May 16, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

ভিক্ষা ছেড়ে জান মোহাম্মদ এখন মর্যাদাবান

কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি : সময়ের সাথে সামাজিক আবহে প্রবাহমান জীবনে হঠাৎ ছন্দপতন ঘটে জান মোহাম্মদের। একটি সড়ক দুর্ঘটনা তাঁকে মর্যাদাপূর্ণ মানুষের জীবন থেকে ভিক্ষুকের ঘৃণিত পেশায় ঠেলে দেয়, শুরু হয় পরিবর্তিত জীবনের কষ্টময় অধ্যায়।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ সদর ইউনিয়নের রূপালী ক্যাশবা গ্রামে আনুমানিক ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন জান মোহাম্মদ। আট ভাই-বোনের (চার ভাই চার বোন) মধ্যে তিনি ৬ষ্ঠ সন্তান। বাবা সাজিদ মাহমুদ এবং মা মজিতুন খাতুনের সংসারে অর্থ-বিত্তের প্রাচুর্য না থাকলেও বাবার শুটকি মাছের ব্যবসায় উপার্জিত আয়ে বেশ চলছিল পরিবারটি। অধিক সন্তানের কারণে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে না পারলেও খাওয়া পরায় কষ্ট পাননি জান মোহাম্মদ। প্রত্যন্ত অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা জীবন ব্যবস্থায় পড়াশোনার সুযোগ হয়ে ওঠেনি ভাইবোনের জীবনে। প্রায় ৪০ বছর আগে হঠাৎ করেই বাবা মারা যান, বড় দু’ভাই সংসারের হাল ধরে পৈত্রিক পেশা শুটকি মাছের ব্যবসা চালিয়ে। এরই মধ্যে বছর খানেকের ব্যবধানে মা-ও মারা যান। প্রতিবেশী এবং স্বজনদের সহায়তায় বোনদের বিয়ে দেয়া হয়। সময়ের পরিক্রমায় ভাইয়েরা বিয়ে করে ভিন্ন ভিন্ন সংসার জীবন শুরু করে। শৈশব-কৈশোরের উল্লেখ করার মতো স্মৃতি না থাকলেও ১৪/১৫ বছর বয়সে ঈদের সময় নতুন পাঞ্জাবীর বায়না ধরে না পাওয়ায় রাগ করে বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলেন। কয়েকদিন এদিক ওদিক আত্মীয় স্বজনের বাসায় থেকে আবার ফিরে এসেছেন। সমবয়সী বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লোর করে বেশ আনন্দেই কাটতো শৈশব।

“দু’দিন আগেও যারা করুণা করে দু’টাকা হাতে ধরিয়ে দিতেন, তারা এখন সম্মান করে, আমার দোকান থেকে পণ্য নেয়।”

