May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

জামালপুরের তিন রাজাকারের ফাঁসি

আদালত প্রতিবেদক : একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামালপুরের তিন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এছাড়া পাঁচজনের আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেরর চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায় ঘোষণা করেন।

ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- মো. আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান ও মো. আব্দুল বারী। এরা তিনজনই পলাতক।

আমৃত্যু কারাদণ্ডাদেশ প্রাপ্তরা হলেন- অ্যাডভোকেট শামসুল আলম, এসএম ইউসুফ আলী, অধ্যাপক শরীফ আহমেদ ওরফে শরীফ হোসেন, মো. হারুন ও মো. আবুল কাসেম।

এ পাঁচজনের মধ্যে কেবল শামসুল আলম এবং এসএম ইউসুফ আলী কারাগারে। বাকিরা পলাতক।

প্রসিওকিউটর তুরিন আফরোজ জানিয়েছেন, এই আটজনের বিরুদ্ধে যে পাঁচটি অভিযোগ আনা হয়েছিল তার মধ্যে তিনটি অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

আট আসামির বিরুদ্ধে যে পাঁচ অভিযোগ আনা হয়েছিল

প্রথম অভিযোগ: শান্তি কমিটির পরামর্শ ও নির্দেশনায় পাক হানাদার বাহিনী ও স্থানীয় আল-বদর বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতে ইসলামীর নেতা ও শান্তি কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট শামসুল হক ও এস এম ইউসুফ আলীর অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় ১৯৭১ এর ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত জামালপুরে গণহত্যা চালায়। ওই সময় তারা স্বাধীনতাকামী এক হাজার লোককে হত্যা করে। এ ঘটনায় শামসুল হক ও ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি।

দ্বিতীয় অভিযোগ: আসামি আশরাফ হোসেন, শরীফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান, হারুন ও আব্দুল বারী মুক্তিযুদ্ধকালীন ৭ জুলাই থেকে ১৪ জুলাই এবং ২২ জুলাই জামালপুরের সরিষাবাড়ী থানার মইষ ভাদুরিয়া ও ধূপদহ গ্রামের শহীদ আব্দুল হামিদ মোক্তারের বাড়ি, মো. সাইদুর রহমান ভূঁইয়ার বাড়ি, আমির আলী খানের বাড়ি, পিটিআই হোস্টেলের টর্চার ক্যাম্প ও জামালপুর শ্মশানঘাটে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে। এ ঘটনায় শরীফ হোসেন, মো. আশরাফ হোসেন, মো. আব্দুল মান্নান, মো. আব্দুল বারী ও হারুনের বিরুদ্ধে অপহরণ, নির্যাতন, হত্যা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ আনা হয়।

এ অভিযোগে আশরাফ হোসেন, মো. আব্দুল মান্নান, মো. আব্দুল বারীর মৃত্যুদণ্ড এবং শরীফ হোসেন, হারুনকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

তৃতীয় অভিযোগ: মুক্তিযুদ্ধকালীন ১০ জুলাই আসামি শরীফ আহমেদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাসেম, শামসুল হক, ইউসুফ আলী ও স্থানীয় আল-বদর বাহিনী ও শান্তি কমিটির সদস্যরা জামালপুরের সিঅ্যান্ডবি রোডের (পুরাতন) দয়াময়ী লেনের মল্লিক ভিলা থেকে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠন শহীদ নুরুল আমীনকে অপহরণ করে। তারপর ওইদিন সকাল ১০টায় তার মরদেহ ব্রহ্মপুত্র নদের চ্যাপতলা ঘাটে ভেসে ওঠে। এ ঘটনায় শরীফ হোসেন, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী,আবুল হাশেম, শামসুল হক, ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে অপহরণ ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগে প্রত্যেকের আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে।

চতুর্থ অভিযোগ: জামালপুরে আশরাফ হোসেনের নেতৃত্বে বদর বাহিনী গঠিত হয়, তিনি সে সময় জামালপুর মহকুমার ছাত্র সংঘের সভাপতি ছিলেন। জামালপুরের আশেক মাহমুদ ডিগ্রি কলেজকে সে সময় নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হতো, যার প্রধান ছিলেন আশরাফ হোসেন। আসামি শরীফ আহমেদ, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারীসহ অন্যদেরও সেখানে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামিরা সেখানে অনেককে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যা করেছে। এ ঘটনায় আশরাফ হোসেন, শরীফ হোসেন, আব্দুল মান্নান ও আব্দুল বারীর বিরুদ্ধে আটকে রেখে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগে আটজনেরই আমৃত্যু কারাদণ্ড হয়েছে।

পঞ্চম অভিযোগ: মুক্তিযুদ্ধকালীন ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আসামি শরীফ আহমেদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাসেম, শামসুল হক ও ইউসুফ আলী এবং স্থানীয় আল বদর বাহিনীর সদস্য ও পাক হানাদাররা জামালপুরের পিটিআই হোস্টেলকে নির্যাতন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। সেখানে নিরস্ত্র মানুষকে আটকে রেখে নির্যাতন করা হতো এবং রাতে তাদের ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে শ্মশান ঘাটে নিয়ে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হত। এ অভিযোগে আসামি শরীফ হোসেন, আশরাফ হোসেন, আব্দুল মান্নান, আব্দুল বারী, আবুল হাশেম, শামসুল হক, ইউসুফ আলীর বিরুদ্ধে আটকে রিখে নির্যাতন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয়। এ অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি।

গত বছরের ২৬ অক্টোবর এই আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ট্রাইব্যুনাল। আসামিদের বিরুদ্ধে আনা ৯২ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধকালীন হত্যা, গণহত্যা, আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও গুমের সুনির্দিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের পাঁচটি অভিযাগ আনা হয়। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে ১৯৬ পৃষ্ঠার দালিলিক প্রমাণ এবং ৪০ জন সাক্ষী ছিলেন। অভিযুক্তদের অপরাধ সংঘটনের সময়কাল ১৯৭১ সালের ২২ এপ্রিল থেকে ১১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ধরা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email