May 17, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

ষষ্ঠ বছরে সেই মণি-মুক্তা

মোঃ আব্দুর রাজ্জাক, দিনাজপুর : শিশু দু’টির কোনো দোষ ছিল না। অথচ তাদের জন্মের পর দিনাজপুরের পালপাড়ার কুসংস্কারাচ্ছন্ন বেশ কিছু মানুষ তাদের মা-বাবাকে ‘অভিশপ্ত’ বলে অপবাদও দিয়েছিল। মূলত জোড়া হয়ে জন্মগ্রহণের কারণেই তাদের মা-মাবাকে শুনতে হয়েছিল ওই নিন্দা।

তবে সে নিন্দা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। কারণ ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১০-এ তারা পৃথক দেহ পায়। সে এক সফলতার গল্প। কারণ তা ছিল বাংলাদেশে প্রথম সফল অস্ত্রোপচার— যে সফলতা এসেছিল দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক এ আর খানের হাত ধরে। শিশু দু’টির মা-বাবার কথায় তা ছিল— ঈশ্বরের ইচ্ছা এবং ডা. এ আর খানের চেষ্টার ফল।

সেই যমজ দুই বোনের অর্থাৎ মণি ও মুক্তার ২২ আগস্ট ২০১৫ ষষ্ঠ বছর পূর্ণ হল। শনিবার বিকেলে কেক কেটে ষষ্ঠ জন্মবার্ষিকী পালনও করল পরিবারের লোকজন। এদিকে মণি-মুক্তার জন্মদিন উপলক্ষে ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ডা. এ আর খান।

অপরেশনের আগে মণি-মুক্তা

দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ উপজেলার শতগ্রামের পালপাড়া নিবাসী প্রকাশ পাল। তার স্ত্রীর নাম কৃষ্ণা রাণী পাল। কৃষ্ণা রাণী পালের গর্ভে ২০০৯ সালের ২২ আগস্ট মণি ও মুক্তার জন্ম হয়। তবে তা স্বাভাবিভ ডেলিভারি ছিল না— পার্বতীপুর একটি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তারা পৃথিবীর মুখ দেখেছিল। সে সময় প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দেয় শিশু দু’টির দেহ একে অপরের সাথে লেগে থাকা।

বর্তমানে মণি-মুক্তা সুস্থ আছে। তারা একে অপরের সাথে খেলা করে সময় কাটায়। বেশ সুন্দর করে কথা বলে। গত বছর তাদের বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়েছে। এ বছর তারা প্রথম শ্রেণীতে পড়ছে বলে জানিয়েছেন তাদের বাবা-মা। মণি-মুক্তার সাথে যোগাযোগ করলে তারা তাদের জন্মবার্ষিকীতে তারা দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছে।

মণি-মুক্তার বাবা জয় প্রকাশ পাল জানালেন শিশু দু’টির জন্মের পরবর্তী পরিস্থিতি। তিনি বললেন, সে সময় একদিকে শিশু দু’টির এ অস্বাভাবিক জন্ম, অন্যদিকে এলাকার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষগুলো এটাকে ‘অভিশপ্ত জীবনের ফসল’ বলে প্রচার করতে থাকে। সমাজের নানা কুসংস্কারে প্রায় ‘এক-ঘরে’ হয়ে পড়ি। সমাজের নানা অপবাদে গ্রাম ছাড়ি। তবে হতাশার মাঝে স্বপ্ন দেখি মণি ও মুক্তাকে নিয়ে। বিভিন্ন চিকিৎসকের দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকি তাদের স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য। পরে রংপুরের চিকিৎসকগণ ঢাকা শিশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে যমজ বোনকে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে পৃথক করার পরামর্শ দেন। তাদের পরামর্শে ২০১০ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা শিশু হাসপাতালে মণি-মুক্তাকে ভর্তি করি।’

২০১০-এর ফেব্রুয়ারিতে অপরেশনের পর মণি-মুক্তা

একটু থেমে কৃতজ্ঞতা ও তৃপ্তির ভাব মুখে এনে বললেন, ‘এরপর ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শিশু হাসাপাতালে শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. এ আর খান স্যারের সফল অপারেশনের মাধ্যমে আমাদের মণি-মুক্তা আলাদা হয়। ২০০৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি হাসপাতাল থেকে ওদের সুস্থতার ছাড়পত্র পাই। এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি পার্বতীপুর মণি-মুক্তাকে তাদের নানাবাড়ি নিয়ে যাই। সে দিনটা যে কী আনন্দের ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।’

হ্যাঁ, দিনটা তো আনন্দের বটেও সেই সাথে বাংলাদেশের নতুন সফলতার ইতিহাস। জোড়া শিশু দেহ পৃথকীকরণে সফতার বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের প্রথম অর্জন।

মণি-মুক্তার মা কৃষ্ণা রাণী পাল বললেন, ‘সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদ ও ইচ্ছা এবং ডা. এ আর খানের চেষ্টায় আমরা মণি-মুক্তাকে স্বাভাবিকভাবে ফিরে পেয়েছি। আমরা সব কষ্ট ভুলে তাদের চিকিৎসক হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। মণি-মুক্তা ও পরিবারের সকলের জন্য দোয়া করবেন।’

Print Friendly, PDF & Email