April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

বেসিক, সোনালী, রূপালীসহ ৭ ব্যাংক প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ

অর্থনৈতিক প্রতিবেদক : ব্যাংক ব্যবস্থার খেলাপি ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত পরিমাণের অর্থ সংরক্ষণের (প্রভিশন) বিধান রয়েছে। সে অনুসারে জুন-১৬ শেষে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি খাতের সাতটি ব্যাংক। এসব ব্যাংকের মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ২২১ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৈরি করা (এপ্রিল-জুন’ ২০১৬) সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ তালিকায় সরকারি খাতের ৪টি ও বেসরকারি খাতের ৩টি ব্যাংক রয়েছে। ব্যাংকগুলো হলো : সোনালী, রূপালী, বেসিক ব্যাংক, প্রিমিয়ার ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক। এছাড়াও রযেছে বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক।
চলতি বছরের জুন শেষে সাত ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার ২২১ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংকেরই ঘাটতি রয়েছে ৩ হাজার ৫৫১ কোটি টাকা। শুধু তাই নয়, এ সময়ে কয়েকটি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত থাকার পরও সার্বিক ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৩২২ কোটি টাকা।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশির ভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো প্রকার ঝুঁকির মুখে না পড়ে সে জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ। নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে পাঁচ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়।
নিম্নমান বা সাব স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। ব্যাংকের আয় খাত থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করা হয়। খেলাপি ঋণ বাড়লে, আর সে অনুযায়ী ব্যাংকের আয় না হলে প্রভিশন ঘাটতি দেখা দেয়। ব্যাংক কোম্পানি আইন অনুযায়ী, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খেলাপি ঋণ বাড়ার কারণেই ব্যাংকিং খাতে বাড়ছে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ। আর এ সময়ে যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ বেশি হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে যায়। আবার খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোকে আয়ের খাত থেকে অর্থ এনে প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হচ্ছে। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশ বঞ্চিত হচ্ছেন। এছাড়া যেসব ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে থাকে তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। যা আর্থিক ভিত্তির দুর্বলতা প্রকাশ করে।
তিনি বলেন, খেলাপি ঋণ বেশি হলে ঋণের সুদও বাড়ে। এতে ব্যবসায়ী ও শিল্পোদোক্তারা নিরুৎসাহিত হন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬৩ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ০৬ শতাংশ। আগের প্রান্তিক তথা মার্চ শেষে এ খাতে খেলাপিঋণ ছিল প্রায় সাড়ে ৫৯ হাজার কোটি টাকা। যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। ফলে মার্চ থেকে জুন এই তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা। গেল বছরের ডিসেম্বরে এ খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ৫১ হাজার কোটি টাকার মতো।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৩৬ হাজার ১৭৯ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৩১ হাজার ৭৩৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ফলে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৪৪৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। গত মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতের সামগ্রিক প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৪ হাজার ১২৩ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে ৩২১ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মার্চ পর্যন্ত ছয়টি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতিতে ছিল। জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭টিতে। এ সময়ে নতুনভাবে রূপালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে পড়েছে। আর জনতা ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতি থেকে বেরিয়ে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৫ হাজার ৫০৭ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ১ হাজার ৯২ কোটি ৯০ লাখ, রূপালী ব্যাংকের ৭৭৫ কোটি ৫৬ লাখ ও বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৬৫১ কোটি ৩১ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে।
এ সময়ে বেসরকারি খাতের তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ৫১৬ কোটি ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১৮০ কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের ৮৯ কোটি ২১ লাখ ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২৪৭ কোটি ২১ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। আর বিশেষায়িত খাতের বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১৯৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।

Print Friendly, PDF & Email