April 29, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

সঙ্কোশের জল তিস্তায় ফেললে চুক্তিতে রাজি মমতা

ডেস্ক প্রতিবেদন : ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে অমীমাংসিত তিস্তা চুক্তির ইস্যুটি নিষ্পত্তির জন্য একটি বিকল্প ভাবনা পেশ করতে চলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানতে পেরেছে, সঙ্কোশ নদীর উদ্বৃত্ত জল কৃত্রিম খাল কেটে যদি তিস্তায় এনে জলের প্রবাহ বাড়ানো যায়, তাহলে তিস্তা চুক্তিতে তার আপত্তি থাকবে না বলে মিস ব্যানার্জি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে জানাতে চলেছেন।

২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরের সময়েই যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার কথা ছিল– তা যে আজ চার বছর পরেও অনিশ্চিত হয়ে আছে তার একমাত্র কারণ মমতা ব্যানার্জি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তিতেই দিল্লি আজও ঢাকার সঙ্গে এই চুক্তি সই করতে পারেনি। মমতা ব্যানার্জি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, তিস্তায় এই মুহূর্তে জলের প্রবাহের যা অবস্থা তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে কোনও আন্তর্জাতিক চুক্তি আদৌ সম্ভব নয়। আর চুক্তি হলেও সেটা হবে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সঙ্গে প্রতারণার সামিল। আর এই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই শুরু তার বিকল্প ভাবনাচিন্তা!

আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেও চিরকাল এই চুক্তির পথে বাধা হয়ে থাকতে চান না। প্রতিবেশী দেশের মানুষ তাকে ‘ভিলেন’ হিসেবে দেখুক এটাও তার কাম্য নয়। অনেকটা একই কারণে তিনি স্থল সীমান্ত চুক্তিতেও সায় দিয়েছেন, যে কারণে নরেন্দ্র মোদি সরকার পার্লামেন্টে বিলটি অনায়াসে পাস করাতে পেরেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ঢাকা সফরে গিয়ে মমতা নিজেও বলে এসেছেন, ‘তিস্তার ব্যাপারে আপনারা আমার ওপর ভরসা রাখুন, বিষয়টা আমি দেখছি!’

তো মিস ব্যানার্জি সত্যিই কথা রেখেছেন, বিষয়টা তিনি দেখেছেন। আর এই ‘দেখাদেখি’র সূত্র ধরেই উঠে এসেছে সঙ্কোশের সঙ্গে তিস্তাকে যুক্ত করার ভাবনা এবং ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্পের নতুন এক উদ্যোগ সেই ভাবনাকে সত্যি করারও স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

 বিষয়টা একটু খুলে বলা যাক

ভারতে অটলবিহারি বাজপেয়ির জমানায় যে নদী-সংযোগ প্রকল্পের অবতারণা হয়েছিল এবং মোদির আমলে আবার যে প্রকল্প নিয়ে জোরেশোরে তৎপরতা শুরু হয়েছে তার মূল বিষয়টাই হল দেশের যে প্রান্তে জলসম্পদ উদ্বৃত্ত, সেখান থেকে খাল কেটে জল অন্যত্র নিয়ে আসা, যেখানে জলের চাহিদা বেশি। যেমন, ‘ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা’কে ‘ওয়াটার সারপ্লাস’ বলে ধরা হয়। সেখান থেকে মানস-সঙ্কোশ-তিস্তা-গঙ্গা পর্যন্ত খাল কেটে সেই অতিরিক্ত জল গঙ্গা বেসিনে এবং তারপর আরও দক্ষিণে নিয়ে যাওয়াটা এই প্রকল্পের একটা প্রধান লক্ষ্য। (সঙ্গের মানচিত্র দ্রষ্টব্য, সূত্র: ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়)

এই যে চার-পাঁচটা নদীকে জুড়ে কয়েকশ কিলোমিটার লম্বা খাল কাটার প্রস্তাব করা হয়েছিল, প্রথমে স্থির হয় সেটা যাবে ডুয়ার্স ও তরাইয়ের গহীন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। পরিবেশবাদীদের তীব্র আপত্তির মুখে সরকার অবশ্য সে প্রস্তাব বাতিল করেছে, দিনকয়েক আগে ভারতের পার্লামেন্টে জলসম্পদ মন্ত্রী উমা ভারতী এক প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন এই খাল কাটার জন্য নতুন রুট চিহ্নিত করা হয়েছে যাতে প্রায় কোনও জঙ্গলই কাটা পড়বে না, পরিবেশেরও ক্ষতি হবে না।

