May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

ঢাকার ৪ নদীর বর্জ্যের উৎস ১৮৫টি

ডেস্ক : ঢাকার চারদিকে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বালু ও তুরাগ নদীর দূষণরোধে ১৮৫টি বর্জ্যের উৎসমুখ চিহ্নিত করেছে নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডবলিউটিএ)। এর মধ্যে রয়েছে ঢাকা ওয়াসার ৪৬টি। এসব উৎসমুখ দিয়ে ৬০ শতাংশ শিল্পবর্জ্য নদীতে পড়ছে। এছাড়া ইটভাটা, পলিথিন, ডকইয়ার্ড ও পোড়া মবিলসহ ৩০ শতাংশ কঠিন বর্জ্য ও ১০ শতাংশ নৌযান বর্জ্য দ্বারা ঢাকার চারদিকের নদীগুলো দূষিত হচ্ছে নৌ-মন্ত্রণালয়ের এক পরিসংখ্যানে উল্লেখ করা হয়েছে।
এই উৎসমুখগুলো বন্ধ ও নদীর নাব্য রক্ষায় নৌমন্ত্রী শাজাহান খানকে সভাপতি করে ২০০৯ সালে গঠন করা হয় টাস্কফোর্স কমিটি। এই কমিটি গত ৮ বছরে ৩৩টি বৈঠক করে একাধিক সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও ঢাকার চারদিকে এই ১৮৫টি বর্জ্যের উৎসমুখ বন্ধ করতে পারেনি। নদীগুলো দূষণ রোধে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি একাধিক পরিকল্পনা নেয়া হলেও অধিকাংশ পরিকল্পনা আলোর মুখ দেখেনি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।
তবে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী সমন্বয়ে ঢাকার নদীসমূহের দখল ও দূষণ রোধে একটি কর্মপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে বলে নৌ-মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। তাই চট্টগ্রাম কর্ণফুলী ও ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর দূষণ রোধ এবং নাব্য বৃদ্ধির জন্য গত ৫ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনকে চেয়ারম্যান করে একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করেছে। কমিটির কো-চেয়ারম্যান করা হয়েছে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও পানি সম্পদমন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে। এই কমিটি নদী দখল ও দূষণ রোধ করে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনার জন্য একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করবে বলে নৌ-মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়।
জানা গেছে, ঢাকার চারদিকে নদীগুলোতে প্রতিদিন শিল্পবর্জ্য, ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য, ট্যানারি বর্জ্য, পয়ঃনিষ্কাশন ও গৃহস্থালি বর্জ্য, ডকইয়ার্ডের লোহার মরিচা, সিমেন্ট-বালুমিশ্রিত পানি, পোড়া তেল-মবিল নদীতে ফেলার তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে খোলামুড়া-মীরকাদিম পর্যন্ত ১৮ দশমিক ৫ কিলোমিটার বুড়িগঙ্গা নদীর পানি অত্যন্ত দূষিত। এই নদীর বর্তমান প্রশস্ততা ২৩০-৩৪০ মিটার ও নাব্য ১২ ফুট। প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার টন আবর্জনা এবং ২২ হাজার লিটার বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য বুড়িগঙ্গা নদীতে নিষ্কাশন করা হচ্ছে।
এছাড়া নদীটির তলদেশে প্রায় ১০-১২ ফুট ঘনত্বের পলিথিনের স্তূপ জমা হওয়ায় প্রাকৃতিক উপায়ে স্বাভাবিক পদ্ধতিতে নদীর পানি বিশুদ্ধকরণ ব্যাহত হচ্ছে। এতে নদীটির পানি কালো বর্ণের এবং অত্যন্ত দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়ছে বলে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনীর একটি কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এতে উত্তরখান থেকে আশুলিয়া পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ টঙ্গী খাল ও আশুলিয়া থেকে খোলামুড়া পর্যন্ত ২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তুরাগ নদ অত্যন্ত দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তুরাগ নদ বর্তমানে টঙ্গী খাল হিসেবে পরিচিত।
বর্তমানে এর প্রশস্ততা ৪০-৮৫ মিটার ও নাব্য ৫-৬ ফুট। এছাড়া আশুলিয়া থেকে খোলামুড়া পর্যন্ত তুরাগ নদ নাব্যর দিক থেকে দু’ভাগে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫-৬ ফুট নাব্য আশুলিয়া-আমিনবাজার পর্যন্ত অংশটি মধ্যম ও আমিনবাজার-খোলামুড়া পর্যন্ত অংশটি ১২ ফুট ঊর্ধ্বে নাব্য হালকা দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তুরাগ নদের বর্তমান প্রশস্ততা ২২ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত। এই নদের তীরের ২৯টি শিল্পকারখানা হতে প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাত হাজার ১৫৯ কেজি শিল্পবর্জ্য তুরাগ নদে নিষ্কাশন করা হচ্ছে। এতে বুড়িগঙ্গা নদীর ন্যায় তুরাগ নদের পানিও কালো ও দুর্গন্ধযুক্ত হয়ে পড়েছে।
