April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

পলাতক আসামি আব্দুল মজিদকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৩

ডেস্ক: একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক আসামি আব্দুল মজিদকে মাদারীপুর থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৩।

র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে মাদক, অস্ত্র, জঙ্গিসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর শাহজাহানপুরে টিপু হত্যা, বহুল আলোচিত বিশ^জিৎ হত্যা, পলাতক মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত বাউল মডেল, কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে গলা কেটে অটোরিকশা চালক হত্যা, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন ও বিভিন্ন মামলায় দীর্ঘদিনের পলাতক আসামিদের প্রতিনিয়ত আইনের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণের প্রশংসা ও আস্থা অর্জন করেছে। এছাড়াও বিগত দিনগুলোতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের বিরুদ্ধে ২৭০ টি অভিযান পরিচালনা করে ৩০৭ জন আসামি গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

আসামির বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের সাতটি অভিযোগ আনা হয়। ১৯৭০ সালে গঠিত জামায়াত ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটি কর্তৃক ঘোষিত তালিকা মোতাবেক ধৃত আসামি মজিদ পূর্বধলা থানা জামায়াত ইসলামীর সাংগঠনিক সম্পাদক ছিল। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী এবং পাকিস্তানি হানাদারদের দোসর হিসেবে গঠিত ঘৃণ্য রাজাকার বাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশের আপামর জনতার উপর চলে অমানবিক ও পৈশাচিক নির্যাতন। ধৃত আসামি মজিদ রাজাকারদের প্রধান বাহিনী আল-বদর পুর্বধলা রামপুর থানা কমিটির প্রধান ছিল। পুর্বধলা রামপুর মৌদাম গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকসহ তার আপন দুই ভাই এবং পাঁচজন চাচাতো ভাই মিলে একই বাড়িতে মোট সাতজন মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণের পাশাপাশি এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করত। এজন্য আল-বদর কমিটির প্রধান আব্দুল মজিদের শত্রæতে পরিণত হয় তারা। ১৯৭১ সালে ২১ আগস্ট দুপুরে আব্দুল মজিদ তার দলবল নিয়ে বাড়হা গ্রামের আব্দুল খালেকের বাড়িতে আক্রমন করে। সে সময় বাড়িতে অবস্থানরত আব্দুল খালেকসহ মুক্তিবাহিনীর সকলকে এক এক করে আসামী ও তার সহযোগিরা নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। হত্যার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেকের লাশটি পার্শ¦বর্তী কংস নদীতে ফেলে দেয় তারা এবং অপরাপর মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ কোকখালী নদীতে বস্তাবন্দি করে ফেলে দিয়ে আসে। এই হত্যাকান্ডের পাশাপাশি তারা আব্দুল খালেকের বাড়িতে লুটপাট চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনায় মৃত আব্দুল খালেকের ভাই আব্দুল কাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে কোন রকমে প্রাণ বাঁচায়।

পরবর্তীতে ২০১৪ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আব্দুল মজিদসহ ০৪ জনকে আসামী করে মামলা দায়ের করে আব্দুল কাদের। পরবর্তীতে মামলার গভীর তদন্তে আরও তিন জনের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে এবং আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত সাতটি অভিযোগই প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমানিত হলে ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কর্তৃক মোট সাতজন আসামীর বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডের রায় প্রদান করা হয়। এটি মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের মামলায় ৩৬তম রায়। বিচার চলাকালে এই মামলার দুইজন আসামি (আহম্মদ আলী ও আব্দুর রহমান) মারা যায় এবং রায় হওয়ার পর পলাতক অবস্থায় মারা যায় আরও দুই আসামি (রদ্দিন মিয়া ও আব্দুস সালাম বেগ)। উক্ত মামলার আরও দুইজন আসামি (আব্দুল খালেক তালুকদার ও কবির খাঁ) বর্তমানে পলাতক রয়েছে। এদিকে মামলাটির বিচারিক প্রক্রিয়া চলমান থাকাকালীন ২০১৫ সালে আব্দুল মজিদ তার নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে এবং ফকিরাপুল এলাকায় কিছুদিন আত্মগোপনে থাকে। এরপর তার আত্মীয়ের সহযোগিতায় মাদারীপুরে গিয়ে আত্মগোপন করে একটি কামিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে পলাতক জীবন শুরু করে। ২০১৫ সাল থেকে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়া চলাকালীন সে কখনই আদালতে হাজিরা দেয়নি।

এরই ধারাবাহিকতায় গত রাতে র‌্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল মাদারীপুর জেলার মাদারীপুর সদর এলাকা হতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক আসামি মোঃ আব্দুল মজিদ (৮০), পিতা-মৃত মিরাজ আলী, সাং-পূর্ব মৌদাম, থানা-পূর্বধলা, জেলা-নেত্রকোনাকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

ধৃত আসামি মজিদ ১৯৬৮ সাল থেকে জামায়াত ইসলামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। ১৯৭০ সালে ঘোষিত কমিটিতে সে পূর্বধলা থানা জামায়াত ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে পদায়িত হয়। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন রাজাকার বাহিনীর পূর্বধলা আল-বদর থানা কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। সে সময় আব্দুল মজিদ প্রচন্ড মাত্রায় হিং¯্র হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যোগসাজসে সে তার দল নিয়ে অত্র থানার বিভিন্ন গ্রামে অসংখ্য বাড়িতে হামলা চালিয়ে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী কার্যক্রম চালায়। পূর্বধলা থানার মুক্তিবাহিনী মজিদ ও তার দলের অত্যাচারে অতিষ্ট ছিল। এভাবেই সে ১৯৭১ সালে ২১ আগস্ট আব্দুল খালেকের বাড়িতেও হামলা চালিয়ে নৃশংসভাবে গুলি করে আব্দুল খালেক ও তার সহযোগী ০৯ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করে। এছাড়াও মুক্তিযুদ্ধ শেষ না হওয়া অবধি অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধাদের শারীরিকভাবে অত্যাচার করার জন্য পাকিস্তানি হানাদারদের সাথে হাতে হাত মিলিয়ে এই মজিদ পূর্ব মৌদাম গ্রামে একটি মুক্তি কয়েদখানা গড়ে তোলে। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতনপূর্বক নৃংশসভাবে হত্যা করত মজিদ রাজাকার।

২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে চলমান মামলার শুনানিতে হাজিরা না দেওয়ায় আব্দুল মজিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। এর পরপরই আব্দুল মজিদ তার নিজ এলাকা ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে এবং ফকিরাপুল এলাকায় কিছুদিন আত্মগোপনে থাকে। এরপর তার আত্মীয়ের সহযোগিতায় মাদারীপুরে গিয়ে আত্মগোপন করে সেখানে একটি কামিল মাদ্রাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে পলাতক জীবন শুরু করে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার এড়াতে সে নিয়মিত বাসা পরিবর্তন করত। এসময় পরিবারের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে সে অন্যের রেজিস্ট্রেশনকৃত সীমকার্ড দিয়ে মোবাইল ফোন ব্যবহার করত। সে এবং তার ছেলে-মেয়েরা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল হওয়ায় প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণের জন্য তারা নিয়মিত তাকে অর্থ প্রদান করত। আত্মগোপনে থাকাকালে সে সাধারণত জনসমাগম স্থান, বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান ছাড়াও তার ব্যক্তিগত পরিচয় প্রকাশ পায় এমন স্থান এড়িয়ে চলত।

গ্রেফতারকৃত আসামীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। প্রেস বিজ্ঞপ্ত।

Print Friendly, PDF & Email