২০/২২ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন পার্শ্ববর্তী এলাকায়। বিয়েতে কোন যৌতুক নেননি, অবশ্য শ্বশুরবাড়ির স্বচ্ছলতা বলতে খেয়ে পরে বেঁচে থাকার বাইরে কোন উদ্বৃত্ত থাকতো না। বিয়ের ৪ বছরের মাথায় ছেলে সন্তান জন্ম হলে সংসারে বেশ আনন্দ বয়ে যায়। কৃষি শ্রমজীবী জান মোহাম্মদ সারাদিন কাজ শেষে বাড়ি ফিরে স্ত্রী-সন্তানের সাথে বেশ আনন্দেই সময় কাটাতেন। কিন্তু এই আনন্দে সাহসাই ভাটা পড়লো হঠাৎ করে স্ত্রীর মৃত্যুতে। পরিবারে দুর্যোগ নেমে আসে। স্ত্রী বিয়োগ ও সন্তান পরিচর্যা এ দু’য়ের প্রয়োজনে ২য় বিয়ে করেন প্রতিবেশী হামিজাকে। প্রথম পক্ষের সন্তানকে লালন পালনের মধ্য দিয়ে হামিজার নতুন দাম্পত্য জীবনে জান মোহাম্মদ কোন কষ্টের কারণ হয়নি।
বিয়ের ৩ বছর পর ২য় স্ত্রী হামিজার প্রথম ছেলে এবং তার ৪ বছরের মধ্যে মেয়ের জন্ম হয়। এবারে জান মোহাম্মদ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছলে-মেয়েকে শিক্ষিত করে গড়ে তুলবেন। বাড়ির পাশেই ক্যাশবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ছেলে স্কুলে যায়, মেয়ে ছোট, নিজের শ্রমের আয়ে সংসার ভালোই চলে যাচ্ছিল। পৈত্রিক জমা-জমি বলতে ২ শতক ভিটে বাড়ি ছাড়া আর কিছুই ছিলো না তাঁর। যা আজও আঁকড়ে ধরে আছেন। প্রতিদিনের ন্যায় কাজে বের হলেন সুস্থ জান মোহাম্মদ, কে জানতো তার জন্য বাইরে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। ২০০৫ সালের দিকে কাজে বের হয়ে কিশোরগঞ্জ বাজারে রাস্তা পার হতে গেলে তাকে ট্রাক চাপা দেয়। কিভাবে বেঁচে গেলেন তাঁর মনে নেই। চেতনা ফিরে এলে নিজেকে রংপুর হাসপাতালের বিছানায় আবিষ্কার করেন। ততক্ষণে পূর্বের চলমান জীবনের ইতি ঘটেছে তাঁর। হাঁটতে পারেন না, ডান পা পুরোটাই ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে গেছে। অবশেষে ডান পা ত্যাগ করতে হয়েছে তাঁকে। সুস্থ জীবনে প্রতিবন্ধীত্ব নেমে আসে তাঁর। প্রতিবেশীদের আর্থিক সহায়তায় জীবন বাঁচিয়ে বাড়ি ফিরলেও ৫ টি জীবনের চাকা ঘোরাতে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না তাঁর হাতে। আশপাশের প্রতিবেশীদের পরামর্শ আর বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ রাস্তায় নামালো তাঁকে। অসম্মানের জ্বালার চেয়েও ক্ষুধার জ্বালা যে কতো ভয়ংকর তা আপনারা বুঝবেন না বলে চোখের পানি মুছতে থাকলেন জান মোহাম্মদ। ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষে নিজের কষ্টের বর্ণনা দিয়ে তাঁর অনুভূতিতে একাত্মতা প্রকাশ করায় কিছুটা সাবলীল হলেন তিনি। ইতোমধ্যে প্রথম পক্ষের ছেলে বিয়ে করে ঢাকায় পাড়ি জমিয়েছে। ২য় পক্ষের ছেলে ৪র্থ শ্রেণির পর পাঠ চুকিয়ে কাজ করে পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে সাহায্য করছে।
একজন পঙ্গুত্ব বরণ করায় গোটা পরিবারই যেন পঙ্গু হয়ে পড়েছে। স্ত্রী এখন সার্বক্ষণিক তাঁর সহযোগী। হাঁটতে, বসতে, উঠাতে তাকে সাহায্য করতে হয়। ধীরে ধীরে নতুন জীবনের সাথে খাঁপ খাইয়ে নিতে নিতে জান মোহাম্মদ এখন পুরোপুরি ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। তিনি এখন ভিক্ষুক। স্ত্রীকে নিয়ে দিনভর ভিক্ষা করে ৪/৫ সের চাল আর শুক্রবার সাথে ২৫/৩০ টাকা নগদ আয় হতো। এ দিয়ে একটানা প্রায় ১০ বছর ধরে বেঁচে আছেন তিনি। হঠাৎ অসুস্থ হলে ৩/৪ দিন ভিক্ষায় নামতে না পারলে অর্ধাহারে অনাহারেও থাকতে হয়েছে। নিজের পঙ্গুত্ব ছেলেমেয়ের ভবিষ্যত অনিশ্চয়তা, ভিক্ষার পেশা গ্রহণ, সব মিলিয়ে তিনি এখন অন্ধকারের বাসিন্দা। যেখানে ইচ্ছা করলেই আর নিজের পক্ষে আলো জ্বালানো সম্ভব নয়। কিন্তু আলোকবর্তিকা হয়ে পাশে দাঁড়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর “একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের” অতি দারিদ্র্য দূরীকরণের আওতায় ভিক্ষুক পুনর্বাসন কর্মসূচি। যৌথভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় উপজেলা প্রশাসন। বাড়ির পাশেই ক্যাশবা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মোড়ে টং দোকান তুলে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেয়া হয়।