এছাড়া মীরকাদিম থেকে গোপচর পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার ধলেশ্বরী নদীটিও হালকা দূষিত চিহ্নিত করা হয়েছে। এই নদীর বর্তমান প্রশস্ততা ২৯০-৪২৫ মিটার ও নাব্য ১২ ফুট। তবে গোপচর থেকে কাচপুর পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার দীর্ঘ শীতলক্ষ্যা ও উত্তরখান থেকে ডেমরা পর্যন্ত ২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বালু নদটি উচ্চমাত্রায় দূষিত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে শীতলক্ষ্যা নদটি বর্তমান প্রশস্ততা ২০২-২৯৫ মিটার। নদটির নাব্য চিহ্নিত করা হয়েছে দু’ভাবে। এর মধ্যে ডেমরা-গোপচর পর্যন্ত নাব্য ১২ ফুট। আর ডেমরা-কাচপুর পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদের বর্তমান নাব্য ৫-৬ ফুট। এ নদের তীরে সিমেন্ট ফ্যাক্টরিসমূহের মাধ্যমে শীতলক্ষ্যা নদ প্রতিনিয়ত দূষিত হচ্ছে।
এছাড়া বালু নদটির বর্তমান প্রশস্ততা ৮৩-১৮০ মিটার ও নাব্য ৫-৬ ফুট। বাণিজ্যিক ও আবাসিক বর্জ্য ছাড়াও এই নদ দু’টিতে অপরিকল্পিত বালু উত্তোলনের ফলে স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলছে বলে নৌ-বাহিনীর এক কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এ ব্যাপারে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, নদীদূষণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। ঢাকা ওয়াসা ও বড় বড় প্রতিষ্ঠান নদীদূষণ করছে। অনেক শিল্প-কারখানা সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ইটিপি স্থাপন না করে সরাসরি নদীতে বর্জ্য ফেলছে। অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান ইটিপি থাকা সত্ত্বেও ব্যবহার করছে না।
নৌ-মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চার নদীতে প্রতিদিন প্রায় ৫০ হাজার মেট্রিক টন বিষাক্ত তরল ও কঠিন বর্জ্য পড়ছে। এসব বর্জ্যের ৬০ ভাগই ট্যানারি ও স্যুয়ারেজের, ৩০ ভাগ নানা শিল্প-কারখানার এবং বাকি ১০ ভাগ বর্জ্য অন্যান্য উৎসের। রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকাগুলোতে ছোট বড় মিলে প্রায় আড়াই লাখ শিল্প-কারখানা রয়েছে। এসব শিল্প-কারখানার ৯৯ ভাগেরই তরল বর্জ্যের পানি শোধনাগার নেই। ওই ইনস্টিটিউটের বুড়িগঙ্গার পানি পরীক্ষার রিপোর্টে ক্রোমিয়াম, নাইট্রেট, সিসা ও উচ্চ মাত্রায় পারদসহ ৬৮ প্রকার অপরিশোধিত রাসায়নিক পদার্থের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে। বুড়িগঙ্গার প্রতি লিটার পানিতে প্রায় দশমিক ৪৮ মিলিগ্রাম ক্রোমিয়াম রয়েছে। তবে পানিতে ক্রোমিয়ামের মাত্রা দশমিক ৫০ মিলিগ্রাম মিশ্রণ পানি পান করলেই মানুষ মারা যাবার সম্ভাবনার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।
বিআইডবিস্নউটিএ’র সূত্র জানায়, বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারদিকের নদীতে পলিথিন, শিল্প কারখানা এবং মানববর্জ্যের কারণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এসব বর্জ্যের কারণে বুড়িগঙ্গা নদীর তলদেশে প্রায় ১২ ফুট স্তর জমা পড়েছে। বুড়িগঙ্গার তলদেশের এসব বর্জ্য উত্তোলনের জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় করা হয়েছিল। কিন্তু বর্জ্য উত্তোলন করা হয়নি।
অন্য এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ শিল্পবর্জ্যের মধ্যে ৩৭-৪০ শতাংশ ট্যানারি ও ২০ শতাংশ কলকারখানার বর্জ্য। এছাড়া ১৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্য, ১৫ অন্যান্য বর্জ্য ও ১০ শতাংশ নৌযান বর্জ্য দ্বারা নদীগুলো দূষিত হচ্ছে। পরিবেশ অধিদফতর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বিআইডবলিউটিএ, ডিসিসিসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থা গত ১০ বছরে ৩৫ দফা অভিযান চালিয়েছে, উচ্ছেদ করা হয়েছে দখলবাজদের ছোট-বড় সাড়ে আট হাজার অবৈধ স্থাপনা। মামলা, গ্রেফতার, জরিমানাসহ নানা রকম শাস্তিও দেয়া হয়েছে দখলবাজদের। কিন্তু নদী দখল ও দূষণ ঠেকানো যাচ্ছে না বলে সংস্থাটির সূত্র জানায়।

Print Friendly, PDF & Email