April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

বাউল গোষ্ঠী, বাউল-ভাব ও শাহ আবদুল করিম প্রসঙ্গ

মাহবুব পিয়াল : কে বেশী বাউল? লালন না করিম ?  বাউল ‘সম্রাট’ই বা কে? এগুলো সব ‘ডিম ও মুরগী’ বিতর্কের মতোই খামাখা তুলে ধরা প্রসঙ্গ। একেক জনের সময়, ধারা ও প্রক্ষিত ভিন্ন। সৃষ্টিশীলতার তুলনার প্রশ্নই নেই।  যে বেশী  ভাবের বাউল সেই  কি বাউল,  নাকি যার দেহে আছে বাউল  গোষ্ঠীর রক্ত ধারার দাবী—কোনটা মানবো আমরা? এমন একটা ধাঁ ধাঁ-র  ঘুরপাক ফেলে দেয়া হয়েছে এদেশের অনেককেই।    এমন  শোনা যায় জন্মগত ভাবে কেউ বাউল হয় না, হয়ে উঠতে হয় সাধনার দীর্ঘ পথ পরিক্রমায়। এ প্রশ্ন তোলাও কি যৌক্তক নয় ভাবের  পাগল  কেউ কখনো কি ‘বাউলের সম্রাট’ হতে চায়? বাউলগোষ্ঠীর সদস্য হয়ে বা না হয়েও? ‘শ্রেষ্ঠত্বের’ এই ধারণার বিরুদ্ধচারণ করেইতো বাউলদের পথ-পরিক্রমার সূচনা ঘটেছিল। কারণ,  দেখা গেছে বাউল ধর্মের উত্থান পর্বে অনেক জমিদার তনয়রাও সর্বস্ব ত্যাগ করে এ ধর্মে দীক্ষা নিয়েছিলেন, মানুষ হয়ে উঠার সাধনায়। কোন কিছুর সম্রাট হয়ে আধিপত্যবাদী হয়ে উঠতে নয়। বাঙলার একটা নির্দিষ্ট ভৌগলিক অঞ্চলে বাউল ধর্মের বিকাশ ঘটলেও এর মূল চিন্তার ঝাপটা সারা বঙ্গেই বিরাজমান ছিল না না রুপে। আমাদের স্বভাব কবি ও গীতি সাধকদের একটা মূল তাড়নাই ছিল বাউল ভাব।  অন্যদিকে বাউল কম্যুনিটির অংশ হলেই ‘বাউল ভাব’ এসে যাবে এমন কি হয়? হয়না। এ ভূখন্ডের মানুষের পূর্বসুরী যারা আর্যদের আরোপিত বর্ণাশ্রম প্রথা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সেই সব সহজিয়াদের মত বাউলরাও সম্প্রদায়গত ভাবে ছিলেন তাদেরই একটা অংশ।   কিন্তু এই সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত না হলেও  মনোমোহন,হাসন, বিজয়, আরকুম, রশীদ উদ্দিন, জালাল, দুরবীন, করিম  ও আরো নাম না নেয়া জনদের ‘বাউল ভাব’ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কেউ কি আছে? হাসন রাজা যেখানে গাইছেন ‘বাউলা কে বানাইল রে..’ তখন কিন্তু ভাবের কথাই বলছেন, কারণ রক্তের সম্পর্কে তিনিতো জমিদার বাউল সম্প্রদায়ের লোক তিনি ছিলেন না। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন বাউল ধর্ম অনুসারীরা  সবাই কিন্তু গান করেনা। ওদের আছে না না আচার-উপাচার, গুপ্তজ্ঞানের চর্চা, সাধন ভজনের ধারা। গান ওদের জীবন চর্চার একটি অংশ মাত্র। অবাক করা ব্যাপার হল,  দক্ষিণাঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত নাহয়েও অন্য একটি জনপদে  নরসিংদি জেলা শহরের লঞ্চ ঘাটের পাশেইগড়ে উঠেছে এক বাউল পাড়া। ওরা বৈষ্ণব মতানুসারী, বছরে একবার কির্ত্তন ছাড়া আর কোন গানই  করেনা। নিরামিষ-ভোজী এই সম্প্রদাদায়ের লোকেরা বাউল ভাবের  ধারে কাছেই নেই এখন আর। অথচ নামের শেষে বাউল শব্দটি জুড়ে দেয় পারিবারিক ভাবেই,  দাবী করে ওরাই আসল বাউল।

 শক্তি নাথ ঝাঁ তার গবেষনায় দেখিয়েছেন রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর ও তাঁর পরিবারের লোকেরা বাউলদের এক সৃষ্টিকর্তার অনুসারী মতবাদের সঙ্গে নিজেদের ব্রহ্ম ধর্মের একটা মিল পেয়েছিলেন বলেই বাউল গানের বাণীকে সামনে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু বাউলদের জীবন যাপনের বিষয় গুলোকে অত্যন্ত সচেতন ভাবেই পাশ কাটিয়ে গেছেন স্বয়ং রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর।  পোষ্টমাস্টার গল্পে  বরং বাউলদের প্রতি একটু ভিন্ন মনোভাবই প্রকাশ পেয়েছে তাঁর, যখন বলেন: মাতাল বাউলের দল চীৎকার করে গান  করে চলেছে। ভদ্র লোকের সমাজেও বাউলরা খুব একটা সমাদৃত ছিলেন না। কিন্তু বাউল ভাব প্রবল ভাবে বাঙলার লোক সমাজে আদৃত হয়ে চলেছে।

