May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

হুমকির মুখে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ‘ভিতরগড় দূর্গনগরী’

পঞ্চগড় প্রতিনিধি : ‘ভিতরগড় দূর্গ নগরী’ শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি অংশ। দেশে এ পর্যন্ত পাওয়া দূর্গনগরীর মধ্যে এটিই সবচেয়ে বড়। অথচ অবৈধ নানা স্থাপনায় বর্তমানে হুমকির মুখে প্রাচীন সভ্যতার এ পুরাকীর্তি।

ভিতরগড় দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড় শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নের ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় প্রায় ২৫ বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে অবস্থিত। প্রাচীন এ দূর্গনগরীর মাটির নিচে লুকিয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার নানা ইতিহাস, অসংখ্য স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ এবং মূল্যবান প্রত্নবস্তু। মাটি খুঁড়লেই বেরিয়ে আসছে দুর্লভ সব প্রাচীন স্থাপনা।

২০০৮ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান নিজ উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের নিয়ে এ দূর্গনগরীতে গবেষণা ও খনন কাজ শুরু করেন। প্রথম পর্যায়ে কয়েক দফা খননে বেরিয়ে আসে বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসহ ছয়টি প্রাচীন স্থাপনা।

ভিতরগড়ে মাটি খনন করে গত বছর আরও দুটি প্রাচীন মন্দিরের মতো স্থাপনার সন্ধান পেয়েছেন ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) গবেষকরা। ধারণা করা হচ্ছে, নতুনভাবে সন্ধান পাওয়া এসব স্থাপনা অষ্টম শতকে প্রাচীন ভারতীয় বাস্তুশাস্ত্র অনুসরণ করে নির্মিত।

এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত আটটি স্থাপনার ভিত্তি কাঠামো থেকে লাল ও ধূসর রঙের নকশা খচিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ, লোহা ও তামার  তৈরি জিনিসপত্র পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রের মধ্যে রয়েছে থালা, বাটি, রান্নার হাঁড়ি  ও মাটির প্রদীপ। খননের পর ওই স্থাপনাগুলি আবার প্রত্নতাত্ত্বিক কায়দায় মাটি দিয়ে ঢেকেও দেওয়া হয়।

চারটি আবেষ্টনী দেয়াল দিয়ে পরিবেষ্টিত ভিতরগড় দূর্গনগরী বাংলাদেশে অদ্বিতীয়। এখানে আবিষ্কৃত স্তম্ভবিশিষ্ট বারান্দা সম্বলিত স্তূপটি বাংলাদেশে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত একমাত্র স্থাপত্য নিদর্শন। ভিতরগড়েই রয়েছে চাষাবাদের জন্য সেচ ব্যবস্থা ও নদীর পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য পাথরের বাঁধ নির্মাণের নৈপুণ্য কৌশলের অনন্য উদাহরণ।

এ দূর্গনগরীর অভ্যন্তরেই রয়েছে মহারাজা দিঘি। মহারাজা দিঘির ইট বাঁধানো দশটি ঘাট এবং ঘাটের উভয় পাশে ইট ও মাটি দিয়ে নির্মিত সুউচ্চ পার নৈসর্গিক  দৃশ্যের অসাধারণ নিদর্শন। ভিতরগড় দূর্গনগরীর বাইরের আবেষ্টনীর উত্তরাংশ, উত্তর-পশ্চিমাংশ এবং উত্তর-পূর্বাংশ বর্তমানে ভারতের জলপাইগুড়ি জেলার অন্তর্গত হওয়ায় ধারণা করা হয়, ষষ্ঠ শতকের শেষে কিংবা সপ্তম শতকের শুরুতে ভিতরগড় একটি স্বাধীন রাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

আরো ধারণা করা হয়, প্রাচীন বাণিজ্য সড়ক ও নদীপথের ওপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসীরা সম্ভবত নেপাল, ভূটান, সিকিম, আসাম, কুচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার, এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সাথে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল।

