May 15, 2024

দৈনিক প্রথম কথা

বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিক

একজন অমিত চক্রবর্তীর মরণোত্তর দেহদান

ডেস্ক প্রতিবেদন : বৃহস্পতিবার, সকাল সাড়ে ১১টা। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) এর তৃতীয় তলায় ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরীর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মধ্যবয়সী এক ভদ্রলোক। অনুমতি নিয়ে কক্ষে প্রবেশ করে নমস্কার দিয়ে বললেন, স্যার আপনার সাথে একটি বিষয়ে আলোচনা করতে এসেছি।

অধ্যাপক হাবিবুজ্জামান তখন শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। লোকটির দিকে তাকিয়ে বললেন, কী বলতে চান, একটু তাড়াতাড়ি বলুন, ক্লাসে যেতে হবে। লোকটি কাঁচুমাচু হয়ে বললেন, স্যার আমি আমার দেহদান করে যেতে চাই। সকাল থেকে ঢামেক হাসপাতালের বিভিন্ন লোকজনের দ্বারস্থ হয়েছি। কিন্তু কেউ আমাকে সঠিক তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারেননি। আপনি কী আমাকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারেন?

লোকটির কথা শুনে শিক্ষার্থীদের কিছুক্ষনের জন্য শ্রেণিকক্ষে অপেক্ষা করতে বলে তিনি লোকটির পরিচয়, পেশা, কী কারণে মরনোত্তর দেহদান করতে চান ইত্যাদি জানতে চাইলেন। পাশাপাশি মরনোত্তর দেহদানের সিদ্ধান্ত নেয়ায় তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে কিভাবে অ্যাফিডেভিট করে দেহদান করতে হবে তা বুঝিয়ে দিলেন।

ভদ্রলোকের নাম অমিত চক্রবর্তী। বাবা গোপাল চন্দ্র চক্রবর্তী। গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার গোবিন্দপুর গ্রামে। বর্তমানে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রে প্রোগ্রাম অফিসার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। স্ত্রী মঞ্জু রানি চক্রবর্তী  ধামরাই কুনিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করছেন। তাদের সংসারে অমিও চক্রবর্তী নামে তিন বছরের পুত্র সন্তান রয়েছে।

অমিত চক্রবর্তী জানান, হিন্দু ধর্মের রীতিনীতি অনুসারে তিনি মারা গেলে লাশ পুড়িয়ে ফেলা হবে। আর যদি মাটিতে কবর দেয়া হয় তাহলে লাশ পচে গলে মাটির সঙ্গে মিশে যাবে। কিন্তু মরণোত্তর দেহদান করলে তার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে অনেক মানুষ বেঁচে থাকবে। পাশাপাশি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা অধ্যায়নের সুযোগ পাবে।

তিনি জানান, হিন্দু ধর্মাবলম্বি হলেও সময় পেলেই বাইবেল, গীতা, কোরআন শরীফ পড়ে থাকেন। সকল ধর্মেই মানব সেবার কথা বলা হয়েছে। এ কারণেই তিনি ও একই এলাকার মমতাজুর রহমানসহ বেশ কয়েকজন মরণোত্তর দেহ দানে উৎসাহিত হয়েছেন।

তিনি জানালেন, গত ৫ বছর আগে তিনি মরণোত্তর দেহদানের সিদ্ধান্ত নেন। স্ত্রীকে একবার রাজিও করিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পর স্ত্রী বিষন্ন মনে এসে বলেন, দেহ দান করলে ছেলেকে বাবার সৎকারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হবে। তবে তিনি স্ত্রীকে বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাতে সক্ষম হবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

অমিত চক্রবর্তীর কাছ থেকে এ প্রতিবেদকের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে কুষ্টিয়া থেকে মমতাজুর রহমান নামে এক ব্যক্তি যোগাযোগ করে জানান, তিনি কুষ্টিয়া সুগার মিলে কাজ করতেন। কয়েকবছর আগে অবসরে যান। তিনি বলেন, আমিও মরণোত্তর দেহদান করতে চাই। ড. আহমেদ শরীফের মতো পন্ডিত ব্যক্তি দেহ দান করতে পারলে তিনি কেন পারবেন না।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, একজন মানুষ মরণোত্তর দেহদান করলে তার মৃত্যুর পর চোখ, কিডনি, হার্ট ও লিভারসহ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ জীবিত মানুষের দেহে প্রতিস্থাপিত হতে পারে। এতে অনেকে নতুন জীবন লাভ করতে পারে।

সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে কর্ণিয়াজনিত অন্ধ রোগীর সংখ্যা ৫ লাখ ২৬ হাজার। তাদের মধ্যে ১ লাখ ৬০ হাজার জন দু`চোখের ও ৩ লাখ ৬৬হাজার জনের একচোখের কর্ণিয়াজনিত অন্ধত্বে ভুগছে। চক্ষু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতি বছর দেশে আনুমানিক ১১ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে শতকরা মাত্র ১ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ মরণোত্তর চক্ষুদান করলে এক বছরেই ৩৩ হাজার কর্ণিয়া সংগ্রহ সম্ভব।

ঢামেক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগীয় প্রধান ডা. হাবিবুজ্জামান চৌধুরী জানান, মরনোত্তর দেহদান করতে হলে তিনি একজন উকিলের মাধ্যমে ৩০০ টাকার ষ্ট্যাম্পে পারিবারিক সম্মতি সাপেক্ষে কলেজের প্রিন্সিপালের কাছে আবেদন করবেন। যাচাই বাছাই সাপেক্ষে সন্তুুষ্টি সাপেক্ষে কলেজের এনাটমি বিভাগে দেহ সংরক্ষন করা হবে।

Print Friendly, PDF & Email