রবীন্দ্র নাথ ও তাঁর পরিবারের ছোঁয়ায় বাউল গানের বাণীকে বাংলার ভদ্র ও এলিট সমাজের বাসিন্দারা সমাদর করে, জাতি-সত্ত্বা ও পরিচয়ের সাথেও একাত্ম করে তোলে। কিন্তু এত কিছুর পরও বাউল গান, বাউল জীবন ধারা ও বাউল ভাবের দূরত্ব ও নৈকট্য নিয়ে আমাদের দেশের ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় সৃষ্ট কিছু বিভ্রান্তির জালে অনেকেই হাবুডুবু খেতে থাকে। অতি সম্প্রতি কথা উঠেছে শাহ আবদুল করিমের ‘বাউল সম্রাট’  হওয়া না  হওয়া নিয়ে।  শাহ আবদুল করিম গান বাধতেন, সেটা লোক গানের কোন ধারার অংশ? এ নিয়ে মিডিয়াতে কোন উল্লেখ নেই। শুধু তার কিছু গান রিমিক্স করে প্রতি নিয়ত প্রচার করেছে শহুরে গায়কদের গাওয়া বিকৃত সুরে নিতান্ত বাণিজ্যক স্বার্থে। এই বিকৃতি নিয়ে শাহ আবদুল করিম জীবদ্দশায় খুব মনোপীড়ায় ভুগতেন। ওঁর নিজের গাওয়া ও স্থানীয় লোক-গায়কদের কন্ঠের করিমের গান  মিডিয়াতে পাত্তা পায়নি। উপরন্তু মিডিয়ার চোখে পড়তে পড়তেই করিম এর মাঝে পাড় করে দিয়েছিলেন নব্বই বছর (অবশ্য সেটা তিনি চাইতেনও না)। অথচ বহু আগেই দুরবীন শাহকে নিয়ে ‘বিলাত’ ঘুরে এসেছেন। উপরন্তু রিমিক্স ওয়ালাদের হাতে ধরে শাহ আবদুল করিম খন্ডিত ভাবে উঠে এসেছেন মিডিয়ায়। শহুরে হালের গায়কদের জুড়ে দেয়া যন্ত্রানুষঙ্গ আর টিউনারের আড়ালে চাপা পড়া কৃত্রিম কন্ঠের ‘মুর্ছনায়’ আকৃষ্ট হয়েছে বহুজন । এর ফলে শাহ আবদুল করিমের ইমেজটা মিডিয়া ও একধরণের নগরবাদী বিশারদরা তৈরী করে দিল অন্যভাবে, যার ধারে কাছেও তিনি নন। পয়সা গেল গান ব্যবসায়ীদের পকেটে। করিম রইল সম্বলহীন। অন্যদিকে এ সুযোগে শাহ আবদুল করিমকে আবার অ-বাউল হিসেবে দেখানোর তাড়নাও একটা গোষ্ঠির মাঝে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। একারণেই একটু দেখে নেয়া প্রয়োজন শাহ আবদুল করিমের প্রেক্ষাপট কি ছিল। তাঁর গানের ধারা টি কি? কেন মানুষেরা ওদেরও বাউল ডাকে, যখন ভাটী অঞ্চলে বাউল সম্প্রদায়ের কোন বসতিই নেই।

