ। আর ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করে সুন্দরবন। তাই বাঘ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে সরকার। তিনি বলেন, শুধু বাঘ রক্ষাই নয়, প্রাণীবৈচিত্র্যের বিপুল আধার হিসেবে সুন্দরবনকে রক্ষা করা জরুরি। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং জীব-পরিবেশের এক অনন্য নিদর্শন এই সুন্দরবন। এই বনভূমির ওপর প্রায় ১২ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভরশীল। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইক্লোন, লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশ ইত্যাদি বাঘ-মানুষের দ্বন্দ্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।
বাঘ রয়েছে এমন সব দেশের উদ্দেশ্যে শেখ হাসিনা বলেন, আসুন সকলে মিলে বাঘ বাঁচাই, প্রকৃতি বাঁচাই (ইত্তেফাক, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪)।
এখন প্রশ্ন হলো, আমরা প্রধানমন্ত্রীর কোন মন্তব্যকে মান্য করব? আগে যা বলেছিলেন? না সর্বশেষ যা বলেছেন?
দুই.
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানছে কিনা খুঁজে দেখতে পুলিশ বই পড়ে দেখবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলাকে ঘিরে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ইস্যুটি নিয়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা হৈ-চৈ হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, তবে কি সরকার বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে খুশি করার জন্য এমন গোপন কার্যক্রমের কথা প্রকাশ্যে জানাচ্ছে? আমাদের জানা মতে, অনেক আগে থেকেই পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ এ কাজটা করে থাকে। যে কাজ রুটিনওয়ার্ক এবং পুরনো রেওয়াজ, সেটিকেই যখন ফলাও করে প্রচার করা হয়, তখন উদ্বিগ্ন না হয়ে পারা যায় না। মাত্র কিছু দিন আগেই একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দাবি ও প্ররোচনার মুখে দেশের পাঠ্যপুস্তক থেকে প্রগতিশীল ভাবধারা সমৃদ্ধ বিষয়গুলোকে সুকৌশলে ও গোপনে বাদ দেওয়ার ঘটনা নিয়ে অনেক তোলপাড় হলো, সেই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই কোনো বই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব পুলিশকে দেওয়া হয়, তখন উদ্বিগ্ন না হয়ে আর পারা যায় না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে এমন বিষয়বস্তু নিয়ে বই প্রকাশের অভিযোগে গত বছর একুশে বইমেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, গ্রেপ্তার করা হয়েছিল তিনজনকে। ‘মুক্তচিন্তা দুধভাত, ধর্মব্যবসা জিন্দাবাদ’- সরকার কি তবে এই নীতিতেই পূর্ণ আস্থাশীল হয়ে উঠল? অতঃপর বইমেলার দায়িত্ব কি বাংলা একাডেমির পরিবর্তে ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে দেওয়া হবে?
পুনশ্চ : কবি মুজিব মেহদী ফেসবুকে লিখেছেন : ‘‘বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধান (প্রকাশকাল- ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দ, পরিমার্জিত সংস্করণ ২০০০)-এর ৯৭৮ পৃষ্ঠায় ‘মামদো’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে- ‘বাংলাদেশের লোক বিশ্বাস অনুযায়ী প্রেত যোনিপ্রাপ্ত মুসলমান, বা ইসলাম ধর্মাবলম্বী ভূত’। ‘মামদো’ শব্দটির উৎপত্তি দেখানো হয়েছে- ‘মুহাম্মদি’ শব্দ থেকে। সেই হিসেবে ‘মামদো ভূত’ হচ্ছে- ‘মুহাম্মদি ভূত’!
তাহলে কী স্বয়ং বাংলা একাডেমি ব্যবহারিক বাংলা অভিধানের নতুন সংস্করণ প্রকাশ করতে বাংলা একাডেমিকে এখন পুলিশের ‘অনুমতি’ নিতে হবে? তাহলে কী বাংলা একাডেমির ডিকশনারি মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দিচ্ছে? আর সেজন্য এখন পুলিশ কী স্বয়ং বাংলা একাডেমিকে অমর একুশে বইমেলায় নিষিদ্ধ করবে? ’’
এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে? বাংলা একাডেমি? পুলিশ? নাকি সরকার?

সূত্র : পরির্বতন

Print Friendly, PDF & Email