সঙ্কোশ-মানস থেকে তিস্তা পর্যন্ত এই প্রস্তাবিত খালের যে অংশটুকু, সেটাই কিন্তু তিস্তা চুক্তি নিয়ে মমতা ব্যানার্জির বিকল্প ভাবনার মূল কথা। সঙ্কোশ আর মানস, এই দুটোই হল ব্রহ্মপুত্রর (বাংলাদেশে ঢুকে যার নাম হয়েছে যমুনা) উপনদী – আর সৌভাগ্যবশত সঙ্কোশের অবস্থা কিন্তু তিস্তার মতো নয়। তিস্তার উজানে জলাধার আর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করে সিকিম যেমন বিরাট পরিমাণ জল টেনে নিয়েছে, সঙ্কোশ আর মানসের উৎসভূমি ভুটানে কিন্তু তা হয়নি। সোজা কথায়, সঙ্কোশ আর মানসে এখনও জল উদ্বৃত্ত আছে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা। আর সে জল তিস্তাতেও টেনে আনা অসম্ভব নয়।

অসম্ভব নয়, কিন্তু কাজটা অবশ্য খুবই কঠিন

পশ্চিমবঙ্গের নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র (মমতাযাকে তিস্তার জলের প্রবাহ খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দাখিলের দায়িত্ব দিয়েছিলেন) কিছুদিন আগেই বলেছিলেন, এমন একটা খাল টানা যাবে না তা নয় – কিন্তু বন্য প্রাণীদের যাতায়াতের করিডর অক্ষুণ্ণ রাখাটা প্রকৌশলীদের জন্য হবে বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ।

এর আগে ভারতের আন্তঃ নদী-সংযোগ প্রকল্পের বিরোধিতা হয়েছিল বাংলাদেশেও। তবে মানস-সঙ্কোশ-তিস্তা-গঙ্গা খাল নিয়ে ঢাকার নদী-বিশেষজ্ঞ আইন-উন নিশাতও সম্প্রতি বলেছেন, ‘এমন একটা প্রকল্প হবে শুনেই আমাদের আঁতকে ওঠার কিছু নেই। তবে মনে রাখতে হবে এগুলো সবই ভারত-বাংলাদেশের অভিন্ন নদী, তাই এ ব্যাপারে যে কোনও উদ্যোগ নেওয়ার আগে দিল্লির উচিত প্রতিটি পদক্ষেপে ঢাকাকে সঙ্গে নিয়ে চলা।’

এই পটভূমিতেই মানস-সঙ্কোশ খালকে তিস্তা চুক্তির সঙ্গে জুড়ে দিয়ে মোক্ষম একটা চাল চেলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নদী-সংযোগ যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারেরই প্রকল্প, তাই মমতার এই ভাবনা নিয়ে তারা চট করে আপত্তি তুলতে পারবেন না। পাশাপাশি বাংলাদেশকেও বোঝানো যাবে, এই খাল কাটা হচ্ছে তিস্তায় জলের প্রবাহ বাড়াতেই– যা দুদেশের মধ্যে তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের পথকেই প্রশস্ত করবে। মমতাও দেখাতে পারবেন, তিনি মোটেই তিস্তা চুক্তির বিরোধী নন। কিন্তু ‘শুখা নদীর বুকে নয়’, তিনি চুক্তি করতে চান তিস্তায় জলের প্রবাহ বাড়ানোটা নিশ্চিত করেই।

এরই মধ্যে মঙ্গলবার ১১ আগস্ট মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লিতে আসার কথা, যে সফরে তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দেখা করবেন এবং আরও অনেক বিষয়সহ তিস্তা নিয়েও তাদের দুজনের মধ্যে কথা হবে। মুখ্যমন্ত্রীর অতি ঘনিষ্ঠ মহল সূত্রে আভাস মিলেছে, ওই বৈঠকেই সঙ্কোশ থেকে খাল কেটে তিস্তায় অতিরিক্ত জল নিয়ে আসার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর সামনে পেশ করবেন মমতা। এর জন্য রীতিমতো সব নকশা ও মানচিত্র নিয়েই তৈরি হয়ে দিল্লি আসছেন মমতা তিনি।

 তাহলে তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ কী দাঁড়াচ্ছে?

মুখ্যমন্ত্রীর দফতরের এক কর্মকর্তা বলছেন, ‘কেন্দ্র আমাদের প্রস্তাব মেনে নিলে চুক্তি হবেই। হ্যাঁ, খাল কাটতে সময় লাগবে ঠিকই, কিন্তু সেই চুক্তি হবে অর্থবহ, শুকনো তিস্তার বুকে তাড়াহুড়ো করে চুক্তি করলে কারও ভাগেই আসলে কিছু পড়বে না!’

Print Friendly, PDF & Email