April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী স্মরণে

ডেস্ক: ১৪ ডিসেম্বর। শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং বাংলাদেশের প্রখ্যাত চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর ৪২তম মৃত্যুবার্ষিক। শহীদ বুদ্ধিজীবী ও চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলার খয়েরপুর গ্রামে ১৩৩৫ বঙ্গাব্দ ৩ বৈশাখ জন্মগ্রহণ করেন। বাবা আবদুল হেকিম চৌধুরী এবং মা সৈয়দা ইয়াকুতুন্নেছার ৩ পুত্র এবং ১ কন্যার সন্তানের মধ্যে ২য় সন্তান ছিলেন আবদুল আলীম। আবদুল আলীমের বাবা আবদুল হেকিম চৌধুরী ছিলেন জেলা স্কুল পরিদর্শক। আবদুল আলীম চৌধুরী ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা পাশ করেন কিশোরগঞ্জ হাই স্কুল থেকে (বর্তমানে কিশোরগঞ্জ সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়)। ১৯৪৮ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে আই.এস.সি পাশ করেন। ১৯৫৫ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এম.বি.বি.এস পাশ করেন। ১৯৬১ সালে রয়্যাল কলেজ অফ ফিজিসিয়ান’স অফ লন্ডন এবং রয়্যাল কলেজ অফ সার্জন’স অফ ইংল্যান্ড থেকে ডি.ও শেষ করেন। ১৯৬৫ সালে ২১শে ডিসেম্বর শেরপুরের মেয়ে শ্যামলী নাসরিন চৌধুরীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ছাত্রজীবনে তিনি সাংবাদিকতা হাতে খড়ি নেন এবং এক সময় তিনি ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ‘দৈনিক মিল্লাত’ পত্রিকার সাব-এডিটর ছিলেন। এরপর তিনি ‘যাত্রিক’ নামে একটি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তার লেখায় শ্রেণীহীন শোষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থার কথাসহ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা প্রকাশ পেয়েছে। ছাত্রাবস্থায় তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন এবং কারাবরণও করেছেন। ১৯৫৪, ১৯৫৫ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি ছিলেন (ভি.পি) ১৯৫৮ সালে সেই সময়কার সরকারের বিরোধিতার কারার কারণে দেশ ছেড়ে লন্ডনে চলে যান। বিদেশে থেকেও ডা. আবদুল আলীম দেশের জন্য কাজ করেছেন। ১৯৬২ সালে লন্ডনে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি ছিলেন এর আহবায়ক ও প্রতিষ্ঠিতা সম্পাদক। লন্ডনে থাকা অবস্থায় ২১ ফেব্র“য়ারি উপলক্ষে ভাষণে বিদেশি সাম্রাজবাদের স্বৈরাচার এবং শোষণের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

মানবতাবাদী ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী আমাদের ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থার আজীবন বিরোধিতা করে গেছেন। সমাজের শোষণ, বঞ্চনা, দুর্র্নীতি, অন্যায় ও অত্যাচারের সঙ্গে যারা জড়িত তাঁদের বিরোধিতা করেছেন আজীবন এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় সমালোচনা করেছেন সবার সামনেই। ডাক্তাররাও যেন এই দুর্নীতির প্রশয় না দেন সেজন্য তিনি ডাক্তারদের ‘নন প্র্যাকটিসিং জব’ করার জন্য প্রত্যক্ষভাবে আন্দোলন করেছেন। এজন্যে তাঁকে অনেক সহকর্মীর কাছে বিরাগভাজনও হতে হয়েছে।
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী মুটে, মজুর, দারোয়ান, শ্রমিক জেলে এবং দরিদ্র রোগীর কাছ টাকা-পয়সা কখনো নেন নি বরং তাঁদের চোখে-ছোট বড় অপারেশন করেছেন বিনা পারিশ্রামিককে। তিনি বলতেন ‘ওদের ভাতই জোটে না, তার ওপর আবার ১৬ টাকা ভিজিট। তাইতো তঁাঁর মৃত্যুতে কেঁদেছে হাসপাতালের কর্মকর্তা কর্মচারীসহ অসংখ্য সাধারণ মানুষ।
১৯৭০ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্র সংসদের ত্রয়োদশ পুনর্মিলনী উৎসবে সাবেক সভাপতি হিসেবে প্রদত্ত ভাষণ থেকে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে এই শহীদ বুদ্ধিজীবী চিকিৎসকের আদর্শনিষ্ঠ জীবন-লক্ষ্যের পরিচয়টি। তিনি বলেছিলেন, আমি শুধু সমস্যাগুলো তুলে ধরেছি এবং সমাধান সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছি। তরুণ বন্ধুরা যদি সমস্যাগুলো বুঝবার চেষ্টা করেন এবং সমাধান সম্পর্কে চিন্তা করেন, তা হলেই আমাদের প্রচেষ্টা সার্থক হবে। সমাজকে নতুন করে গড়ে তোলার দায়িত্ব আমাদের সকলের। আমি বিশ্বাস করি সমাজ পরিবর্তনের যে জোরার এসেছে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের অজস্র নতুন প্রাণ একে ত্বরান্বিত করবে। আজকের এই উৎসব মুখর দিনে, আসুন আমরা দুস্থ্য মানবতার সেবার আত্মোৎসর্গ করি ও সংকল্প গ্রহণ করি যে, আমরা এমন একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা কায়েম করবো, যা প্রতিটি নাগরিকের জন্য সুচিকিৎসার নিশ্চয়তা এনে দেবে। আমরা ছাত্রজীবনে দুস্থ মানবতার সেবা করার যে স্বপ্ন দেখেছিলাম, গণমুখী চিকিৎসা ব্যবস্থার বাস্তবায়নের মাধ্যমে যে স্বপ্ন সার্থক হোক।