ভিতরগড় প্রত্নস্থল মূলত চারটি আবেষ্টনী নিয়ে গঠিত। এ আবেষ্টনীগুলো একটি অপরটির ভিতরে অবস্থিত। প্রতিটি আবেষ্টনীই আবার বাইরের দিকে সুগভীর পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত। বাইরের আবেষ্টনীটি পরিখার মাটি দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এর অভ্যন্তরে রয়েছে আরেকটি সুউচ্চ মাটির আবেষ্টনী।

তবে এখানে কিছু কিছু অংশে ইটের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ভিতরের দুটি আবেষ্টনী পুরোটাই ইট দিয়ে তৈরি। ভিতরের এ দুটি আবেষ্টনীর দেয়াল সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে দেয়ালের সাথে আয়তাকৃতির বুরুজ সংযোজিত হয়েছে।

ভিতরগড় প্রত্নস্থলের চারটি আবেষ্টনী ও পরিখা আজও কালের সাক্ষী হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। দ্বিতীয় আবেষ্টনীর উত্তর বাহুতে কালদুয়ার এবং দক্ষিণ বাহুতে যমদুয়ার নামে দুটি প্রবেশ দ্বারের কথা লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে।

পরিখা দ্বারা পরিবেষ্টিত চারটি এ আবেষ্টনীর ভিতরে ছড়িয়ে আছে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন স্বরূপ অসংখ্য ধর্মীয় স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ এবং মূল্যবান প্রত্নবস্তু। পাথরঘাটা ও দোমনী নামক স্থানে শালমারা নদীর ওপর পাথর দিয়ে নির্মিত বাঁধ দুটি প্রাচীন কালে নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ এবং সারা বছর পানি ধারণের ব্যবস্থা সৃষ্টির এক উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।

এরই মধ্যে সুপরিকল্পিত প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে প্রথম আবেষ্টনীর ভিতরে তিনটি, দ্বিতীয় আবেষ্টনীর ভিতরে তিনটি এবং তৃতীয় আবেষ্টনীর ভিতরে দুটি স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ আবিস্কৃত হয়েছে। বর্তমানে ভিতরগড় প্রত্নস্থলের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত তালমা ও শালমারা নদী এবং প্রাচীন দশটি দিঘি ভিতরগড় প্রত্নস্থলের সৌন্দর্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।

মহারাজার দিঘি, ফুলপুকুরী, কোদাল ধোয়া, মলানী, বাঘপুকুরী ও ঝলঝলি নামে পরিচিত প্রাচীন এ দিঘিগুলোকে ঘিরে রচিত হয়েছে অসংখ্য কিংবদন্তি। এ দিঘিগুলোর মধ্যে মহারাজার দিঘি সবচেয়ে বড়। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, পৃথু রাজা কীচক নামে অসাধু নিম্নবর্ণের জনগোষ্ঠী দ্বারা আক্রান্ত হলে পবিত্রতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য পরিবার নিয়ে এ দীঘিতে আত্মহত্যা করেন। এর ফলে পৃথু রাজার রাজত্বের অবসান ঘটে। তবে বাংলার ইতিহাসে পৃথু রাজা বা তার রাজ্য ভিতরগড় সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না।

প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়ে গবেষণার জন্য এখানে রয়েছে পর্যাপ্ত উপাদান। এ দূর্গনগরীর প্রতিটি স্থানেই রয়েছে ইতিহাসের ছাপ। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এসব প্রত্নসম্পদ অবহেলা আর উদাসীনতায় হুমকির মুখে পড়েছে। ভিতরগড় দূর্গনগরীর অমূল্য প্রত্নসম্পদ ও বহু প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন স্থানীয় মানুষের হাতে বিলীন হওয়ার পথে। এটি প্রত্নসম্পদের বিশাল ভাণ্ডার হলেও পুরাকীর্তি আইনের আওতায় সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়নি।

স্থানীয় অধিবাসী, স্যালিলান টি এস্টেট ও এসিআই গোদরেজ পোলট্রি ফার্মসহ কয়েকটি কোম্পানির হাত থেকে ভিতরগড়কে রক্ষা করার জন্য ‘হিউম্যান রাইটস এ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ’র পক্ষে ভিতরগড় রক্ষায় নির্দেশনা চেয়ে ২০১১ সালের ১৪ জুন উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদন করেন অ্যাড. মনজিল মোরশেদ।