প্রতিদিনের কেনাবেচা শেষে ২০০/২৫০ টাকা আয় থাকে তার। এদিয়ে সংসার চলে যাচ্ছে তাঁর। ভিখেরির অপবাদ ঘুচিয়ে আত্মসম্মান ফিরে পাওয়ার স্বাদ কেমন, জানতে চাইলে আবারো চোখ ছলছলিয়ে ওঠে তাঁর। ছেলেটা ঢাকাতে গার্মেন্টসে কাজ নিয়েছে, মেয়েও ভাইয়ের সাথে ঢাকাতে থাকছে। ছেলে মাস শেষে কিছু টাকা পাঠায়, নতুন জীবনের অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্যার এটাতো আমার পুরানো জীবন, নতুন জীবনটা ছিল ভীষণ কষ্টের, আর অসম্মানের যা ত্যাগ করে আবার পুরোনো জীবন ফিরে পেয়েছি। এজন্য তিনি “একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের” উদ্যোগ এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। ৫হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ১টি ছাগল ক্রয় করেছেন ও ব্যবসায় পুঁজি লাগিয়েছেন। প্রকল্প অফিসের মাধ্যমে দোকানের প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়ের জন্য স্থানীয় দোকান ঠিক করে দেয়া হয়েছে । বিক্রি করে টাকা পরিশোধ করে আবার প্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে আসবেন। এলাকার মানুষের মধ্যেও এমন কর্মসূচিতে সরকারে প্রতি ইতিবাচক মনোভাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি প্রতিমাসে সমিতিতে ২০০ টাকা করে সঞ্চয় জমা করছেন এবং প্রকল্প সেখানে ২০০ টাকা করে উৎসাহ বোনাস দিচ্ছে। এ টাকা জমিয়ে তিনি মেয়েকে একটা ভালো পাত্র দেখে বিয়ে দেবন বলে আশা করছেন।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, এলাকার অনেকেই যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন, দেশটা স্বাধীন হবে এ এক আলাদা অনুভূতি ছিলো, কিন্তু দেশটা যে এতো তাড়াতাড়ি এভাবে স্বাধীন হয়ে যাবে তা ভাবতে পারেননি বলে জানান তিনি। তবে স্বাধীন দেশে নিজের জীবনটা যে পরাধীন হয়ে যাবে তা তিনি কখনো কল্পনা করতে পারেননি। এ কষ্টটা আজীবন তাঁকে বয়ে বেড়াতে হবে বলে জানান তিনি। পঙ্গু হলেও এখন নিজেকে বেশ পরিপূর্ণ মানুষ মনে হচ্ছে তাঁর। দু’দিন আগেও যারা করুণা করে দু’টাকা হাতে ধরিয়ে দিতেন, তারা এখন সম্মান করে, আমার দোকান থেকে পণ্য নেয়। আমৃত্যু যেন আপনাদের দেয়া এ সম্মানটুকু নিয়ে চলতে পারি এমন দোয়াই চাইলেন তিনি।
মানুষ কেন ভিক্ষুক হয়ে অন্য একজন মানুষের করুণায় বেঁচে থাকবে? তাঁকে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়ার দায়িত্ব আপনার আমার সকল মানুষের। আসুন সকলে এক হয়ে অমর্যাদাকর পেশা থেকে তাঁদের আমাদের মানুষের সমাজে নিয়ে আসি।

Print Friendly, PDF & Email