মূলত: শাহ আবদুল করিম ছিলেন মালজোড়া গানের শিল্পী। তাঁর ওস্তাদ ছিলেন  নেত্রকোণার রশিদ উদ্দীন। সতীর্থ ছিলেন জালাল উদ্দন খাঁ ও উকিল মুনশী প্রমুখ। মালজোড়া গানকে বলে প্রতিদ্বন্ধীতা মূলক বা পাল্টা পাল্টি ‘বাউলা’ গান। মালজোড়ার গায়করা একে এভাবেই নামাঙ্কিত করেন। এই গানের আসরে একাধিক গায়ক না না বিষয় নিয়ে বিতর্ক করেন ও পালটা-যুক্তির খেলা খেলেন। যুক্তি পাল্টা যুক্তি দিয়ে তারা না  না বিষয়ের পক্ষ-বিপক্ষ সাজেন। হয় তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই যুক্তির লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে ওরা তর্কের  সমাধান করেন। মানুষকে যুক্তিমুখী করা, জীবন ও বিশ্বচরাচরের না না বিষয় নিয়ে প্রশ্ন তোলার ক্ষমতা তৈরী এবং সর্বোপরী ভিন্নমতের মাঝে একটা সমন্বয় ঘটানোই যেন এর উদ্দেশ্য। ভাবের ভেতর ভেসে ভেসে চলে জ্ঞান সাধনা, যেন এক লোক-বুদ্ধির চর্চা। বাউলরা যেমন প্রখর যুক্তিগ্রাহ্যতার ভেতর দিয়ে চলেন, এবং  প্রচলিত সত্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন, মালজোড়া শিল্পীরাও তাদের গানে অনেকটা তাই করেন। তবে তাদের আঙ্গিকটি ভিন্ন।  যুক্তি তর্কের কথার মালার পাশাপাশি ওরা   গানে গানে ধরে রাখেন শ্রোতা-দর্শকদের। এই গান কিছু নিজেদের বাধা, আবার প্রসঙ্গের সাথে সঙ্গতি রেখে অন্যদের গানও গেয়ে থাকেন  ওরা। রশীদ উদ্দিন মালজোড়া গানের প্রচলন করেন তার শীষ্যদের নিয়ে আর এর অনুপ্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন  কবি গান থেকে। বৃহত্তর ময়মন সিংহ, বৃহত্তর সিলেট ও বৃহত্তর কুমিল্লা মালজোড়া গানের একটা বিশাল প্রভাব অঞ্চল। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারের আগেই ওইসব অঞ্চলের গ্রামে গঞ্জে হাটে বাটে শাহ আবদুল করীমকে এক নামে সবাই চিনতেন, শুধু শহরের কিছু অধিবাসী ছাড়া। মালজোড়ার আসরগুলোতে তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হতেন দুরবীন শাহ, ক্বারী আমির উদ্দীন, ব্রাহ্মণ বাড়িয়ার অমিয় ঠাকুর, মোহন লাল দাস, নেত্রকোণার আবেদ আলি প্রমুখ। ‘প্রতিদ্বন্দ্বীতা মূলক বাউলা গান’ করেন বলেই  ধীরে ধীরে স্থানীয় মানুষরা মালজোড়ার শিল্পীদের নামের আগে ‘বাউল’ শব্দটি  জুড়ে দেয়। শাহ আবদুল করিম  গানের ভনিতায়  নিজেকে কখনো ‘পাগল’ কখনো ‘বাউল’ আবদুল করিম নামে উল্লেখ করেছেন।

এসবের বাইরেও শাহ আবদুল করিম গান বাধতেন। না না অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে গাইতেন। । কালনীর তীরের এক দূর্গম ও অবহেলিত জনপদের রাখাল বালক থেকে বড় এক পদকর্তা ও গায়ক হয়ে ওঠা শাহ আবদুল করিম সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তার সেই সব গান মিডিয়াতে প্রচারিত হয়নি খুব একটা। সারা জীবন জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে গানের লড়াই করেছেন। আবার ভাবের জোয়ারে ভেসে গিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীকে জড়িয়ে ধরে গান ছেড়ে দীর্ঘক্ষণ কেঁদেছেন, এমনটাই শুনেছি কোনো এক মালজোড়ার আসরে অংশ নেয়া তার সহ শিল্পীর কাছে। এমন ভাবের মানুষের কোন কিছুর ‘সম্রাট’ হওয়ার ইচ্ছা কোন কালেই ছিলনা। একথাটাই বলছেন মৌলভী বাজারের অধিবাসী গবেষক মাহফুজুর রহমান।

অথচ মিডিয়ার একটা অংশ কিছু না বুঝেই  ‘সম্রাটে’ নামের একটা  ‘তকমা’ এটে দিল তাঁর উপর।  এ নিয়ে আবার বিরোধিতার নামে খামাখা বিতর্কেও জড়াচ্ছেন কেউ কেউ বাউল অ-বাউলের প্রচলিত ও প্রথাগত সংজ্ঞা ধরে। সার কথা হল: ভাবের মানুষ সে মালজোড়া শিল্পী  কিংবা   বাউল সাধক যেই হোক, ওদের সাধনা হল মানুষ হয়ে উঠার মাঝে। মানব সমন্বয় ওদের মূল আকাঙ্খা। কারণ ওঁরা মানব সাম্যে বিশ্বাস করেন, এক ধরণের  ইগালিটারিয়ানিজম এদের আরাধ্য। লালন সাঁইজির গানেও রয়েছে তাঁর ‘বিজাতের রাজা’ হয়ে এই অকূলে থাকার প্রতি এক অনীহা। সেখানে কে সম্রাট এবং কে সম্রাট নয়,  কিছু কিছু ইলেকট্রনিক মিডিয়া, নগরবাদী কৃচ্ছধর্মী ভাবনার মানুষের সৃষ্ট এমন ইঁদুর দৌড়ে ওই সব দেহান্তরিত মানুষদের ফেলে দেয়া শোভন নয়। ওঁরা জীবদ্দশায়ও এসবের জবাব গানে গানে     দিয়ে গেছেন। অনুসন্ধানী কানে তা ধরা পড়বেই। শাহ আবদুল করিমের ‘যার যা ইচ্ছা বলুক সবে’ গানেও তিনি এমন সব প্রশ্নের  উত্তর  রেখে গেছেন।
লেখক : গবেষক, লোক গান।

Print Friendly, PDF & Email