এ আবেদনের প্রেক্ষিতে ভিতরগড় দূর্গনগরীকে কেন প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হবে না মর্মে একটি রুল জারি করেন আদালত। একই সাথে ভিতরগড়  প্রত্নসীমার ২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সব ধরণের নির্মাণ কাজ বন্ধ ও স্থগিত রাখারও নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ওই এলাকায় সব ধরণের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়।

কিন্তু আদালতের আদেশ অমান্য করে প্রশাসনের সামনেই তৈরি হয়েছে টোকাপাড়া বিজিবি ক্যাম্প। গড়ে ওঠেছে স্যালিলান টি  এস্টেটসহ প্রত্নসম্পদ ধ্বংসকারী একাধিক চা বাগান। এছাড়াও মাজার ও দোকানপাটসহ নতুন নতুন স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। স্থানীয় অসচেতন ব্যক্তিরা দূর্গনগরীর আবেষ্টনী কেটে মূল্যবান প্রত্নসম্পদ নষ্ট করে জমি তৈরি করছে। নতুন আরেক সমস্যার নাম পাথর উত্তোলন। সমতল ভূমি অপরিকল্পিতভাবে খনন করার মাধ্যমে নষ্ট হচ্ছে অসংখ্য প্রত্নসম্পদ।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিন বলেন, “আমরা ভিতরগড়ের প্রত্নসম্পদ রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে শহর দূরে হওয়ায় দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সমস্যায় পড়তে হয়। শুধু প্রশাসনের একার পক্ষে এটি সংরক্ষণ সম্ভব নয়। স্থানীয় জনগণের সচেতনতাই পারে ভিতরগড়কে রক্ষা করতে।”

তিনি আরও বলেন, “সরকার যদি ভিতরগড়কে পুরাকীর্তি প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা করে এবং একজন প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকর্তা  নিয়োগ করে তাহলে এ প্রত্নসম্পদকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। তবে আদালতের নির্দেশ অমান্য করে গড়ে ওঠা স্থাপনাগুলোর ব্যাপারে শিখগিরই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের (ইউল্যাব) অধ্যাপক ও ভিতরগড় খনন কাজের উদ্যোক্তা ড. শাহনাজ হুসনে জাহান বলেন, “অপার সম্ভাবনাময় এ ভিতরগড় দূর্গনগরী শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় ইতিহাস নির্মাণে প্রয়োজনীয় ঐতিহাসিক উৎস সরবরাহের ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে। পর্যটন শিল্পের জন্য এটি হতে পারে বাংলাদেশের প্রত্ন নিদর্শনের বিশাল এক ভাণ্ডার।

আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেন, “ব্যাপক সম্ভাবনাময়ী ও  ইতিহাস ঐতিহ্যের এ প্রত্নস্থল বিলীন হয়ে যাচ্ছে। মানা হচ্ছে না আদালতের নির্দেশ। স্থানীয় প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাবে ভিতরগড় প্রত্নসীমায় গড়ে উঠছে একাধিক  প্রত্নসম্পদ ধ্বংসকারী স্থাপনা।”

তিনি অবিলম্বে সরকারের কাছে ভিতরগড়ের প্রত্নতত্ব সম্পদ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এবং  ভিতরগড়কে হ্যারিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণার দাবি জানান।

ভিতরগড়ের প্রত্নসম্পদ রক্ষায় চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রত্নতাত্ত্বিক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান। ইউল্যাবের এ প্রত্নতাত্ত্বিক ভিতরগড়কে একটি প্রত্নতাত্ত্বিক পর্যটন নগরী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, “ভিতরগড় দূর্গনগরীকে হ্যারিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হলে কমিউনিটি ট্যুরিজমের ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ যেমন প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস জানতে পারবে তেমনি পর্যটন শিল্প সমৃদ্ধ হবে।”

Print Friendly, PDF & Email