তিনি শুধু মুখেই বলেনি, কাজকর্মে করেও দেখিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় কারফিউ উঠে গেলে আলীমের কাজ আরম্ভ হতো। গাড়ির বনেট ভর্তি করে ওষুধ সংগ্রহ করতো বিভিন্ন ফার্মেসি আর ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে। এগুলো আবার মুক্তিযোদ্ধাদের গোপন ঘাঁটিতে পৌঁছে দিয়ে আসতো। এ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা করার জন্য একটি গোপন হাসপাতাল ছিল। সেখানে ডা. আলীম, ডা. ফজলে রাব্বি এবং আরো অনেকেই ওখানে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। ডা. আলীমের মৃত্যুর পর একজন মুক্তিযোদ্ধা বলেছিল, “আলীম ভাইয়ের দেয়া আমার চোখের ব্যান্ডজটি এখানো আছে। কিন্তু আলীম ভাই নেই”।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে শেষ দিকে বৃষ্টিমুখর দিনে ডাঃ আবদুল আলীমরে পাশের বাসার মতিন নামে এক ভদ্রলোক মৌলানা আবদুল মান্নাকে ডাঃ আলীমের বাসায় নিয়ে আসেন। বাসার নিচতলায় খালি জায়গায় স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে অসহায়ের মতো মৌলানা মান্নান অনুমতি নিয়ে বাসায় বসবাস শুরু করে। এই মৌলানা আবদুল মান্নানের ইন্দনে আল-বদর বাহিনী ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে চারটায় ‘হ্যান্ডস আপ’ করা অবস্থায় বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়। ডা. রাব্বিকেও নেয়া হয়েছিলো ঐ একই দিনে বিকেল সাড়ে চারটায়। সারারাত নির্যাতনের পর ভোররাতে তাকে হত্যা করা হয়েছে। চিরকালে মতো নিভিয়ে দেয়া হয়েছে তাঁর প্রাণের প্রদীপ। এর তিনদিন পর ১৮ ডিসেম্বর রায়ের বাজার বধ্যভূমিতে ডা. আবদুল আলীমের ক্ষত-বিক্ষত লাশটির সন্ধান পাওয়া যায়। ডা. আলীমের বুকে ছিল অনেকগুলো গুলির ও সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। কপালের বা-দিকে এবং তলপেটে ছিল বেয়নেটের গভীর ক্ষত। তাঁকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য জাতীয় জাদুঘর এবং মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তাঁর ছবি সংরক্ষিত করে রেখেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে তার নাম অম্লান রাখার জন্য ডা. আলীম চৌধুরী নামে একটি আবাসিক ‘ডা. আলীম হল’ তৈরি করেছে।

ডা. আলীম শুধু চিকিৎসকই ছিলেন না, ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবীও। তিনি পাকিস্তান মেডিকেল এসোসিয়েশন (বর্তমান নাম বাংলাদেশ মেডিক্যাল এসোসিয়েশন) এর যুগ্ম সম্পাদক, অপহাল মোলোজিক্যাল সোসাইটি অফ পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ চক্ষু চিকিৎসক সমিতি) এর সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ অন্ধ সমিতির কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। এ ছাড়াও অনেক সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত থেকে নিঃস্বার্থভাবে দেশের জন্য কাজ করেছেন।
ডা. আলীম সংসার জীবনে রেখে গেছেন স্ত্রী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বর্তমান (উদ্দীপন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক, ঢাকা) এবং ২ কন্যা সন্তান। জ্যেষ্ঠ কন্যা ফারজানা চৌধুরী নিপা এম.বি.বি.এস ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ড. সাউথ ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়)। কনিষ্ঠ কন্যা নুজহাত চৌধুরী শম্পা এম.বি.বি.এস চক্ষু বিশেষজ্ঞ (এসিস্টেন্ট প্রফেসর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়)। আমাদের প্রত্যাশাÑ ‘নতুন প্রজন্মের তরুণরা, দেশপ্রেমিক ও চিকিৎসাসেবার আদর্শপুরুষ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরীর মতো অসম্প্রদায়িক দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠুক’।

সূত্র: অনলাইন ও উইকিপিডিয়া।

Print Friendly, PDF & Email