April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

এমপি রানা কারাগারে

টাঙ্গাইল প্রতিনিধি : টাঙ্গাইলে মুক্তিযোদ্ধা ও জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক হত্যা মামলার পলাতক আসামী সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে পাঠিয়েছেন আদালত। রবিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সকালে এমপি রানা টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে হাজির হয়ে জামিন আবেদন করলে বিচারক আবুল মনসুর মিয়া তার জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

এসময় আসামিপক্ষে জামিন শুনানি করেন অ্যাডভোকেট আব্দুল বাকি মিয়া, অ্যাডভোকেট ফায়জুর রহমান, অ্যাডভোকেট খন্দকার ফায়েকুজ্জামান নাজিব, অ্যাডভোকেট শফিকুজ্জামান রিপন, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলসহ অনান্য আইনজীবী।

রাষ্ট্রপক্ষে জামিনের বিরোধীতা করেন এপিপি. মনিরুল ইসলাম খান। তাকে সহায়তা করেন বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট জোয়াহেরুল ইসলাম জোয়াহেরসহ অনান্য আইনজীবীরা।

শুনানির পর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী অতিরিক্ত পিপি অ্যাডভোকেট মুনিরুল ইসলাম বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদ হত্যার মূল নায়ক ছিলেন সাংসদ আমানুর রহমান খান রানা। আজ আদালতে গ্রেফতারকৃত দুই আসামি কিভাবে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে সেব্যাপারে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। এছাড়া আরও দুইজন প্রতক্ষ্যদর্শী তাদের বক্তব্য সমর্থন করেন। পরে বিজ্ঞ আদালত রাষ্টপক্ষ ও আসামি পক্ষের বক্তব্য শুনে আসামির জামিনের আবেদন খারিজ করে জেল হাজতে পাঠিয়ে দেন। অপরদিকে চার্জশিট দিয়ে দেওয়ায় এখন আর রিমান্ডের কোনও সুযোগ নেই। আর আসামিপক্ষের থেকে পূনঃতদন্তের আবেদন করে দরখাস্ত দেওয়া হলেও এই ব্যাপারে আইনগত কোনও ভিত্তি নেই।’

এদিকে সাংসদ রানাকে জেলহাজতে পাঠানোর পর আসামির পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আব্দুল বাকি মিয়া জানান, সাংসদ রানা ও তার ভাইয়েদের বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনও সুস্পষ্ট ভিত্তি নেই। দুই আসামির বক্তব্য ছাড়া এখানে আর কোনও প্রমাণ নেই। আর দুই আসামিকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে টর্চার করে এই বক্তব্য রেকর্ড করে। পরে তাদের যখন জেলহাজতে পাঠানো হয় তখন তারা তাদের বক্তব্য অস্বীকার করে। আর দুইজন আসামী তাদের বক্তব্য অস্বীকার করায় অন্য আসামিদের বক্তব্যও এমপি রানার বিরুদ্ধে যাবে না বলে আমরা দাবি করি।’

এদিকে সাংসদকে কারাগারে পাঠানোর পর মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমেদের স্ত্রী ও মামলার বাদী নাহার আহমেদ বলেন, ‘আমার স্বামীকে হত্যার পর আমি কারো নাম উল্লেখ করে মামলা করিনি। পুলিশি তদন্তে খান পরিবারের জড়িত থাকার কথা বেড়িয়ে এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের সঙ্গে আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও আমাদের এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেছেন এই মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালে নেওয়া হবে।’

এর আগে গত ৩ ফেব্রুয়ারি এই মামলায় ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে ৩০২/৩৪/১২০ বি ধারায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও টাঙ্গাইল গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ গোলাম মাহফীজুর রহমান। আসামিরা হলেন- টাঙ্গাইল-৩ (ঘাটাইল) আসনের সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা ও তার তিনভাই টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সহিদুর রহমান খান মুক্তি, জেলার সাবেক ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান খান কাকন ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা। আরও রয়েছেন- কবির হোসেন, সাবেক কমিশনার মাসুদ মিয়া, চাঁনে, নুরু, সানোয়ার হোসেন ও দাত ভাঙ্গা বাবু, আনিসুল ইসলাম রাজা, মোহাম্মদ আলী, ফরিদ মিয়া, সমির। এর মধ্যে আনিসুল ইসলাম রাজা, মোহাম্মদ আলী, ফরিদ মিয়া, সমির টাঙ্গাইল জেলহাজতে রয়েছে। আর বাকিরা পলাতক। তাদের মধ্যে এমপি রানা আজ হাজিরা দেন।

