April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

জয়পুরহাট মুক্ত দিবস আজ

আহসান হাবীব আরমান,জয়পুরহাট জেলা প্রতিনিধিঃ আজ ১৪ ডিসেম্বর ৭১ সালের আজকের দিনেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কবলমুক্ত হয়েছিল জয়পুরহাট। সেই দিন ছিল মঙ্গল বার। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খন্দকার আসাদুজ্জামান বাবলুর নেতৃত্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারা বিজয়ীর বেশে স্বাধীন বাংলাদেশের রক্তে রাঙ্গা পতাকা উত্তোলন করেন জয়পুরহাটে মাটিতে।

১৪ ডিসেম্বর ভোরে সূর্যের লাল আভা যখন পূর্বাকাশে দেখা দিচ্ছে তখন আসাদুজ্জামান নেতৃত্বেতে শ-দেড়েক মুক্তিযোদ্ধা পাঁচবিবি থানার বাগজান ইউনিয়নের ভুঁইডোবা গ্রামে (ভারত সীমান্ত সংলগ্ন) বিনা বাধায় প্রবেশ করে। পাঁচবিবি থানার ভিতর প্রবেশ করে আসাদুজ্জামান বাবলু স্বাধীনতার পতাকা থানা চত্ত্বরে উড়িয়ে দেন। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মুহুর্মুহু ষ্টেনগান আর রাইফেলের গুলি বৃষ্টি ও জয়বাংলা স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে এলাকায়। তিনি পাঁচবিবির মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আব্দুল মোতালেব ও খন্দকার আলমগীরের উপর পাঁচবিবি দায়িত্ব দিয়ে সদল বলে জয়পুরহাট শহরের দিকে রওয়ানা হন। সীমান্তবর্তী হওয়ায় পাঁচবিবি থানা এলাকার বহু মানুষকে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যরা ও রাজাকাররা ব্যাপকহারে হত্যা করে।

যুদ্ধের সময়কাল ধরেই (২০ ই এপ্রিল ৭১ -০৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ) তারা হত্যাযজ্ঞ চালাই এই এলাকায়। ২০ ই এপ্রিল ৭১ মঙ্গলবার। এদিন প্রথম শত্রু সৈন্যরা প্রবেশ করেছিল পাঁচবিবি। এদিন ছিল পাঁচবিবি হাটের দিন। হাটে পৌছার আগেই হানাদাররা কুসুম্বা ইউনিয়েরর ফিচকার ঘাটে খেজুরপাড়া ও সাড়ারপাড়া কয়েকজন নিরপরাধ মানুষ হত্যা করে। সেইদিন নরপিশাচের গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল ব্যবসায়ী ননী গোপাল কুন্ড, ছাত্র নজরুল ইসলাম, দামোদরপুরের ৫/৬ জন দড়ি ব্যবসায়ীদেহ। নিখোঁজ হন আয়মা রসুলপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক বিমল কুমার কুন্ডু। এদের কে হত্যা করেই খ্যান্ত হলোনা নরপশুরা। রক্তের স্বাদ পেয়ে আরো উম্মাদ হয়ে গেল তারা। তাদের হাতে শহীদ হন পাঁচবিবি থানা ন্যাপের নেতা চিরকুমার কামালউদ্দিন মন্ডল, আওয়ামী লীগ নেতা মীর আকবর আলী,নওদা গ্রামের তিন সহোদর ভ্রাতা বিশিষ্ঠ সমাজ কর্মী ইউসুফ উদ্দিন সরদার,ডাঃ ইলিয়াস উদ্দিন সরদার ও ইউনুস আলী সরদার, মালঞ্চা গ্রামের ময়েজ উদ্দিন ফকির। দমদমা গ্রামে কাদের বক্স মন্ডল,বজলার রহমান চৌধুরী , কড়িয়া গ্রামের ছাত্রকর্মী জমির উদ্দিন, কৃষ্ণপুর গ্রামে লোকমান আলী (ছাত্র ইউনিয়ের থানা সহ সভাপতি) মুক্তিযোদ্ধা সোলায়মান আলী সহ নাম জানা ও অজানা সহ অরো অনেকে।

এপ্রিলের শেষ সপ্তা থোকে ডিসেম্বর পর্যন্ত জয়পুরহাট সদর থানা, আক্কেলপুর এলাকায় অকথ্য নির্যাতন চালাই হানাদার বাহিনী। সদর থানার কড়ই কাদিরপুর গ্রামে স্থানীয় রাজাকারসহ পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢুকে গ্রামবাসীদের একত্র করে ব্রাশফায়ারে একই সঙ্গে ৩৬১ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। এ ঘটনা এপ্রিলের শেষ সপ্তার। জয়পুরহাট সদরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ডাঃ আবুল কাশেম, রাজকুমার খেতান (আগঁওয়ালা), দ্বারকা প্রাশাদ খেতান ( আগঁওয়ালা ) মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমান (আক্কেলপুর) এ্যাডঃ আঃ জোব্বার দোগাছির ন্যাপকর্মী সেকেন্দার আলী প্রমূখকে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়। আক্কেলপুর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার খোকন পাইকাড় (বগুড়া শহরের সূর্যসন্তান, তার নামে বগুড়ায় শহীদ খোকন নামে পার্ক হয়েছে)সহ ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধা এবং অসংখ্যা মানুষকে হানাদারেরা স্থানীয় শান্তি কমিটি ও রাজাকারের সহায়াতায় হত্যা করেছে ।

রেল লাইনের ব্রিজের ( আক্কেলপুর রেল ষ্টেশনের উত্তরে) পশ্চিমের জমিতে রয়েছে গনকবর ও বধ্য ভূমি। হানাদার কবলিত অবস্থায় সবচে বড়ো ধরনের গনহত্যা ঘটনারস্থল সদর থানা ধলাহার ইউনিয়নের পাগলা দেওয়ান গ্রাম। ভারত সীমান্ত সংলগ্ন গ্রাম হওয়ায়, হানাদার সৈন্যরা এখানে শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে এখানে একাধিকবার যুদ্ধ ও হয়েছে। এ গ্রামে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য ও বিহারী রাজাকারেরা মিলে ১০ হাজারেরর বেশী মানুষকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে। হত্যাকান্ডের সূচনা হয় মসজিদের ভিতরে জুমার নামাজরত মুসল্লিদের টেনে বের করে হত্যা মাধ্যমে ( শুক্রবার ২০ জুন ৭১) এর পর হাজার হাজার মানুষ যাদেরকে হত্যা করেছে, তারা সবাই ছিল ভারতগামী শরণার্থী। সুদূর পাবনা ,সিরাজঞ্জ, সিংড়া,নাটোর,বগুড়া বিভিন্ন অঞ্চলের ভয়ার্ত নর-নারী, শিশু বৃদ্ধ,যুবক দলে দলে ছুটে পালাচ্ছিল ভারতের আশ্রয় নেয়ার জন্য। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত- শ্রান্ত, অবসূন্ন দেহে যখন একটু বিশ্রামের জন্যে গাছ গাছালির নিচে তারা বসতো, সেই সময় হানাদার সৈন্য ও রাজাকাররা হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়তো তাদের উপর। নারীদের ওপর চালাতো পাশবিক নির্যাতন। নিরবিচাররে হত্যা করা হতো শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত।

এমন দগদগে ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে জয়প্রুহাট জেলা (তখন মহকুমা) অপেক্ষায় ছিল- কবে এ নির্যাতনের অবসান ঘটবে, মুক্তি আসবে।

Print Friendly, PDF & Email