পরে গত ৬ এপ্রিল আদালত মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণ করে পলাতক আমানুরসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। ১৭ মে এই ১০ জনের বিরুদ্ধে হুলিয়া ও মালামাল জব্দ করার নির্দেশ দেন আদালত। ২০ মে পুলিশ সাংসদ ও তার তিন ভাইয়ের বাড়িতে অভিযান চালিয়ে মালামাল জব্দ করে, তবে সেখানে উল্লেখযোগ্য কিছু ছিল না। সর্বশেষ ১৬ জুন আদালত আসামিদের হাজির হওয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার নির্দেশ দেন। সাংসদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির বিষয়টি চিঠি দিয়ে জাতীয় সংসদের স্পিকারকে জানানো হয়।

গোয়েন্দা পুলিশ সূত্র জানায়, ২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি রাতে শহরের কলেজপাড়া এলাকার নিজ বাসার কাছ থেকে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মুক্তিযোদ্ধা ফারুক আহমদের গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করা হয়। ঘটনার তিন দিন পর ফারুকের স্ত্রী নাহার আহমেদ বাদি হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে টাঙ্গাইল সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন।

২০১৪ সালের ১১ আগস্ট শহরের বেবিস্ট্যান্ড এলাকা থেকে ফারুক আহমদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয় আনিসুল ইসলাম রাজাকে। একই অভিযোগে মোহাম্মদ আলী নামে আরও একজনকে গোয়েন্দা পুলিশ গত ২৪ আগস্ট গ্রেফতার করে। তারা দু’জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তাদের জবানবন্দিতে উল্লেখ করা হয়, মুক্তিযোদ্ধা ফারুক হত্যাকাণ্ডে টাঙ্গাইলের প্রভাবশালী খান পরিবারের চার ভাই সংসদ সদস্য আমানুর রহমান খান রানা, ব্যবসায়ী নেতা জাহিদুর রহমান কাকন, টাঙ্গাইল পৌরসভার সাবেক মেয়র সহিদুর রহমান খান মুক্তি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি সানিয়াত খান বাপ্পা জড়িত রয়েছে।

পুলিশ সূত্রে আরও জানা যায়, আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে আসামি রাজা জানিয়েছে, ঘটনার দিন (২০১৩ সালের ১৮ জানুয়ারি) এমপি রানা রাজাকে দায়িত্ব দেন ফারুক আহমদকে আওয়ামী লীগ অফিস থেকে কলেজ পাড়ায় তার একটি প্রতিষ্ঠানে ডেকে আনার জন্য। আওয়ামী লীগ অফিসে যাওয়ার সময় পথেই রাজার সঙ্গে ফারুক আহমদের দেখা হয়। রাজা তখন নিজের রিকশা ছেড়ে ফারুক আহমদের রিকশায় ওঠেন এবং তাকে এমপি রানার প্রতিষ্ঠানে নিয়ে যান। পরবর্তী সময় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হওয়া নিয়ে ফারুক আহমদের কথা হয়। এক পর্যায়ে ফারুক আহমেদকে ওই পদে প্রার্থী না হওয়ার অনুরোধ করেন। ফারুক আহমদ এতে রাজি হননি। এ বিষয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে ফারুক আহমেদ সেখান থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে  পেছন থেকে তাকে গুলি করা হয়। এতে অন্যরা তার মুখ চেপে ধরেন। তার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর প্রভাবশালী নেতার নির্দেশে সেখানকার রক্ত মুছে ফেলা হয়। পরে একটি অটোরিকশায় ফারুক আহমদের মরদেহ নিয়ে আসামি রাজাসহ দু’জন দু’পাশে বসেন এবং ফারুক আহমদের বাসার কাছে ফেলে রেখে আসেন।

Print Friendly, PDF & Email